যখন রাসূল সা: মদিনায় হিজরত করে একটা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, মুসলমানরা সে রাষ্ট্রের ছায়াতলে নিরাপদে স্বাধীনভাবে তাদের ইবাদত বান্দেগি করতে লাগলেন। কিছুটা আরাম আয়েশে বিনা বাধায় দিন যাপন করতে লাগলেন, তখন মক্কার সব মুশরিক তাদের শিকড় আমূলে উপরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো। মদিনার দিকে সেনাবাহিনী প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নিলো মক্কার মুশরিকরা। তাদের বাড়িঘরে গিয়ে সমূলে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ নিলো এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করল।
তখন তাদের কবি ও সাহিত্যিকরা তাদের কবিতা ও সাহিত্যকে রাসূল ও ইসলামের কুৎসা এবং নিন্দায় ব্যবহার করতে আরম্ভ করল। তারা এর মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত হতে ইচ্ছুক লোকগুলোকে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে চাইল। কারণ বিভিন্ন কাফেলা কবিতাগুলো নানা দিকে নিয়ে যাবে, ফলে তা বিভিন্ন গোত্রের কাছে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা হবে। কারণ তারা ইসলাম গ্রহণ করলে এ কবিগণ তাদের বিরুদ্ধে ইজ্জত ও সম্মান হানিকর নিন্দামূল কবিতা লিখবে।
এ অবস্থা দেখে নবী সা: তাঁর আনসারী সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘যারা রাসূল সা:-কে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে তারা কি পারে না তাকে তাদের মুখের ভাষা তথা কবিতা দ্বারা সহযোগিতা করতে?
এ কথা শুনে হাসসান রা: এগিয়ে এসে বললেন, হে আল্লার রসূল! আমিই আপনাকে আমার কবিতা দিয়ে সহযোগিতা করব। তখন নবী সা: তাকে বললেন, তুমি আবু বকরের কাছে যাও, তিনি তোমাকে তাদের বংশপরিচয় তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ইত্যাদি বিষয়ে জানাবেন। তা জেনে তুমি তাদের কুৎসা ও নিন্দাগাথা রচনা করবে। আর জিবরিল তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। [আবুল ফরজ ইস্পাহানি, আল আগানী, (কায়রো : দারুল কুতুব আল মিসরিয়্যা।) খ. ৪, পৃ. ১৩৭; ইবনে আবদুল বার, আল ইস্তিয়াব ফি মা’রিফাতিল আসহাব, তাহকিক : আলী মুহাম্মদ বাজাবী, (কায়রো : দারু নাহদাতি মিসর লিততিবাআ ওয়ান্নাশরি, তা. বি.) খ. ১ পৃ. ৯৪]
অতঃপর হাসসান ইবনে সাবেত এগিয়ে আসেন তার কবিতা দ্বারা নবী সা: ও ইসলামকে সহযোগিতা করার জন্য। তার সাথে সম্পৃক্ত হন কবি কা’ব বিন মালেক ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। এই তিনজনের উদ্যোগে কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে অনেক কবিতা লিখিত হয়। সে সময় ইসলামের মহত্ব এবং ইসলামী আকিদার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে অনেক কবিতা লেখা হয়। তাতে জনগণকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আর যারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের মুখোশ খুলে দেয়া হয়। [মুহম্মাদ ওসমান, সাদা আল আদাব আল আরবি ফিদ্দাওয়া আল ইসলামিয়্যা, মাজাল্লাতু কুল্লিয়াতিদ দাওয়া আল ইসলামিয়্যা, সংখ্যা : ৩০, ১৯৮৬ খ্রি. লিবিয়া।) পৃ. ১৭-১৯]
কবিতার পাশাপাশি গদ্য সাহিত্যও ইসলামের সেবায় এগিয়ে আসে ইসলামের একেবারে প্রথম যুগ থেকেই। রাসূল সা: নিজে তাঁর দাওয়াতি বক্তৃতাগুলো গদ্য ভাষায় দিতে থাকেন। হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে তার হাদিসগুলোর সাথে সাথে তার অনেক খুৎবা বা বক্তৃতাও সঙ্কলিত হয়। এসব বক্তৃতার সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্য কারো কাছে অবিদিত নয়। নবী সা: মদিনায় হিজরত করে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গদ্য ইসলামের সেবায় নতুন মোড় নেয়। কখনো বক্তৃতা ওয়াজ নসিহত, আবার কখনো বিভিন্ন গোত্রও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পত্র ও চিঠির মাধ্যমে, আবার কখনো রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তিপত্র লিখনের মাধমে। আবার কখনো তার কিছু কিছু হাদিস তার কোনো সাহাবিদের জন্য লিখার মাধ্যমে। [প্রাগুক্ত পৃ. ২৭-৩১]
সাহাবাদের যুগেও সাহিত্য ইসলামের সেবায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। ইসলাম বিরোধীদের বিরোধিতার প্রতিবাদ করে তাদের উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন করেছে। দায়ী মুবালিগদের উৎসাহ দান করেছে মুজাহিদদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। সাহাবারা কঠিন মুহূর্তে সাহিত্যকে উত্তম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কারণ সাহিত্য হলো মানব মনে প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি অন্যতম শিল্প। কাদেসিয়া যুদ্ধের সময় মুসলিম সেনা অধিনায়ক সা’দ ইবন আবু ওযাক্কাস আল কুরআনের কারী বুদ্ধিজীবী এবং গণ্য-মান্য মুসলিম নেতাদেরকে মুসলিম সৈনিকদের সামনে নিয়ে আসেন। কেবল তাদের নিয়ে এসেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের সাথে কবি ও বক্তাদেরও নিয়ে আসেন এবং তারা যুদ্ধকালে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কবিতা পাঠ করেন ও বক্তৃতা শোনান। এসব কবির মধ্যে শাম্মাহ ও খুতাইয়্যা ও আউছ ইবনে মা’যা এবং আবদু ইবনে তৈয়বও ছিলেন। তিনি তাদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যান।
তাদের সেখানে পাঠানোর আগে বলেন, আপনারা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধের সময় আপনাদের ও তাদের জন্য যা কল্যাণকর তা শোনাবেন। আপনারা আরব জাতির কবি ও বক্তা। তাদের বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতি, আপনারা সৈনিকদের কাছে যান তাদের যুদ্ধ ও জিহাদ সম্পর্কে আপনাদের বক্তৃতা ও কথা শোনান, তাদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করুন। তখন তারা যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে তাই করলেন, একের পর এক কবি ও বক্তারা গিয়ে তাদের যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহ দিতে থাকলেন। হাফেজ ও কারীরা যুদ্ধ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শোনাতে থাকলেন। [তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, (ইস্তিকামা প্রকাশিত) খ. ৩, পৃ. ৫৩২]
সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস এ যুদ্ধে সাহিত্যকে যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন কারীদেরকে দিয়ে। তিনি কারীদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যাতে তারা সৈনিকদের কাতারে গিয়ে সূরা জিহাদ পড়ে শোনান। অথচ তখন সব মুসলমান সৈনিকেরই সূরাটি মুখস্থ ছিল। তখন তারা সৈনিকদের সূরাটি পড়ে শোনালে সৈনিকদের মধ্যে একটা অন্য রকম আবেগ আবহ সৃষ্টি করে। তখন তাদের প্রথম কাতারের সৈনিকরা দ্বিতীয় কাতারের সৈনিকদের তা পড়ে শোনান। আর তারা তৃতীয় কাতারের সৈনিকদের পড়ে শোনান। এভাবে প্রত্যেক সৈনিক সূরাটি শুনে উদ্বুদ্ধ হন এবং তাদের হৃদয়ে ও মনে তার অসাধারণ প্রভাব পড়ে। [প্রাগুক্ত খ. ৩ পৃ. ৫৩৬]
এভাবেই সাহিত্য প্রত্যেক যুগেই ইসলামের কল্যাণে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং প্রতি ঘটনায় ইসলামের সঙ্গ দিতে থাকে; যা বিস্ময়কর। সাহিত্য নাস্তিক ধর্ম দ্রোহীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আল কুরআন সৃষ্টি কি না এ বিতর্কের সময় সৃষ্টি না হওয়ার পক্ষে সাহিত্য শক্ত অবস্থান নেয় এবং যা বলা আবশ্যক তাই বলতে থাকে। সত্যের পক্ষাবলম্বনকারীদের সহায়তায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
যেদিন মুসলামানদের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টানরা ক্রুসেড যুদ্ধারম্ভ করে সেদিনও সাহিত্য মুসলমানদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে এবং উৎসাহ প্রদান করে। মুসলমানদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করে।
তাতারিদের আক্রমণের সময়ও সাহিত্যের ভূমিকা কিছুতেই ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ের ভূমিকার চেয়ে কম ছিল না। এভাবেই সাহিত্য প্রত্যেক যুগে তার ভূমিকা পালন করেছে ইসলামের পক্ষে, ইসলামের সেবায় এবং প্রচার প্রসারের কাজে। [আবদুর রহমান রাফত আল পাশা, নাহবু মাযহাবিন ইসলামিয়্যিন ফিন নাকদি ওয়াল আদাব, ‘আল আদাবুল ইসলামি ফিকরাতুহু ওয়া মান্হাজুহু, খ. ৬২-৬৫]
সর্বাবস্থায় সাহিত্য ও ইসলামের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের ও হৃদ্যতার। রাসূল সা: নিজেই তাকে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করেছিলেন। অতঃপর সাহাবারা তাদের পরে অন্য মুসলমানরা তাকে ইসলামের খেদমতে ব্যবহার করেছেন। তাই ইসলাম কখনো সাহিত্য প্রসঙ্গে নেতিবাচক অবস্থান নেয়নি। তবে হ্যাঁ, ইসলাম তাকে প্রথম দিন থেকেই কিছু দিকনির্দেশনা দান করেছে। কিছু বিশ্বাসগত ও নৈতিক এবং চারিত্রিক উপদেশ দিয়েছে। সাহিত্যিকদের তা মানতে বাধ্য করেছে; যাতে সাহিত্য মানুষের জন্য কল্যাণকর হয় এবং জনহিতকর বিষয়ে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী বিষয়ে পরিণত হয়। ইসলামের এই নির্দেশনা ও আদেশ নিষেধ মেনে চলার কারণেই নবী সা:-এর যুগ হতে এমন এক ইসলামী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে যা যুগে যুগে জনহিতকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষের মনে বিশ^াস স্থাপনে, তাদের নৈতিকতা গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সেই সাহিত্যই হলো ইসলামী সাহিত্য।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: