ফাইল ছবি
চীনা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে বহুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হলো, অন্য দেশগুলোর ঋণনির্ভরতা চীনের পরাশক্তি হয়ে ওঠার পথে ইন্ধন জোগায়। কিন্তু এইডডাটার নতুন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, চীন থেকে সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা যুক্তরাষ্ট্রেরই বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভার্জিনিয়াভিত্তিক উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি কলেজের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটা। তাদের তথ্য অনুযায়ী গত ২৫ বছরে চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সম্মিলিতভাবে ২০ হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এসব ঋণের বড় অংশ তথ্য গোপনের মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে, অর্থ স্থানান্তরে ব্যবহার হয়েছে কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, বারমুডা, ডেলাওয়ারসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শেল কোম্পানিগুলো।
ঋণগুলোর বড় অংশই ব্যবহার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায় অংশীদারত্ব কেনায়। ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ পেয়েছে রোবোটিকস, সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি ও বায়োটেক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসারে এসব প্রতিষ্ঠানকেই কৌশলগত প্রযুক্তি ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল ধরা হয়।
গবেষকরা বলছেন, যেমনটা আগে ধারণা করা হতো তার তুলনায় চীনের ঋণ নেটওয়ার্ক অনেক বেশি বিস্তৃত ও জটিল। শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয় যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ উন্নত দেশগুলোয়ও এটি বিস্তৃত।
হোয়াইট হাউজের সাবেক বিনিয়োগ উপদেষ্টা উইলিয়াম হেনাগানের আশঙ্কা, গোপন ঋণচক্র চীনকে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আপনি অর্থনীতি গতিশীল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন কিনা, তার ওপর হার-জিত নির্ভর করবে।’
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবার হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পর তা আরো জোরদার হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন-বেইজিং তীব্র প্রতিযোগিতার মাঝে নতুন এ তথ্যকে আশঙ্কাজনক হিসেবে দেখছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা। এইডডাটার গবেষণায় চীনা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থায়নে হওয়া চুক্তিগুলোকে সমস্যাজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ঋণদাতারা চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল ফাইন্যান্সিয়াল কমিশনের নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের লক্ষ্য চীনের কৌশলগত স্বার্থ গতিশীল করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০-২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে চীন। ঋণের এ আকার আগের যেকোনো প্রাক্কলনের তুলনায় দ্বিগুণ এমনকি অভিজ্ঞ গবেষকদেরও বিস্মিত করেছে। উন্নত দেশগুলোয় এসব ঋণের বড় অংশ গেছে কৌশলগত খনিজসম্পদ ও উচ্চ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোয়। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, রাডার সিস্টেম, ক্ষেপণাস্ত্র ও টেলিকম নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত দুষ্প্রাপ্য খনিজ ও সেমিকন্ডাক্টর রয়েছে।
এইডডাটার নির্বাহী পরিচালক ব্র্যাড পার্কস বলেন, ‘বাইডেন বা ট্রাম্প যে-ই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা বরাবরই বেইজিংকে “শিকারি ঋণদাতা” বলে এসেছেন। বাস্তবে এটি সত্যিই তীব্র।’
চীনের রাষ্ট্রীয় ঋণের পূর্ণ আকার কখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ বিষয়ে ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশনের সাবেক প্রধান স্কট নাথান বলেন, ‘এটি পুরোপুরি অস্বচ্ছ। শেল কোম্পানির গোপন চুক্তি কিংবা তথ্য লোপাট যেভাবেই হোক, কী পরিমাণ ঋণ দেয় সেই পূর্ণ চিত্র বের করা অত্যন্ত কঠিন করে তোলে চীন।’
বিদেশী ঋণের ওপর নজরদারির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে কমিটি অন ফরেন ইনভেস্টমেন্ট ইন দ্য ইউএস (সিএফআইইউসি)। নজরদারির প্রক্রিয়া ২০২৩ সালের পর আরো শক্তিশালী হয়েছে। এর বিপরীতে অর্থায়নের নতুন নতুন কৌশল বেছে নিয়েছে চীন। বিশেষত বিদেশে নতুন ব্যাংক ও শাখা খোলার মাধ্যমে ঋণের উৎসে আনা হয় ধোঁয়াশা। ব্র্যাড পার্কস বলেন, ‘যেসব জায়গায় নজরদারি বাড়ছে, সেখানে প্রবেশের নতুন পথ খুঁজে নিয়েছে বেইজিং।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিম উপকূল ও মেক্সিকো উপসাগরজুড়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তি খাতে ছড়িয়ে আছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বীমা প্রতিষ্ঠান আয়রনশোরের ৮০ শতাংশ কিনে নেয় চীনা একটি কোম্পানি। এতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে এসেছে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ। বীমা কোম্পানিটির গ্রাহকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও এফবিআইয়ের কর্মকর্তা এবং কয়েকজন আন্ডারকভার এজেন্টও ছিলেন। কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের একটি কোম্পানির মাধ্যমে ঋণের এ অর্থ ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল। পরে ঝুঁকি বুঝে চীনা ক্রেতাকে অংশীদারত্ব বিক্রি করতে বাধ্য করে যুক্তরাষ্ট্র।
একই বছর ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ পরিকল্পনা প্রকাশ করে বেইজিং। এর লক্ষ্য সেমিকন্ডাক্টর, বায়োটেক, রোবোটিকসসহ ১০টি উচ্চ প্রযুক্তি খাতে ১০ বছরের মধ্যে ৭০ শতাংশ নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করা। পরের বছর ২০১৬ সালে চীনের এক্সপোর্ট–ইমপোর্ট ব্যাংক মিশিগানের একটি রোবোটিকস সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণে ১৫ কোটি ডলার ঋণ দেয়।
‘মেড ইন চায়না’ ঘোষণার পর থেকে রোবোটিকস, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজির মতো সংবেদনশীল খাতে চীনা ঋণ সহায়তায় বিদেশী অধিগ্রহণের হার ৪৬ থেকে বেড়ে ৮৮ শতাংশ হয়েছে।
প্রতিবেদনে দুই শতাধিক দেশের নিয়ন্ত্রক নথি, ব্যক্তিগত চুক্তি ও স্টক এক্সচেঞ্জের প্রকাশিত তথ্য খুঁজে এ গোপন ঋণ চিহ্নিত করেছে এইডডাটা। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কর্মসূচি শুরুর পর থেকে গবেষণাটি শুরু হয়। তবে তিন বছর আগে গবেষকরা দেখতে পান, বিপুল পরিমাণ চীনা ঋণ উন্নত দেশগুলোয়ও যাচ্ছে; যেখানে প্রযুক্তিগত সম্পদ অধিগ্রহণের লক্ষ্য স্পষ্ট।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: