পর্ব - ৫
তিন দিন তিন রাত্রি যখন কন্যা জলস্পর্শও করিল না, তখন পিতা পালকি করিয়া কন্যাকে রসুলপুরে পাঠাইয়া দিয়া পুণ্য করিবার মানসে মক্কা যাত্রা করিলেন। আরিফও সেই দিন সকালে কলিকাতা হাসপাতাল হইতে মোটরযোগে বাড়ি ফিরিয়াছে!
আশ্চর্য! সে বাড়ি ফিরিয়া কিন্তু পিতা-মাতাকে কিছু বলিল না। এই তিন দিন ধরিয়া সে মৃত্যুর সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে অনেক কিছু ভাবিয়াছে। পিতা শুনিলে, তাহাদের খুন করিতে ছুটিবেন। তাহারা তো মরিবেই, তাহার পিতাকেও সে সেই সাথে হারাইবে। জোহরাও আত্মহত্যা করিবে!
জোহরা! জোহরা! ওই তিনটি অক্ষরে যেন বিশ্বের মধু সঞ্চিত! সে মৃত্যুকে স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, দৈবকে ভিন্ন কাহাকেও সে দোষী করিবে না। বাহিরেও না, অন্তরেও না।
সে তখনও জানে না যে, সে আবার বাঁচিয়া ফিরিয়াছে! আর কাহাকে সে অপরাধী করিবে? তাহারা যে তাহারই প্রিয়তমার পরমাত্মীয়! বাঁচিয়া উঠিয়া সে যেন নবজীবন লাভ করিয়াছে। এ যেন তার আর এক জন্ম! মৃত্যুর স্পর্শ তাহাকে সোনা করিয়া দিয়াছে।
পুত্রের মুখ দেখিয়া পিতামাতা চমকাইয়া উঠিলেন, ‘একী, এমন নীল হয়ে গেছিস কেন? একী চেহারা হয়েছে তোর?’
আরিফ শান্তস্বরে বলিল, ‘কলেরা হয়েছিল, এশিয়াটিক কলেরা। বেঁচে এসেছি এই যথেষ্ট।’
পিতা-মাতা পুত্রকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। শত দরিদ্রকে ডাকাইয়া দান খয়রাত করিলেন। সন্ধ্যায় বাড়িতে মউলুদ শরিফের ব্যবস্থা করিলেন।
তখনও সূর্য অস্ত যায় নাই, এমন সময় বাড়ির দ্বারে আসিয়া জোহরার পালকি থামিল।
জোহরা পালকি হইতে মৃত্যু-পাণ্ডুর মুখে নামিতেই সম্মুখে আরিফকে দেখিয়া চিৎকার করিয়া তাহার পায়ে পড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘তুমি এসেছ –বেঁচে ফিরে এসেছ?’
বলিতে বলিতে সে মূর্ছিতা হইয়া পড়িল। সকলে ধরাধরি করিয়া তাহাকে ভিতরে লইয়া গেলেন। মূর্ছা ভাঙিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলে, আরিফের পিতা-মাতা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘তোরা দু-জনই কি মরতে মরতে ফিরে এলি?’
মাতা কাঁদিতে লাগিলেন, ‘আমার সোনার প্রতিমার কে এমন অবস্থা করলে!’
আরিফ জোহরাকে নিভৃতে ডাকিয়া সমস্ত কথা খুলিয়া বলিল। জোহরা স্বামীর পায়ে মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল, ‘না, না, তুমি শাস্তি দাও। তোমরা আমায় ঘৃণা করো, মারো!’
আরিফ জোহরার অধর দংশন করিয়া বলিল, ‘এই নাও শাস্তি!’
পর্ব - ৬
দুঃখ বিপদের এই ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও জোহরা তাহার পদ্ম-গোখরোর কথা ভোলে নাই। এতদিন সে তেমনই নীরবে তাহাদের কথা ভুলিয়া আছে, যেমন করিয়া সে তাহার মৃত খোকাদের ভুলিয়াছে! কিন্তু সে কি ভুলিয়া থাকা! এই নীরব অন্তর্দাহের বিষ-জ্বালা তাহাকে আজ মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত ঠেলিয়া আনিয়াছে। সে সর্বদা মনে করে, সে বেদেনি, সে সাপুড়ের মেয়ে! সে ঘুমে জাগরণে শুধু সর্পের স্বপ্ন দেখে। সে কল্পনা করে, তাহার স্বামী নাগলোকের অধীশ্বর, সে নাগমাতা, নাগ-রাজেশ্বরী!
বাড়িতে আসিয়া অবধি কাহাকেও পদ্ম-গোখরোর কথা জিজ্ঞাসা না করায়, শ্বশুর-শাশুড়ি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলেন, বউ ওদের কথা বোধ হয় ভুলিয়া গিয়াছে।
গভীর রাত্রে জোহরা স্বপ্নে দেখিতেছিল, তাহার মৃত খোকা দুইজন যেন আসিয়া বলিতেছে, ‘মা গো, বড়ো খিদে, কতদিন আমাদের দুধ দাওনি। আমরা কবরে শুয়ে আছি, আর উঠতে পারিনে! একটু দুধ! বড়ো খিদে!’ ‘খোকা’ ‘খোকা’ বলিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া জোহরা জাগিয়া উঠিল। দেখিল, স্বামী ঘুমাইতেছে। প্রদীপ জ্বালিয়া কী যেন অন্বেষণ বরিল, কেহ কোথাও নাই।
সে আজ উন্মাদিনী। সে আজ শোকাতুরা মা, সে পুত্রহারা জননী! তাহার হারা-খোকা ডাক দিয়াছে, তাহারা ছয় মাস না খাইয়া আছে।
পাগলের মতো সে দ্বার খুলিয়া বাহির হইয়া গেল। বাড়ির সম্মুখেই মির পরিবারের গোরস্থান। ক্ষীণ শিখা প্রদীপ লইয়া উন্মাদিনী মাতা দুইটি ছোট্ট কবরের পার্শ্বে আসিয়া থামিল। পাশাপাশি দুইটি ছোট্ট কবর, যেন দুটি যমজ ভাই – গলাগলি করিয়া শুইয়া আছে।
শিয়রে দুইটি কৃষ্ণচূড়ার গাছ, জোহরাই স্বহস্তে রোপণ করিয়াছিল। এইবার তাহাতে ফুল ধরিয়াছে। রক্তবর্ণের ফুলে ফুলে কবর দুইটি ছাইয়া গিয়াছে।
মাতা ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘খোকা! খোকা! কে তোদের এত ফুল দিয়াছে বাবা! খোকা!’
মূর্ছিতা হইয়া পড়িয়াছিল, না ওই কবর ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল – জানে না, জাগিয়া উঠিয়াই জোহরা দেখিল, তাহার বুকে কুণ্ডলী পাকাইয়া সেই পদ্ম-গোখরো-যুগল।
জোহরা উন্মত্তের মতো চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘খোকা, আমার খোকা, তোরা এসেছিস, তোদের মাকে মনে পড়ল?’ জোহরা আবেগে সাপ দুইটিকে বুকে চাপিয়া ধরিল, সর্প দুটিও মালার মতো তাহার কন্ঠ-বাহু জড়াইয়া ধরিল।
তখন ভোর হইয়া গিয়াছে।
জোহরা দেখিল পদ্ম-গোখরোদ্বয়ের সে দুগ্ধ-ধবল কান্তি আর নাই, কেমন যেন শীর্ণ মলিন হইয়া গিয়াছে। তাহারা বারেবারে জিভ বাহির করিয়া যেন তাহাদের তৃষ্ণার কথা, ক্ষুধার কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে, ‘মা গো বড়ো খিদে! তুমি তো ছিলে না, কে খেতে দেবে? একটু দুধ! বড়ো খিদে মা, বড়ো খিদে!’
জোহরা তাহাদের বুকে করিয়া ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, তখনও কেহ জাগিয়া উঠে নাই।
সে হেঁশেলে ঢুকিয়া দেখিল, কড়া-ভরা দুগ্ধ।
বাটিতে করিয়া দিতেই সাপ দুটি বুভুক্ষের মতো ঝাঁপাইয়া পড়িয়া দুগ্ধ পান করিতে লাগিল। যেন কত যুগযুগান্তরের ক্ষুধাতুর ওরা।
জোহরার দুই চক্ষু দিয়া তখন অশ্রুর বন্যা বহিয়া চলিয়াছে।
শাশুড়ি উঠিয়া বধূর কীর্তি দেখিয়া মূক স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন; বধূ তাঁহাকে দেখিতে পাইবামাত্র বলিয়া উঠিলেন, ‘ও মা, কী হবে, এ বালাইরা এ ছয় মাস কোথায় ছিল? যেমনই তুমি এসেছ, আর অমনই গায়ের গন্ধে এসে হাজির হয়েছে!’
জোহরা আহত স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘ষাট, ওরা বালাই হবে কেন মা? ওরা যে আমার খোকা!’
শাশুড়ি বুঝিতে পারিলেন না, হাসিয়া বলিলেন, ‘সত্যিই ওরা তোমার খোকা বউমা। তুমি চলে যাবার পর আমরা দু একদিন ওদের দুধ দিয়েছিলাম। ও মা শুনলে অবাক হবে, ওরা দুধ ছুঁলেই না! চলে গেল! সাপও মানুষ চেনে। কলিকালে আরও কত কী দেখব!’
সাপ দুইটি তখন বোধ হয় অতিরিক্ত দুগ্ধপানবশতই নির্জীবের মতো বধূর পায়ের কাছে শুইয়া পড়িয়াছিল।
পর্ব - ৭
সেইদিন সন্ধ্যা-রাত্রিতে বাড়ির একজন দাসী চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ও মা গো, ভূতে ধরলে গো! জিনের বাদশা গো! জিন ভূত!’
বলিয়াই সে প্রায় অজ্ঞান হইয়া পড়িল। বাড়িময় ভীষণ হই চই পড়িয়া গেল।
আরিফের মাতা তখন আরিফকে ডাকিয়া বলিতেছিলেন, ‘হাঁ রে, বউমা যে আবার পোয়াতি, তা তো বলিসনি। ওর যে ব্যথা উঠেছে।’
আরিফ বলিতেছিল, ‘কিন্তু এখন তো ব্যথা ওঠার কথা নয় মা, মোটে তো সাত মাস!’
এমন সময় বাড়িময় শোরগোল উঠিল, ‘ভূত! ভূত! য়্যাদ্দাড়িওয়ালা ভূত!’
বাড়ির চাকর-চাকরানি সকলে বলিল, তাহারা স্বচক্ষে দেখিয়াছে – জ্যান্ত ভূত! আকাশে গিয়া তাহার মাথা ঠেকিয়াছে! বাড়ির মধ্যে আমগাছ-তলায় দাঁড়াইয়া আছে!
আরিফ, আরিফের মাতা লন্ঠন লইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। সত্যই তো কে যেন গাছতলায় প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া!
তাঁহাদের পিছনে পিছনে যে ভূত দেখিতে জোহরাও বাহির হইয়া আসিয়াছিল, তাহা কেহ দেখে নাই।
হঠাৎ ভূত চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘ওরে বাপরে, সাপে খেলে রে!’
জোহরা চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাবা তুমি।’ আরিফের মাতাও বলিয়া উঠিল, ‘য়্যাঁ বেয়াই?’
জোহরা তখন চিৎকার করিতেছে, ‘ও সত্যই ভূত।বাবা নয়, বাবা নয়, ও ভূত! ওকে মারো! মেরে বের করে দাও!’
হঠাৎ শুনিতে পাইল, ভূত যেন যষ্টি দ্বারা নির্দয়ভাবে কাহাকে প্রহার করিতে করিতে চিৎকার করিতেছে – ‘ওরে বাপরে সাপে খেয়ে ফেললে! আমায় সাপে খেয়ে ফেলল!’
জোহরা উন্মাদিনীর মতো তাহার শাশুড়ির লন্ঠন কাড়িয়া লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটিল – ‘ওগো আমার খোকাদের মেরে ফেললে! ওকে ধরো! ওকে ধরো!’
জোহরার সাথে সাথে সকলে আমগাছতলায় গিয়া দেখিল, ভূত সত্যই আর কেহ নয়, সে জোহরার পিতা। তাহাকে তাহাদের বাস্তুসাপ পদ্ম-গোখরোদ্বয় নির্মমভাবে দংশন করিতেছে এবং ততোধিক নির্মমভাবে সে সর্পদ্বয়কে প্রহার করিতেছে।
জোহরা একবার ‘খোকা’ এবং একবার ‘বাবা’ বলিয়াই মূর্ছিতা হইয়া পড়িল।
জ্ঞান হইলে জোহরা আরিফকে ডাকিল। সকলে সরিয়া গেলে, সে জিজ্ঞাসা করিল- ‘আমার খোকারা কই? আমার পদ্ম-গোখরো? আমার বাবা?’
আরিফ কাঁদিয়া বলিল; ‘জোহরা! জোহরা! কেউ নেই! সব গেছে! সকলে গেছে! তোমার বাবা মরেছেন পদ্ম-গোখরোর কামড়ে!
‘তোমার মা মারা গেছেন কলেরা হয়ে। ওঁরা মক্কা যাচ্ছিলেন। তোমার মা রাস্তায় মারা গেলে, তোমার বাবা অনুতপ্ত হয়ে তোমায় শেষ দেখা দেখতে আসেন লুকিয়ে। লুকিয়েই হয়তো তোমায় দেখে চলে যেতেন। এমন সময় চাকরানি দেখতে পেয়ে ভূত বলে চিৎকার করে! ঠিক সেই সময় তোমার পদ্ম-গোখরো তাঁকে তাড়া করে!’
জোহরা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ‘বেশ হয়েছে, জাহান্নামে গেছে ওরা! যাক। আমার পদ্ম-গোখরো – আমার খোকারা কোথায় বলো!’
আরিফ বলিল, ‘তোমার বাবা তাদের মেরে ফেলেছেন!’
জোহরা, ‘এ্যাঁ খোকারা নাই?’ বলিয়াই অজ্ঞান হইয়া পড়িল।
ভোর হইতে না হইতে গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল, মির সাহেবদের সোনার বউ এক জোড়া মরা সর্প প্রসব করিয়া মারা গিয়াছে।
সমাপ্ত
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: