
নরেন্দ্র মোদি এবং বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কেবল আদর্শিকভাবেই সমসাময়িক ব্যক্তি নন বরং ক্রমবর্ধমানভাবে তারা সমান্তরাল পথে হাঁটছেন। তাদের এই পদক্ষেপ দেশ দুটিকে বিশ্বব্যাপী শক্তিধরে রূপান্তরিত করতে পারে অথবা দীর্ঘমেয়াদী অভ্যন্তরীণ ভাঙন এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার মধ্যে ফেলতে পারে।
উভয় নেতাই শক্তিশালী শাসনের একটি নতুন ধরনকে রুপায়িত করছেন। জনতাবাদি ক্যারিশমা এবং কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের সাথে ধর্মীয়ভাবে উদ্বুদ্ধ জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে এই ধরনটিকে রুপায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস-ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিজয়ী করে চলেছেন, প্রাচীন সভ্যতার ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছেন এবং নিজেদের শাসনকে সুসংহত করতে ঘরোয়া আলোচনাকে নিরলসভাবে মেরুকরণ করে চলেছেন।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখেছে, একটি বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবেস্থান অর্জন করেছে। আব্রাহাম চুক্তি আরব রাষ্ট্রগুলির সাথে দেশটির সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা খাত প্রসারিত হচ্ছে। মোদির ভারত একইভাবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উত্থান উদযাপন করেছে, ডিজিটাল অবকাঠামোকে চমতকার করেছে এবং বিশ্বব্যাপী আরও দৃঢ় অবস্থান অর্জন করেছে।
কিন্তু এই অর্জনের পেছনে একটি অস্থির বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। উভয় দেশেই অর্থনৈতিক অর্জন অসম। প্রায়শই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং সামাজিক বিভাজন থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য এটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে কর্পোরেট একচেটিয়া ব্যবসাগুলি উন্নতি লাভ করছে। ইসরায়েলে তেল আবিব সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিপরীতে, তাদের দখলকৃত অঞ্চলগুলিতে ফিলিস্তিনিরা দারিদ্র্যতায় ডুবছে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি পদ্ধতিগতভাবে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। মোদি সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন, বিচার বিভাগের নিয়োগে হস্তক্ষেপ করছেন এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে মুক্তভাবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। স্বাধীন সাংবাদিক এবং কর্মীদের সন্দেহজনক অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে এবং শাসক দলের সাথে সম্পৃক্ত ডিজিটাল জনতা (মব) জনসাধারণের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলে এই একই খেলা খেলছেন। ২০২৩ সালে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করতে তিনি বিতর্কিত সংস্কার প্রচেষ্টা চালান, যা দেশব্যাপী নজিরবিহীন বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই সংস্কার ব্যক্তিগত ও আদর্শিক লাভের জন্য গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে অস্থিতিশীল করার ইচ্ছাকে তুলে ধরেছে। এটিকে আইনি জবাবদিহিতা এড়াতে একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
উভয় নেতাই জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মকে মিশিয়ে বিপজ্জনক প্রভাব তৈরি করেছেন। মোদির ভারতে হিন্দুধর্মকে রূপান্তরিত করা হয়েছে হিন্দুত্বে- এটিকে একটি জঙ্গি, রাজনৈতিক মতাদর্শ যা মুসলিম, খ্রিস্টান এবং দলিতদের কোণঠাসা করে তুলেছে।
মোদির তত্ত্বাবধানে গরু জবাইয়ের জন্য গণপিটুনি থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি এবং উপাসনালয় ধ্বংসসহ সব ধরনের ঘৃণামূলক অপরাধ বেড়েছে। ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গা সাম্প্রদায়িক উস্কানির একটি ভয়াবহ প্রমাণ। এতে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম।
খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের হয়রানি করতে ধর্মান্তর বিরোধী আইন ব্যবহার করা হয়েছে, যাজকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং গির্জাগুলিতে হামলা চালানো হয়েছে। ২০২৩ সালে মণিপুরে জাতিগত-ধর্মীয় সহিংসতার এক ভয়াবহ ঘটনায় ২ শতাধিক বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলকে একসময় ইহুদিদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক আবাসভূমি এবং বহুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল, নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে দেশটি এখন জাতিগত-ধর্মীয় একচেটিয়াতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ২০১৮ সালের জাতি-রাষ্ট্র আইন ইসরায়েলকে কেবল ইহুদি জনগণের জাতি-রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে এবং কার্যত আরব নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদায় ছুঁড়ে ফেলেছে।
গাজায় বারবার হামলার সময় নারী ও শিশু সহ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, পুরো এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে।
২০২১ সালে ইসরায়েলি পুলিশ রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে হামলা চালায়, যা মুসলিম বিশ্বে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। পশ্চিম তীরে সেটেলারদের সহিংসতা বেড়েছে। প্রায়শই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নজরদারিতে বা সুরক্ষায় এই সহিংসতা চলছে।
খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানগুলিকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। জেরুজালেমে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের উপর চরমপন্থী যুবকরা থুতু নিক্ষেপ করেছে এবং হুমকি দিয়েছে। গির্জা ভাঙচুর করা হয়েছে এবং লেহাভার মতো গোষ্ঠীগুলি প্রকাশ্যে খ্রিস্টানদের পবিত্র শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পক্ষে কথা বলছে।
এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যেও ভিন্নমত আর সহ্য করা হয় না। ভারতে আনন্দ তেলতুম্বদের মতো দলিত কর্মীদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা ডিজিটাল এবং শারীরিকভাবে উচ্ছৃংখল জনতার ক্রোধের মুখোমুখি হচ্ছে।
ইসরায়েলে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স এবং বামপন্থী অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের সদস্য সহ অ-ইহুদিবাদী ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং তাদের দমন-পীড়নের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। উভয় দেশজুড়েই শাসক আদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখানো ক্রমশ দেশপ্রেম হয়ে উঠছে, অন্যদিকে ভিন্নমতকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে উভয় ব্যক্তিই সামরিকবাদে আনন্দিত। নেতানিয়াহু গাজায় বারবার বোমা হামলা চালিয়েছেন এবং ইসরায়েলের সীমানার বাইরে আক্রমণাত্মক নজরদারি অভিযান চালিয়েছেন।
মোদির সরকার ২০১৯ সালে বালাকোটে বিমান হামলার নির্দেশ দেয় এবং কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে এই অঞ্চলটিকে কারফিউ এবং তথ্য ব্ল্যাকআউটের অধীনে একটি ভারী সামরিক অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলি সংঘাতের সমাধানের চেয়ে অনেক দূরত্ব তৈরি করছে, অবিশ্বাসকে আরও গভীর করছে এবং উভয় অঞ্চলকে প্রতিশোধ এবং মৌলবাদের চক্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তাহলে, নেতানিয়াহু এবং মোদিকে কি আধুনিকীকরণকারী বা মেরুকরণকারী হিসাবে স্মরণ করা হবে? তাদের কি জাতীয় পুনরুজ্জীবনের স্থপতি হিসাবে দেখা হবে নাকি গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের এজেন্ট হিসাবে দেখা হবে? যদিও তাদের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সাফল্য অনস্বীকার্য, তাদের শাসনব্যবস্থার নিচেও ফাটল তৈরি হচ্ছে। এই ফাটল দেখা দিয়েছে গণতন্ত্র, নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং আইনের শাসনে।
এই শক্তিশালী ব্যক্তিদ্বয় প্রায়শই ভয় দেখিয়ে সুরক্ষা এবং গর্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উত্থান ঘটাতে মরিয়া। কিন্তু ক্ষমতার অন্বেষণে তারা যে ভিত্তি রক্ষা করার দাবি করে, সেগুলোকেই তারা ধ্বংস করে দিতে পারে। মোদি এবং নেতানিয়াহুর উত্তরাধিকার কেবল বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বা সামরিক বিজয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হবে না।
তারা যে সমাজ রেখে চলেছেন তা দিয়েই তাদের পরিমাপ করা হবে। তাদের রেখে যাওয়া সমাজ কি আরও ন্যায়সঙ্গত, আরও ঐক্যবদ্ধ এবং আরও শান্তিপূর্ণ ছিল নাকি আরও বিভক্ত, আরও যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং চিরকালের জন্য আগুনের কিনারায় ছিল তা দিয়ে পরিমাপ করা হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: