
চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। বই বসন্তের মাস। তার মধ্যে আবার হয়ে গেল প্রাণের বিশ্ব ইজতেমা। এ যেন দুই আনন্দ উৎসব। দ্বীনপ্রেমী ও বইপ্রেমীদের মিলনমেলা। এ মাসে দেশের মানুষের নজর থাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজাভ প্রকৃতির বিচিত্র রঙিন আয়োজনের দিকে। সবার আগ্রহ থাকে কখন এসে উপস্থিত হবে প্রাণের মেলায়।
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার এক অনন্য প্রতিচিত্র। এটি শুধুমাত্র একটি বইমেলা নয় বরং জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির এক মহা মিলনমেলা। আর এবার বইমেলায় বেশ কয়েকটি ইসলামি প্রকাশনী স্টল পেয়েছে, যা মেলার সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করেছে। বইমেলার সৌন্দর্যের কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো।
সাজসজ্জা ও পরিবেশ
বইমেলা শুরু হলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সাজানো হয় নান্দনিকভাবে। মেলার প্রবেশপথ, স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে থাকে বর্ণিল ডিজাইন, আলোকসজ্জা ও শিল্পমণ্ডিত চিত্রকর্ম। বাংলা ভাষা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলতে নানা ধরনের শিল্পকর্মও ব্যবহৃত হয়। জায়গায় জায়গায় রয়েছে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, নামাজের জায়গা, জুলাই-আগস্টের স্মৃতিফলক, বিপ্লবী নানা আয়োজন এবং সাহিত্যের আসর। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই প্রথম হতে যাচ্ছে বৈষম্যহীন সর্বোচ্চ অংশগ্রহণমূলক বইমেলা। আশা করা হচ্ছে, গত বিশ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেবে এবারের বইমেলা। আসলে সাজসজ্জা ও নিরিবিলি পরিবেশের মুগ্ধকর সবুজের দ্বীপে অনুষ্ঠিত অমর একুশে এই গ্রন্থমেলার পূর্ণ সৌন্দর্য অল্প কথায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।
বইয়ের সমারোহ
নতুন বইয়ের গন্ধে ঘুম আসে না। পাঠক হারিয়ে যান প্রেমের দিগন্তে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, লেখক-পাঠকের সরাসরি মেলবন্ধন, বিচিত্র সাহিত্য, গবেষণা ও জ্ঞানগর্ভ বইয়ের সমাহার, এসব বইমেলার অন্যতম সৌন্দর্য। মেলায় সাহিত্যপ্রেমীরা নতুন বইয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান, বই কেনেন, পছন্দের লেখকদের বই সংগ্রহ করেন। অটোগ্রাফ নেন। লেখকের সঙ্গে সময় যাপন করেন। অনুভূতি শেয়ার করেন। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে লেখকদের নানা আয়োজন থাকে। পত্রিকাতেও থাকে নানা আয়োজনে। এছাড়া লেখক কর্নারের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানগুলো সবাই উপভোগ করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আড্ডা
বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ সাহিত্য আলোচনা, মেলার কোণে কবিতা পাঠ, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, লেখকদের সাক্ষাৎকার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বইপ্রেমীরা এখানে জড়ো হয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন, লেখকদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন এবং সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেন। নানা আয়োজনে উদ্যোগী হয়ে ওঠে প্রকাশনাগুলো। প্রকাশকরা নির্দিষ্ট ছাড়ে বই বিক্রি করেন এবং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী লেখক-পাঠকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেন।
লেখক-পাঠকের মেলবন্ধন
বইমেলার অন্যতম সৌন্দর্য হলো লেখক-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগ। পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, বই সম্পর্কে মতামত দিতে পারেন, অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারেন, এমনকি নতুন লেখার অনুপ্রেরণাও পেতে পারেন। প্রতিদিন শত শত নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। লেখাপাঠ, কবিতা আবৃত্তিসহ নানা প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিচিত্র
বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার জায়গা নয়, এটি আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শহীদদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নতুন করে স্মরণ করাবে জুলাই-আগস্টের শোক স্মৃতির কথা। বলা যাচ্ছে না, এবারের মতো স্বাধীন ও মুক্ত বইমেলা জাতি আর কখনো পাবে কি না। বইমেলার পরিবেশ, ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার আবহ জাতি হিসেবে আমাদের আরও দৃঢ় করে তোলে। এবারের মেলায় ইসলামি প্রকাশনীগুলোকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা এবারের বইমেলার বাড়তি সৌন্দর্য। স্বল্প পরিসরে হলেও এবার ইসলামের বার্তা ছড়াতে পারবে অনুমতি পাওয়া ইসলামি প্রকাশনীগুলো। এজন্য বাংলা একাডেমির প্রতি বিশেষ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন ইসলামপ্রেমী পাঠকরা।
শিশু-কিশোরদের জন্য আয়োজন
বইমেলায় শিশু-কিশোরদের জন্য থাকে বিশেষ আয়োজন ‘শিশু চত্বর’, যেখানে তারা গল্পের বই, বিনোদন ও শিক্ষামূলক বই পেতে পারে। শিশুদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাও হয়ে থাকে। অভিভাবকরা দারুণভাবে তা উপভোগ করেন। তারা দলে দলে শিশুদের নিয়ে আসতে আগ্রহী হন।
বইয়ের গন্ধ ও পাঠকের উচ্ছ্বাস
বইমেলার আরেকটি সৌন্দর্য হলো নতুন বইয়ের সুবাস ও পাঠকদের উচ্ছ্বাস। নতুন বই হাতে নেওয়ার আনন্দ, প্রিয় লেখকের বই সংগ্রহের উত্তেজনা, এসব অনুভূতি বইমেলার পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। সব মিলিয়ে অমর একুশে বইমেলা শুধু একটি বই বিক্রির জায়গা নয়, বরং এটি বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির এক মহা উৎসব, যেখানে জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও ভাষার সৌন্দর্য একসঙ্গে ফুটে ওঠে। বইমেলার মহান মিলনমেলা যেন কোটি প্রাণের উচ্ছ্বাস। মিডিয়াও গুরুত্বের সঙ্গে তা প্রচার করে। বইপ্রেমীরা একটি মাস কাটিয়ে দেয় একটি ঘোরের মধ্যে।
ইসলামপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস
এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এবার ইসলামি প্রকাশনী বইমেলায় স্টল পেয়েছে। যা অকল্পনীয়। একটা সময় ছিল ইসলামি প্রকাশনীর নাম শুনেই দায়িত্বশীলরা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিতেন। সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও রহমত। মহান আল্লাহ উত্তরোত্তর এই ধারার আরও সম্প্রসারিত রূপ দান করুন। অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়েছে স্টলগুলো। ফলে উচ্ছ্বসিত কওমি ঘরানা ও ইসলামপ্রিয় জনতা। এবার মনে হয় মেলা অনেকটাই আমাদের। তাই সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই সুবর্ণ সুযোগকে দ্বীন প্রচারের কাজে লাগাই। বিশেষ অনুরোধ ও আহ্বান রইল, দলে দলে মেলায় আসুন, বই কিনুন, পড়–ন, প্রিয়জনদের উপহার দিন। কারণ সফলতার জন্য পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: