মহাকাশে এবার ইউরোপের চোখ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৩ জুলাই ২০২৩ ০২:১৭

মহাকাশে এবার ইউরোপের চোখ মহাকাশে এবার ইউরোপের চোখ


আলোড়ন তোলা জেমস ওয়েবের পর রহস্যময় মহাকাশের ছবিটা আরেকটু স্পষ্ট করতে আসছে ইউক্লিড। মহাবিশ্ব ঠিক কী দিয়ে তৈরি—তা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর একটি। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই গতকাল মহাকাশে পাঠানো হয় এই শক্তিশালী ইউরোপীয় টেলিস্কোপ। বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত ৯টা ১২ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে একটি ফ্যালকন-৯ রকেটে করে মহাকাশে পাঠানো হয় ইউক্লিড টেলিস্কোপ।


ইউক্লিড মহাবিশ্বের একটি বিশাল ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করবে। এর উদ্দেশ্য ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারের কিছু বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা।
মহাবিশ্বে আমরা যা দেখি তার আকৃতি ও প্রসারণকে দৃশ্যত ডার্ক এনার্জি ও ডার্ক ম্যাটারের ওই বৈশিষ্ট্যগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে। মহাকাশ গবেষকদের সরল স্বীকারোক্তি, তাঁরা এগুলো সম্পর্কে কার্যত কিছুই জানেন না।


এমনকি ডার্ক এনার্জি বা ডার্ক ম্যাটার কোনোটাই সরাসরি শনাক্তযোগ্যও নয়।
অধ্যাপক ইসোবেল হুক বলেন, ‘জ্ঞানের এই বড় শূন্যতার কারণেই আমরা মহাবিশ্বের উৎপত্তি পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনি।’ যুক্তরাজ্যের ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন, মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরো ধারণা পেতে ইউক্লিডই এখন সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

বিবিসিকে ইসোবেল হুক বলেন, ‘এটি হবে অতীত কালের জাহাজে যাত্রা করার মতো ঘটনা।


যখন মানুষ জানত না তাদের বিভিন্ন দিকে সাগরের ওপারে কোথায় কোথায় ভূখণ্ড আছে। আমরা ইউক্লিডের সহায়তায় মহাবিশ্বের এমন একটি মানচিত্র তৈরি করব, যাতে এর মধ্যে আমাদের অবস্থান কী, কিভাবে এ অবস্থায় এলাম এবং বিগ ব্যাংয়ের সময় থেকে সুন্দর ছায়াপথ তথা আমাদের সৌরজগৎ ও প্রাণ সম্পর্কে আরো জানা যায়।’
ইউক্লিড টেলিস্কোপটিকে পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে একটি পর্যবেক্ষণ অবস্থানে পাঠানো হবে। পৃথিবী থেকে সূর্য যেদিকে তার বিপরীত দিকে থাকবে ইউক্লিড।

এটি মূলত ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার (ইএসএ) একটি প্রকল্প হলেও মিশনটিতে মার্কিন মহাকাশ সংস্থারও (নাসা) উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশল সহায়তা রয়েছে।


অতীতের পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, মহাবিশ্বের সব শক্তির প্রায় ৭০ শতাংশই ডার্ক এনার্জি। ডার্ক ম্যাটার প্রায় ২৫ শতাংশ। সব দৃশ্যমান উপাদান (তারা, গ্যাস, ধুলা, গ্রহ-উপগ্রহ) মিলিয়ে বাকি ৫ শতাংশ। এই রহস্যময় ৯৫ শতাংশের জট খুলতে ইউক্লিড ছয় বছরব্যাপী একটি দ্বিমুখী জরিপ পরিচালনা করবে।

গবেষণার একটি বড় কাজ হবে ডার্ক ম্যাটারের বিস্তৃতির মানচিত্র তৈরি করা। ডার্ক ম্যাটার সরাসরি শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু আমাদের চোখে পড়া বস্তুগুলোর ওপর এর মহাকর্ষীয় প্রভাব বোঝা যায়। সেই থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত।

উদাহরণস্বরূপ, সহায়তা করার মতো বাড়তি কোনো কাঠামো না থাকলে ছায়াপথগুলো তাদের আকৃতি ধরে রাখতে পারত না। এগুলোই ডার্ক ম্যাটার বলে মনে করা হয়।

ডার্ক ম্যাটার সরাসরি দেখা যায় না। তবে এর ভর সুদূর ছায়াপথ থেকে আসা আলোকে সূক্ষ্মভাবে বিকৃত করে। ইউক্লিড টেলিস্কোপ এই বিকৃতির মাত্রা খতিয়ে দেখে মহাবিশ্বে ডার্ক ম্যাটারের বিস্তারের চিত্র তুলে ধরতে পারে। একসময়ের বিখ্যাত মহাকাশ টেলিস্কোপ ‘হাবল’ প্রথম মহাকাশের একটি ছোট অংশের জন্য এ কাজ করেছিল। এর পরিসর ছিল মাত্র দুই বর্গ ডিগ্রি। ইউক্লিড কাজটি করবে ১৫ হাজার বর্গ ডিগ্রি আকাশ জুড়ে। অর্থাৎ বিপুল মহাকাশের এক-তৃতীয়াংশের একটু বেশি জায়গায়।

এসব কাজের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে টেলিস্কোপটির ভিআইএস বা ক্যামেরা। এটি তৈরির কাজ পরিচালিত হয়েছিল যুক্তরাজ্য থেকে।

ইউসিএলের মুলার্ড স্পেস সায়েন্স ল্যাবরেটরির অধ্যাপক মার্ক ক্রপার বলেন, ‘এটি যে ছবি তৈরি করবে তার আকার হবে বিশাল। মাত্র একটি ছবি প্রদর্শনের জন্যই ৩০০টির বেশি হাইডেফিনেশন টিভির প্রয়োজন হবে।’

ডার্ক ম্যাটার থেকে ডার্ক এনার্জি একেবারেই আলাদা। রহস্যময় ডার্ক এনার্জির ‘শক্তি’ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করছে বলে মনে করা হয়। ১৯৯৮ সালে এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করা এবং প্রভাব তুলে ধরার সাফল্যের জন্য তিনজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ইউক্লিড ছায়াপথগুলোর ত্রিমাত্রিক বণ্টনের মানচিত্র তৈরির মাধ্যমে এ বিষয়টিই খতিয়ে দেখবে।

পৃথিবী থেকে প্রায় এক হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি ছায়াপথের সুনির্দিষ্ট অবস্থান পরিমাপ করবে ইউক্লিড। যুক্তরাজ্যের সারে ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বব নিকোল মনে করেন, এরপর তাঁরা কিছু আকর্ষণীয় প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবেন। যেমন—মহাবিশ্বের সব বিন্দুতে সম্প্রসারণের গতি কি একই রকম? সুদূর স্থানগুলোর ত্বরণ এখানকার মতো না হলে কী হবে? সেটা জানা গেলে তা হবে বিশাল আবিষ্কার।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি ঠিক কী ধরনের তা ইউক্লিড সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবে না। তবে এটি যা করতে পারবে তা হলো বর্তমানের অনেক মডেল ও ধারণাকে গুটিয়ে এনে আলোচনার ক্ষেত্র ছোট করা। এটি তাত্ত্বিক ও গবেষকদের মনোযোগ এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করবে।

মনে করা হচ্ছে, অজানা শক্তি ডার্ক এনার্জি হয়তো মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের আরো ভালো একটি ব্যাখ্যা দেবে। সেটিও বড় ধরনের নতুন আবিষ্কার হবে।

ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা অধ্যাপক মার্ক ম্যাকগরিয়ান বলেন, ‘একটি সম্ভাবনা হলো যে ডার্ক এনার্জি আসলে একটি পঞ্চম শক্তি। হয়তো এটি মহাবিশ্বের একটি নতুন শক্তি, যা শুধু বিশাল মাত্রায় কাজ করে। তাই আমাদের পৃথিবীতে জীবনকে প্রভাবিত করে না।’

মার্ক ম্যাকগরিয়ান অবশ্য মনে করেন, ডার্ক এনার্জির শক্তি মহাবিশ্বের ভাগ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। মহাবিশ্ব কতদূর প্রসারিত হতে চলেছে? এটি কি চিরদিনই প্রসারিত হয়ে ক্রমেই বড় হতে থাকবে? নাকি আবার সংকুচিত হয়ে গুঁড়িয়ে যাবে?



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: