সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় আলেম সমাজ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:১২

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


সাহিত্য মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি, ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। মানবজাতির শুভবুদ্ধির উজ্জীবনী শক্তি। সাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিরাজমান অপসস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে উন্নত ও রুচিসম্মত সংস্কৃতির সুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলা। মানুষের মন ও চিন্তাধারাকে নর্দমায় পতিত হওয়া থেকে ফিরিয়ে কল্যাণের দিকে উদ্দীপ্ত করা ও মানব উদ্দীপনার আবহ তৈরি করা।

সাহিত্য হলো, সমুদ্রের তলদেশে বসবাস করা ঝিনুক। এ ঝিনুক একটা সময় তীরে ওঠে আসে এবং বৃষ্টিকণার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। যখনই সে তার গর্ভে বৃষ্টিকণা ধারণ করে তখনই তার গর্ভে আগমন ঘটে এক অমূল্য রত্নের।

সাহিত্য আঙিনায় যখন আমাদের সরব পদচারণা শুরু হবে, তখন সেখান থেকে উদ্ভাসিত হবে গল্প-উপন্যাস, আর কবিতার মতো অমূল্য রতœ।
সংস্কৃতি তো জীবনের ক্ষেত্রে আরো ব্যাপক, আরো গভীর ও অতলস্পর্শী। শোভনশীল ও ঔদার্যে বিভূষিত। জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি। মানুষ কিভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর নির্দেশিত পথে জীবনের সাফল্য অর্জন করবে, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে অগ্রসর হবে- সংস্কৃতি সেই পথনির্দেশক। এক কথায়, সংস্কৃতি হচ্ছে মানব জীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের পাথেয়। দ্বীন ও দুনিয়ার মহোত্তম সমন্বয়। এর ব্যাপকতাও জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। যে যত বেশি সংস্কৃতিবান, সে ততই পরিশুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন ও সফল মানুষ।

মানবজাতির ইতিহাসে পরম বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন মানুষ হচ্ছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা:। তিনি ছিলেন এক নয়া সংস্কৃতির নির্মাতা। শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতার এক দুর্লভ মহিমায় বিভূষিত। অথচ তাঁর সমাজ ও সময়, তার যুগ ও প্রতিবেশী ছিল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। হজরত ঈসা আ:-এর পর থেকে প্রায় ৬০০ বছর পর্যন্ত মানব জাতি দিশেহারা লাগামহীন ঘোড়ার মতো দিগি¦দিক ছুটছিল। এ দীর্ঘ সময় মানবসমাজ নিষ্পিষ্ট ছিল পঙ্কিলতা, নির্মমতা, অস্বচ্ছতা, অসততা, অসাধুতা, পৌত্তলিকতা ও পেশিশক্তিমত্তার এক অসহনীয় অনাচার ও দুর্বৃত্তপরায়ণতায়।

এ যুগ সন্ধিক্ষণে তাঁর আগমন ঘটে। গোটা মানবমণ্ডলীর কল্যাণকামী হয়ে তিনি যখন দ্বীন প্রচারে লিপ্ত, শত বাধা-বিঘেœর মধ্যেও তিনি ছিলেন অবিচল ও সুদৃঢ়। অথচ তাঁর কোনো শিক্ষক ছিল না। তিনি জাগতিক কোনো পাঠ গ্রহণ করেননি। নবুওয়তের আগে প্রকৃতিই ছিল তার শিক্ষক। তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর বিচক্ষণতা, তাঁর ঔদার্য, তাঁর বিবেচনাবোধ তাঁর সময় ও পরিবেশ থেকে তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। সেই সমাজের সম্মানিত ও মর্যাদাবান পুরুষ হিসেবে, পরিশুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দুর্লভ সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। ভাষার শুদ্ধতা, সাংস্কৃতিক পরিচ্ছন্নতা ও মানসিক ঔজ্জ্বল্যে তিনি ছিলেন এক মহিমান্বিত মানুষ।

নবুওয়ত লাভের পর স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে ক্ষেত্রেও তিনি এক প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী, সুবিবেচক, ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপূর্ণ মানুষ। জীবনের কোনো কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো জীবনবোধে নিবিষ্ট ও মানুষের সহজাত এবং আত্মলগ্ন জীবনাচরণের সমন্বয়ক উপাদান দুটোও তাঁর স্পর্শে পল্লবিত হয়েছে।

রাসূল সা: সগৌরবে বলতেন, ‘আনা আফসাহুল আরব’ আমিই আরবের শুদ্ধতম ভাষা সাহিত্যের অধিকারী। কেননা, আমার জন্ম হয়েছে কোরাইশ বংশে আর বেড়ে ওঠেছি সাদ বিন বকর গোত্রে। সেখানেই কেটেছে ভাষা শিখার শৈশব। তাঁর যুগ ছিল কবিতার ছন্দ-উপমা, শব্দ ও বাণী-রূপকল্পে প্লাবিত।

সমাজ সভ্যতার নির্মাণ, চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন, কালের সমস্যাবলির সমাধান ও সমকালীন জীবনকে সুন্দর সুশৃঙ্খল ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে সুস্থ সাহিত্যের বিকল্প নেই। কারণ কোনো প্রকার পুঁথিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়; বরং গত হওয়া সুদীর্ঘ দেড় হাজর বছরের বাস্তব চিত্র-ই প্রমাণ করে, ইসলামই একমাত্র সর্বশ্রেণীর সর্বকালের সেরা মুক্তির বার্তাবাহক। আর এ ইসলামের চির সফল অলৌকিক জীবন-দর্শনকে তুলে এনে লোকসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য সাহিত্যচর্চায় উলামায়ে ইসলামের সক্রিয় পদচারণার দাবি এবং ওয়ারিসে নবী সা:-এর উত্তরাধিকার হিসেবে দ্বীনি কর্তব্যও বটে।

সুখকর সংবাদ হলো, ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, বিশেষ করে বাতিল ও অসুস্থ সাহিত্য চর্চায় নিমজ্জিত মানুষদের উপযুক্ত জবাব দিতে হালের উলামায়ে ইসলাম সাহিত্যচর্চাকে অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় স্বীকৃতি দিতে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। যদিও অতীতে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে সাহিত্যচর্চা থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। কিন্তু সময়ের পালাবদলে বদলেছে সব চিন্তাধারা। শুরু হয়েছে সাহিত্যচর্চা। একঘেয়ে চিন্তার হিমায়িত অতীতের বরফ গলেছে। উলামায়ে ইসলামের হৃদয়ের বাদশাহ নবীয়ে আরাবি সা:-এর আদর্শ অনুসরণে স্বীয় মাতৃভাষার অলঙ্কারে সুসজ্জিত হওয়ার পথ প্রয়াসী হয়েছেন। ফলে, সাহিত্য ফুলের সৌরভে সুভাসিত, কুরআনের ভাষায় ‘তাসুররুন-নাজিরিন’ মাত্রায় উন্নীত।

বাংলা সাহিত্যে উলামায়ে ইসলামের এ সাধনাকে আমরা কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি।

  •  লেখালিখি : সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে সুখকর সম্পর্ক হলো লেখালিখি। উলামায়ে ইসলাম সে দিকটিকে আঁকড়ে ধরে আছেন নিরলসভাবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহিত্যের জোয়ার বইয়ে চলছে স্রোতের বিপরীতে। সাহিত্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে সম্মুখ অস্ত্র হিসেবে। ইসলাম বিদ্বেষভাবাপন্ন চমকপ্রদ রসকষ দিয়ে বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস সাজিয়ে ধোঁকা দিচ্ছে সহজ-সরল মানুষদের। মানুষজনও তা খুব সানন্দে গ্রহণ করছে। এহেন মুহূর্তে উলামায়ে ইসলামের কিছু কলমসৈনিক তাদের মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু করেন তাদের ইসলাম বিদ্বেষভাবাপন্ন লেখার জবাব দেয়া। এদিক থেকে সফলও হচ্ছেন উলামায়ে ইসলাম। 

  • ব্যক্তিত্ব গঠন : বাংলায় উলামায়ে ইসলামের হৃদমাজারে স্বীকৃত বাংলা সাহিত্যচর্চার বীজ বপন করেছিলেন এ দেশের স্বর্ণযুগের সূর্যসন্তান আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ:। তার হাতেই যেমন উন্মোচিত হয়েছিল অনুবাদ ও মৌলিক রচনার দ্বার ঠিক তেমনভাবেই উম্মাহর প্রতি দরদ আর রাসূল সা:-এর আদর্শের প্রতি তাপিত হৃদয় অস্থির ছিল বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চার ধারাকে অব্যাহত রাখতে। তার সে দগ্ধ-হৃদয়ের অন্তিম আকাক্সক্ষার কাক্সিক্ষত ফসলই হলেন বাংলা ভাষায় বুখারি শরিফের নন্দিত ভাষ্যকার শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ:। সভ্য সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যক্তিত্ব গঠন অপরিহার্য, তা সত্য। কিন্তু আল্লামা ফরিদপুরী রহ: এ ধারার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। তবে টুকরো টুকরোভাবে বাংলা সাহিত্যের হাল ধরেছেন কওমিয়ানরা। চেষ্টা করে যাচ্ছেন দিন-রাত।

  • মৌলিক রচনা ও গবেষণা : মৌলিক রচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রে কওমি অঙ্গন আরবি, উর্দু ও বাংলায় বেশ শক্ত পাটাতনের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। তবে শুধু বাংলায় গবেষণা ও মৌলিক রচনা সংখ্যার অভাব স্বীকার করছি অকপটেই। সে অভাব আমাদেরকে নিরাশ করেনি, করবেও না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষ, সিরাত বিশ্বকোষ, ফতোয়া ও মাসায়িল, হানাফি মাজহাব ও ইলমে হাদিস, হাদিস ও বিজ্ঞান ইত্যাদি প্রকাশিত প্রকল্পভিত্তিক একক গবেষণা গ্রন্থের লেখক রয়েছেন আমাদের সূর্য পুরুষরা। সেই লেখা অব্যাহত গতিতে চলছে।

  • অনুবাদ ও সঙ্কলন : বাংলা সাহিত্য আমাদের বিপুল মাত্রায় পদার্পণ সে কোনো দূর অতীতের কথা নয়। বড়জোর দুই দশক হবে। এর মধ্যেই তাফসির, হাদিস, ইতিহাস, জীবনী ও কাব্যগ্রন্থসহ মানব জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে দিক সম্পর্কে বিদেশী ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি। অনুবাদ সাহিত্যের এই ভাণ্ডার যেমন অবিশ্বাস্য তেমন নবীন-প্রবীণ সাহিত্যিকের সংখ্যাও প্রচুর। শুধু ঢাকার চকবাজার, বাংলাবাজার ও বায়তুল মোকাররমকেন্দ্রিক প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যা নির্ণয় করাও একটি স্বতন্ত্র বিষয় এখন। অনুবাদ ও সঙ্কলনের দুরূহ ময়দানে আলেমদের অনেকে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।

  • পত্রিকা প্রকাশ ও প্রকাশনা সংস্থা : আমাদের সাহিত্য যাত্রা বিলম্বিত হলেও সাহিত্যের সব অঙ্গনে আমাদের পদচারণা এখন সরব। বিশেষ করে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ এবং প্রতিটি পত্রিকাকেন্দ্রিক আমাদের উঠতি তরুণদের সাহিত্যচর্চার এক বর্ণাঢ্য আয়োজন চোখে পড়ার মতো। কওমি মাদরাসার আলেমদের হাতে পত্রিকাগুলোর মধ্যে মাসিক মঈনুল ইসলাম, মাসিক আল আশরাফ, মাসিক আল-কাউসার, মাসিক আদর্শ নারী, মাসিক মদিনার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হালে অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে কিছু তরুণ আলেমের পরিচালনায়।
  • সাংবাদিকতা : বর্তমান সময়ে সাহিত্যাঙ্গনে সাংবাদিকতা হচ্ছে এক অনন্য ফল। যে ফলের ভূমিকা পালন করছে সাংবাদিকতার মাধ্যমে বর্তমান সময়ের উলামায়ে ইসলামের বিশেষ একাংশ। সাংবাদিকতায় কওমি আলেমদের অবস্থান এখনো স্বপ্নদোলায় আন্দোলিত।

বাংলা সাহিত্যে কওমি আলেমদের স্বল্পসময়ের সাধনায় যে পুঁজি গড়ে উঠেছে, তা পরিমাণের বিচারে বিস্ময়কর হলেও মানের বিচারে কাক্সিক্ষত মাত্রায় স্পর্শ করতে এখনো অনেক দেরি। তাই ভাষাশিল্পের সেই সাধনাকে শানিত করে তুলতে প্রয়োজন শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতা এবং তরুণ লিখিয়েদের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজন কওমি ওলামায়ে কেরামের সাহিত্য-সাধনার এ মহান অধ্যায়কে স্বজাতির সুধীজনদের সমীপে তুলে ধরার আশু ব্যবস্থা।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: