তিন দশক পর এওএল বন্ধ করলো ডায়াল-আপ ইন্টারনেট সেবা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৩ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৪৩

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

প্রায় তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারকারীদের টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করে রাখা আমেরিকান অনলাইন এওএল (AOL) অবশেষে তার ডায়াল-আপ মডেম সেবা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এই সেবা আর পাওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্প্রতি এক সহায়তাবার্তায় গ্রাহকদের এওএল বলেছে, ‘এওএল নিয়মিতভাবে তার পণ্য ও সেবাগুলোর মূল্যায়ন করে। সে অনুযায়ী, আমরা ডায়াল-আপ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি আর কোনো এওএল প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে না।’

ডায়াল-আপ সেবার পাশাপাশি ওই দিনই এওএলের ‘ডায়ালার সফটওয়্যার’ ও ‘এওএল শিল্ড ব্রাউজার’ সফটওয়্যারও বন্ধ যাচ্ছে। ডায়ালার সফটওয়্যারটি কম্পিউটারের সঙ্গে এওএল নেটওয়ার্কের সংযোগ স্থাপন করত, আর শিল্ড ব্রাউজার ছিল পুরোনো অপারেটিং সিস্টেম ও ধীরগতির সংযোগের জন্য তৈরি এক বিশেষ ব্রাউজার।

এওএলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালে ‘আমেরিকা অনলাইন’ নামে একটি বদ্ধ বাণিজ্যিক অনলাইন সেবা হিসেবে। এর মূল শিকড় ছিল ১৯৮৫ সালে কমোডর কম্পিউটারের জন্য চালু হওয়া কোয়ান্টাম লিংক নামক ডায়াল-আপ সেবায়। যদিও শুরুর দিকে এওএল ইন্টারনেট অ্যাকসেস দিত না; ব্যবহারকারীরা কেবল এওএলের নিজস্ব কনটেন্টেই প্রবেশ করতে পারতেন।

১৯৯৪ সালে এওএল যখন প্রকৃত ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সুযোগ দেয়, তখন ওয়েবসাইট ছিল ক্ষুদ্র, ছবিগুলো ছিল কমপ্রেসড আর ভিডিও দেখা ছিল প্রায় অসম্ভব। এওএল নিজে যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ওয়েবের পরিধিও। ২০০০-এর দশকের শুরুতে এর গ্রাহকসংখ্যা ২৫ মিলিয়নেরও বেশি ছিল। তবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিস্তারে এই সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।

২০২২ সালের জনসংখ্যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখনো প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার পরিবার ডায়াল-আপ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। সাধারণত তারা গ্রামীণ এলাকায় বাস করে, যেখানে ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো নেই বা স্থাপন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

এই ব্যবহারকারীদের জন্য বিকল্প সীমিত। বর্তমানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন প্রায় ২০-৩০ লাখ নাগরিক। এটি ডায়াল-আপের তুলনায় দ্রুত হলেও উচ্চ লেটেন্সি ও ডেটা ক্যাপের সমস্যায় ভোগে। অধিকাংশ ব্যবহারকারী এখন ডিএসএল, ক্যাবল বা ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা তুলনামূলক আধুনিক কিন্তু গ্রামাঞ্চলে পৌঁছানো কঠিন।

ডায়াল-আপের টিকে থাকা বাস্তবতাই দেখিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে ডিজিটাল বৈষম্য কতটা প্রকট। শহরের মানুষ যেখানে গিগাবাইট গতির ইন্টারনেট পান, সেখানে গ্রামের কেউ কেউ এখনো ১৯৯৫ সালের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।

একটি ডায়াল-আপ সংযোগ যেখানে মাত্র ৫৬ কিলোবিট প্রতি সেকেন্ড গতি দিতে পারে, সেখানে আজকের ফাইবার অপটিক সংযোগের গড় গতি ৫০০ মেগাবাইটস প্রতি সেকেন্ড- প্রায় ৯ হাজার গুণ বেশি। একটি উচ্চ রেজল্যুশনের ছবি যেখানে ব্রডব্যান্ডে তাৎক্ষণিক লোড হয়, সেখানে ডায়াল-আপে তা লোড হতে লাগে কয়েক মিনিট। একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ডাউনলোডে সময় লাগে প্রায় পুরো দিন।

যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য ডায়াল-আপ সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে উঠেছিল। ডায়াল-আপ মানেই ছিল এক নির্দিষ্ট রুটিন- ‘কানেক্ট’ বোতামে ক্লিক, তারপর ফোন নম্বর ডায়াল করার আওয়াজ, এরপর বিচিত্র এক শব্দের সুর, যা জানিয়ে দিত আপনি এওএল সার্ভারে যুক্ত হতে যাচ্ছেন।

এই প্রযুক্তি ডিজিটাল সিগন্যালকে অডিও সিগন্যালে রূপান্তর করে ১৯শ শতকে তৈরি টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে পাঠাত। ফলে একই সময়ে ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করা যেত না- এটি বহু পরিবারের ঝগড়ার কারণও হয়েছিল!

এওএল যদিও ডায়াল-আপ আবিষ্কার করেনি, কিন্তু তারা এটিকে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। অন্য সেবাদাতাদের জটিল সেটিংসের বিপরীতে এওএল একটি মাত্র সফটওয়্যারেই সবকিছু সহজ করে দেয়। শুধু তাদের কোটি কোটি ছড়ানো সিডি-আরওএমের একটি কম্পিউটারে ঢোকালেই চলত!

এওএল শুধু ইন্টারনেট সংযোগই দেয়নি, বরং ডিজিটাল যোগাযোগ ও সামাজিকতার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। এওএলের ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার অনেককে প্রথম রিয়েল-টাইম চ্যাটের স্বাদ দেয়, এটি চ্যাটরুম গড়ে তোলে প্রাথমিক সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। এ ছাড়া ‘ইউ হ্যাভ গট এ মেইল’ বার্তাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ১৯৯৮ সালের একটি রোম্যান্টিক চলচ্চিত্রের নামও হয় এটি।

তবে নানা সমস্যাও ছিল। ২০১৫ সালে ৮৩ বছর বয়সী রন ডর্ফ নামের এক ব্যক্তি পান ২৪ হাজার ২৯৮ ডলারের ফোন বিল। কারণ তার এওএল মডেম ভুল করে একটি লং ডিস্ট্যান্স নম্বরে ডায়াল করছিল। এই সমস্যার অভিযোগ ২০০২ সালেই নিউইয়র্ক অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে জমা পড়েছিল।

মূল্য নির্ধারণেও ছিল বিভ্রান্তি। ২০০৬ সালে এওএল তাদের ডায়াল-আপ প্যাকেজের দাম বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৯০ ডলার করে দেয়, যা তখনকার ব্রডব্যান্ডের দামের সমান। অথচ ২০০৩ সালে একই কোম্পানি নেটস্কেপ ব্র্যান্ডে ১০ ডলারের একটি সেবা চালু করে। এই দ্বৈত কৌশল ব্যবহারকারীদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তোলে।

এওএল সেবা বন্ধ করলেও ডায়াল-আপ প্রযুক্তি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না। নেটজিরো, জুনো, ডায়ালআপ ৪ লেসের মতো ছোট প্রতিষ্ঠান এখনো ডায়াল-আপ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে ব্যাকআপ হিসেবে ব্যবহার করেন, কেউ আবার শুধুই ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিংয়ের মতো কম ব্যান্ডউইথের কাজেই ব্যবহার করেন।

এওএল হয়তো এত দিন সেবাটি বজায় রেখেছিল কেবল সেই কিছুসংখ্যক নির্ভরশীল ব্যবহারকারীর কথা ভেবেই। তবে একসময় এসে তাদের বুঝতে হয়েছে- পুরোনো প্রযুক্তি টিকিয়ে রাখার ব্যয় লাভের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।

ডায়াল-আপ ব্যবহারকারীদের সামনে এখন বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সময় মাত্র এক মাসের বেশি। কেউ কেউ স্যাটেলাইট বা মোবাইল ইন্টারনেটের দিকে যেতে বাধ্য হবেন, অনেকেই হয়তো ইন্টারনেটই হারাবেন। ফলে ডিজিটাল বৈষম্য আরও বাড়বে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: