
বিদেশি কোনো দেশের নির্বাচনের বিষয়ে এখন থেকে মন্তব্য না করার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে নির্বাচনী ফলাফলে বিদেশনীতির ‘স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ’ কোনো স্বার্থ জড়িত থাকলে ব্যতিক্রম হতে পারে। এ তথ্য জানিয়ে বৃহস্পতিবার বিশ্ব জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সকল দূতাবাস ও কনস্যুলেটকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আওতায় এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যার মূল কথা হলো- বিদেশি জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন থেকে প্রশাসনের সার্বভৌমত্বকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিদেশনীতি সংশ্লিষ্ট স্বার্থে নির্বাচন সম্পর্কে প্রকাশ্য মন্তব্য করা যাবে।
গত কয়েক দশক ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ব্যাপারে কড়া সমালোচনামূলক বিবৃতি দিয়ে আসছিল। তবে নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে এমন বিবৃতিগুলো সংক্ষিপ্ত, নিরপেক্ষ ও কেবল বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানানো এবং প্রয়োজনে পারস্পরিক বৈদেশিক স্বার্থের কথা উল্লেখ করে সীমিত থাকবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা প্রকাশ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, বৈধতা বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে মন্তব্য পরিহার করতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ, কার্টার সেন্টার, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট বা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের মতো সংস্থার প্রতিবেদনের আলোকে নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে এখন আর মন্তব্য করতে পারবে না। তবে ওয়াশিংটনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে অনুমোদন করলে এর ব্যতিক্রম হতে পারে।
এই নীতিগত পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারই একটি অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও সুশাসনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানবাধিকার কর্মী ও গণতন্ত্র প্রচার সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই এই পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারী সরকারগুলোকে আরও উৎসাহিত করবে এবং বিশ্ব জুড়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ভূমিকা দুর্বল করবে। এর আগে গত ১৮ই মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার শব্দটির সংজ্ঞা রদবদল করে, যার মাধ্যমে ‘মানবাধিকার’-এর প্রচলিত ও স্বীকৃত সংজ্ঞা কার্যত সংকুচিত করা হয়েছে।
নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্বল কারাগার পরিস্থিতি, সরকারি দুর্নীতি বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বিধিনিষেধের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হবে না। এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো কর্তৃক শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বন্ধ করা, স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা; কিংবা রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলো আর বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হবে না।
স্থানীয় গণমাধ্যম এনপিআর-এর নিকট ফাঁস হওয়া স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক মেমো এবং আরও কিছু নথি থেকে জানা যায় যে, ওই সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয় যাতে তারা বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলো ‘সরাসরি ন্যূনতম আইনি প্রয়োজনীয়তা’র মধ্যে সীমিত রাখেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনগুলো সাধারণত প্রতি বছর মার্চ বা এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। তবে ২০২৪ সালের প্রতিবেদন ২০২৫-এর জানুয়ারিতে প্রস্তুত হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নির্দেশ অনুযায়ী সম্পাদনার কারণে সেগুলোর প্রকাশ বিলম্বিত হয়ে মে মাস পর্যন্ত পিছিয়ে যায়।
নতুন সম্পাদিত প্রতিবেদনগুলো থেকে বৈচিত্র্য, সমতা এবং অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গসহ সমকামী জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য প্রসঙ্গও বাদ দেয়া হচ্ছে। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, প্রতিবন্ধীদের ওপর সহিংসতা, ইন্টারনেট স্বাধীনতা হ্রাস, এলজিবিটিকিউ অধিকার এবং মানবাধিকার সংস্থার হয়রানি-সবকিছুই বাদ পড়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা এই পরিবর্তনগুলো উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক পল ও’ব্রায়েন তখন বলেন, ‘এই পরিবর্তনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যেন বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার রক্ষায় তাদের নেতৃত্বের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।’
বিগত মে মাসে মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তনের পর গতকাল বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চুপ থাকার এই সিদ্ধান্ত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ফ্রিডম আর লিবার্টি কেন্দ্রিক ‘আমেরিকান আইডিয়া’কেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিলো।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: