
অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত মরুভূমির শহর ফিনিক্স। ফিনিক্সের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ ইতিহাসের সাক্ষী হলো মসজিদ জাওহরাতুল ইসলাম। এটি ছিল এই শহরের মুসলমানদের জন্য স্থায়ীভাবে নির্মিত প্রথম মসজিদ এবং এখনো এটি সেই মর্যাদা বহন করে চলেছে।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে ফিনিক্সের মুসলিম সম্প্রদায় ইবাদতের জন্য ভাড়াকৃত দোকানঘর কিংবা অস্থায়ী স্থান ব্যবহার করতেন। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হোক তা তারা চাননি। ১৯৭৮ সালে একজন মুসলমান সদস্য দক্ষিণ ফিনিক্সে চার একর জমি কিনে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ওয়াকফ করে দেন। এ জমিই পরে মসজিদ জাওহরাতুল ইসলামের ভিত্তিভূমি হয়। এরপর আরও চার একর জমি মুসলিম কমিউনিটির পক্ষ থেকে কেনা হয় এবং ১৯৮০ সালের নভেম্বরে মসজিদের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
এই মসজিদ নির্মাণে অনেকেই স্বেচ্ছায় অবদান রাখেন। আর্কিটেকচারের কাজটি নিঃস্বার্থভাবে করেন বেসেম হাকিম, আর কাঠামোগত ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন কামাল আমিন। মসজিদের সৌন্দর্য ও ল্যান্ডস্কেপের দায়িত্ব পালন করেন মালিক আবদুল্লাহ। নারীদের অজুখানা, গ্রন্থাগার, অফিস ও অভ্যন্তরীণ অংশের নকশা করেন উম্মুল খির শামসুদ্দিন, যিনি তখনকার ইমাম শামছুদ্দিনের স্ত্রী ছিলেন।
নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন লামার হাসান, যিনি তার প্রতিষ্ঠান হাসান অ্যান্ড সন্স কনস্ট্রাকশনের অধীনে আমেরিকান ও মেক্সিকান শ্রমিকদের নিয়ে পুরো কাজ সম্পন্ন করেন। প্রায় আড়াই বছরের নির্মাণযজ্ঞ শেষে ১৯৮১ সালের ১৯ জুন মসজিদটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
স্থাপত্যে মসজিদটি ‘ইমপোর্টেড স্টাইল’ ধারণ করে তৈরি। এটি একটি নিচু ও স্টাকো মুখাবরণ বিশিষ্ট ভবন, যার প্রবেশ পথের পাশে একটি বর্গাকৃতি মিনার রয়েছে। মূল প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের আগে রয়েছে একটি চতুর্ভুজাকৃতি খোলা উঠান, যেটিকে ঘিরে রেখেছে সাদা ও নীল হাতে ঘূর্ণানো টাইলস দ্বারা সাজানো আর্কেড। এগুলোর অনেকগুলোই তুরস্কের মুসলিম পরিবারগুলো দান করেছিলেন। ওক কাঠের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দেখা মেলে সুসজ্জিত নামাজঘর, যেখানে রয়েছে স্টাকো খিলান, জানালাবিশিষ্ট মিহরাব এবং চীনের এক মুসলিম পরিবারের দান করা ছয়টি ঝাড়বাতি।
সময় গড়িয়েছে, শহর বদলেছে, কিন্তু মসজিদ জাওহরাতুল ইসলামের অবকাঠামোগত খুব বেশি সংস্কার হয়নি। ২০২৪ সালে মসজিদ কমিটি আর্থিক সংকটে পড়ে। এসিগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কিছুদিন তীব্র তাপমাত্রায় নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। স্থানীয় একটি পত্রিকায় এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশ জুড়ে সর্বস্তরের মুসলমানরা সহযোগিতা করেন।
এই মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, বরং এটি দক্ষিণ ফিনিক্সের মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও সংহতির কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘ চার দশক ধরে মসজিদটি যেমন ধর্মীয় ইবাদতের স্থান হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি এটি দাওয়াহ, দাতব্য কার্যক্রম, শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে চরম সংকটে থেকেও মসজিদটি ৬০০ অসহায় মানুষকে খাদ্যসেবা দিয়েছে, যেটা ছিল তাদের অঙ্গীকারের অনন্য প্রকাশ।
মসজিদটির বর্তমান সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষ জামিলা শামসুদ্দিন বলেন, ‘আমরা কৃতজ্ঞ, এই বিপদের সময় শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমরাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি আমাদের ভালোবাসার নিদর্শন, একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধের প্রতীক।’
এই মসজিদের আরেক দিক হলো আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। ফিনিক্সের ফার্স্ট ইনস্টিটিউশনাল ব্যাপটিস্ট চার্চের অবসরপ্রাপ্ত পাদরি রেভারেন্ড ওয়ারেন স্টুয়ার্ট মসজিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশেষ সম্মাননা দেন, যা দুই সম্প্রদায়ের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার এক মাইলফলক।
আজ মসজিদ জাওহরাতুল ইসলাম শুধু মসজিদ নয়, বরং এটি আমেরিকার মুসলিম অভিবাসী ইতিহাসের এক নিখুঁত প্রতিরূপ, যেখানে একাগ্রতা, ত্যাগ, সৌন্দর্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ মিশে গিয়ে গড়ে তুলেছে এক চিরন্তন মজবুত স্তম্ভ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: