যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বাড়ার সম্ভাবনা

ওষুধে ২০০% শুল্ক বসাবেন ট্রাম্প!

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:১৩

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

আমদানি করা ওষুধে ব্যাপক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে এই শুল্ক ২০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই গাড়ি ও ইস্পাতের মতো পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছেন, এবার তাঁর চোখ পড়েছে ওষুধশিল্পে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অনেক ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশ করেছে—এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বাজারে বড় প্রভাব পড়তে পারে বলেই শঙ্কা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধের দাম বেড়ে যাবে। বিঘ্নিত হতে পারে সরবরাহব্যবস্থা। ওষুধের সংকট হওয়ারও ঝুঁকি আছে।

১৯৬২ সালের ট্রেড এক্সপ্যানশন অ্যাক্টের ২৩২ ধারার আলোকে জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি তুলে ধরে এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়েছে হোয়াইট হাউস। যুক্তি হলো, কোভিড–১৯ মহামারির সময় যে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো জরুরি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র–ইউরোপ বাণিজ্য কাঠামোয় ইউরোপের কিছু পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ওষুধও আছে। তবে প্রশাসন অন্যান্য আমদানি পণ্যে আরও শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছে।

হোয়াইট হাউস বলছে, এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোম্পানিগুলোকে এক থেকে দেড় বছরের সময় দেওয়া হতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই আমদানি বাড়িয়েছে ও মজুত করেছে।

লিরিংক পার্টনার্সের বিশ্লেষক ডেভিড রিসিঙ্গার ২৯ জুলাইয়ের নোটে উল্লেখ করেছেন, বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানি ৬ থেকে ১৮ মাসের মতো মজুত করে রেখেছে।
অন্যদিকে জেফারিজের বিশ্লেষক ডেভিড উইন্ডলি সতর্ক করেছেন, যদি শুল্ক ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ কার্যকর হয়, তবে প্রকৃত প্রভাব বোঝা যাবে ২০২৭ বা ২০২৮ সালে। স্বল্প মেয়াদে বিঘ্ন কম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যয় ও সরবরাহে চাপ বাড়বে।

আইএনজির ডিডেরিক স্টাডিগ লিখেছেন, শুল্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ভোক্তাদের। ওষুধের খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামও বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্ন আয়ের পরিবার ও প্রবীণেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

স্টাডিগ আরও জানান, মাত্র ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলেও যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম ১০ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। বিদ্যমান মজুত শেষ হলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। স্থায়ী আয়ের মানুষদের জন্য এটি বোঝা নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসক্রিপশনের ৯২ শতাংশ জেনেরিক ওষুধ। জেনেরিক উৎপাদকেরা খুব স্বল্প মুনাফা করেন, সে কারণে তাদের পক্ষে বড় শুল্ক সামাল দেওয়া কঠিন। বিশ্লেষকদের মতে, কেউ কেউ শুল্ক না দিয়ে বাজার ছেড়ে দিতেও পারেন।

বিশ্বের অনেক কোম্পানি চীন ও ভারতে উৎপাদন সরিয়ে নিয়েছে। সেই সঙ্গে নিম্ন করহারের কারণে আয়ারল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশেও উৎপাদন স্থানান্তর করেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কোম্পানিও ওইসব দেশে উৎপাদন সরিয়ে নিয়েছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ ও ফার্মা পণ্যে বাণিজ্যঘাটতি ছিল প্রায় ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলার।

আমেরিকান অ্যাকশন ফোরামের বিশ্লেষক জ্যাকব জেনসেন বলন, অ্যান্টিবায়োটিকের ৯৭ শতাংশ, অ্যান্টিভাইরালের ৯২ শতাংশ ও জনপ্রিয় জেনেরিক ওষুধের ৮৩ শতাংশের অন্তত একটি সক্রিয় উপাদান বিদেশে তৈরি হয়। তাই তাৎক্ষণিকভাবে এর সমাধান কঠিন। নতুন কারখানা বানাতে বছর লেগে যায়, খরচও অনেক।

কিছু বড় কোম্পানি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। রোশে জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। জনসন অ্যান্ড জনসন আগামী চার বছরে ৫৫ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।

তবে এসব বিনিয়োগ অচিরেই যে বিকল্প কিছু তৈরি করে ফেলবে, বিষয়টি সে রকম নয়।

পিডব্লিউসির মাইটি পেরেইরা বলেন, ওষুধশিল্প খাত শূন্য শুল্ক থেকে সম্ভাব্য ২০০ শতাংশ শুল্কের দিকে যাচ্ছে—এটি বড় ধাক্কা। তিনি সতর্ক করে বলেন, শুল্ক থেকে প্রকৃতপক্ষে রক্ষা পেতে হলে যুক্তরাষ্ট্রেই সম্পূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করতে হবে।

অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, সর্বোচ্চ হার সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বিশেষ করে জেনেরিক ওষুধে ছাড় দেওয়া হতে পারে। প্রশাসন হয়তো তুলনামূলক কম শুল্ক হারই নির্ধারণ করবে।

শুধু অনিশ্চয়তার কারণেই বাজার পাল্টে যেতে পারে। কেউ কেউ নির্দিষ্ট ওষুধের সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে বা কম মুনাফার ওষুধ বাজারজাত না–ও করতে পারে।

ভারত বিশ্বের বৃহত্তম জেনেরিক ওষুধ সরবরাহকারী। ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যালায়েন্সের সেক্রেটারি জেনারেল সুদর্শন জৈন এএনআইকে বলেন, জেনেরিক ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রের সাশ্রয়ী চিকিৎসার জন্য ‘অত্যন্ত জরুরি’, তাই ভারতের ওষুধ কিন্তু ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের আওতার বাইরে আছে।

বাসভ ক্যাপিটালের সহপ্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ পান্ডে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ আমদানির প্রায় ৬ শতাংশ ভারত থেকে আসে। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরাও ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা স্বীকার করেন।

কয়েক বছর আগে ভারতের একটি কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে কেমোথেরাপি ওষুধের ঘাটতি হয়েছিল। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের মার্তা উওসিনস্কা বলেন, এই ওষুধের সরবরাহব্যবস্থা তেমন একটা গতিশীল নয়, একবার ধাক্কা লাগলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।

মার্তা আরও বলেন, আদর্শ অবস্থায় সব গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রেই তৈরি হওয়া উচিত। কিন্তু খরচ অনেক বেশি। আমরা সস্তা ওষুধের জন্য সরবরাহব্যবস্থা ভিন্ন দেশে স্থানান্তর করেছি। এখন যদি উল্টাতে চাই, পুরো ব্যবস্থাই নতুন করে সাজাতে হবে। প্রশ্ন হলো আমরা কতটা খরচ করতে প্রস্তুত?

আইনি ক্ষেত্রেও বাধা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সার্কিট কোর্ট অব আপিলস এই পদক্ষেপের কিছু অংশ খারিজ করেছে এবং বলেছে, শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, এ ধরনের বড় অর্থনৈতিক পদক্ষেপে কংগ্রেসের অনুমোদন লাগবে। তবে রায় স্থগিত আছে এবং বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে।

রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে। প্রেসিডেন্ট সামাজিক মাধ্যমে নতুন ইঙ্গিত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখন মজুত আছে, সে কারণে তাৎক্ষণিক সংকট না–ও হতে পারে। যদি শুল্ক বহাল থাকে ও সরবরাহব্যবস্থায় পরিবর্তন না আসে, তাহলে দাম বাড়বেই।

এদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশে ওষুধ রপ্তানি করলেও যুক্তরাষ্ট্র তেমন একটা রপ্তানি করে না। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ এখনো এলডিসিভুক্ত দেশ। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ওষুধে বড় অঙ্কের শুল্ক আরোপ করলেও বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানিতে বিশেষ প্রভাব পড়বে না।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: