ফিলিস্তিনি সাহিত্যের স্বরূপ

মুনা নিউজডেস্ক | ২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৫৯

ছবি : সংগৃহীত ছবি : সংগৃহীত

 

ফিলিস্তিনিদের পরিচিতি সারা বিশ্বময়। তার কারণ, তাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে করুণতম দুর্ভাগ্য। তারা ইসরাইলের আগ্রাসন ও জুলুমের শিকার। তাদের আর কোনো কিছুই ততটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি সকলের। ব্যতিক্রম কেবল সাহিত্য। ফিলিস্তিনিদের সাহিত্যঐতিহ্য বিস্ময়কর রকম সমৃদ্ধ, এবং বহুমুখী। যদিও বিশাল আরব জাতীয়তার মাঝখানে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে এর সংগঠন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার আগেই ভয়াবহ মানবতাবিরোধী উগ্র যায়নবাদী বর্বরতার সম্মুখীন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু অবিশ্বাস্য গতি এবং শক্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে ফিলিস্তিনিরা নির্মাণ করেছে তাদের নিজস্ব সাহিত্য ঐতিহ্য। অতীতে ফিলিস্তিন ছিল বৃহত্তর আরবভূমির অংশ। তার ভাষা বরাবরই আরবি। সুতরাং ‘ফিলিস্তিনিসাহিত্য’ বলে আলাদা কোনো সাহিত্যের অস্তিত্ব আগে ছিল না। ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসবাসকারীরা যেমন আরব হিসেবে পরিচিত হতো, তেমনি তাদের রচিত সাহিত্যও আরবি সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত হতো। ১৯৪৮ সালে উগ্র ইহুদীবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম এবং লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও ভিটেছাড়া করার মধ্যদিয়ে যে নতুন ইতিহাসের গতি লাভ করে, তার ফল হিসেবেই নতুনরূপে ‘ফিলিস্তিনি জাতি’র উদ্ভব হয় এবং এ-জাতির সাহিত্য আরবি হওয়া সত্ত্বেও ‘ফিলিস্তিনি সাহিত্য’ নামে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে। ফিলিস্তিনি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ফিলিস্তিনি জাতিগঠন এবং মুক্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

ফিলিস্তিনি সাহিত্য আরবি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে একটি। সাধারণত মিশরি সাহিত্য বলতে মিশরে রচিত সাহিত্যকে বোঝানো হয়। জর্দানি সাহিত্য বলতে জর্দানে রচিত সাহিত্যকে বোঝানো হয়। একইভাবে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সাহিত্যও একটি এলাকার সাথে সম্পর্কিত ছিল। ১৯৪৮ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনি সাহিত্য বলতে ফিলিস্তিনিদের রচিত সাহিত্যকে বোঝানো হয়, এর রচয়িতা যে দেশেই বসবাস করুক না কেন। ফিলিস্তিনি সাহিত্য বলতে আরবি ভাষায় ফিলিস্তিনিদের রচিত উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধসমূহকে বোঝানো হয়। তাই বলতে হয় ফিলিস্তিনি লেখকরা সাহিত্যের কোনো শাখাতেই পিছিয়ে নেই, বরং বিশাল আরবি ভাষাভিত্তিক সাহিত্যের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান আদায় করতে সমর্থ হয়েছে তারা। প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক এবং সঙ্গীত, সকল অঙ্গনেই সৃজনশীল, মেধাবী ও বহুজনপ্রিয় লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বহুল পঠিত ও জনপ্রিয়, আরবি ভাষাভাষীদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি ইংরেজী, জার্মান ও ফরাসীসহ অন্যান্য ভাষার পাঠকদের মাঝেও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। আরবি সাহিত্যে সমসাময়িক ফিলিস্তিনি সাহিত্যের বিশেষত্ব হলো, অত্যন্ত উচ্চস্তরের বিদ্রুপ, অস্তিত্ববাদ, মাতৃভূমির স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আত্মপরিচয়ের আলোচনা। দখলদারিতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, নির্বাসন, বিচ্ছেদ, শরণার্থী শিবিরের দুর্দশা, ইসরাইলের সন্ত্রাসী বর্বর হামলায় পরিবার হারানোর শোকগাথা, ইহুদীদের দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া নিজের বসত ভিটা-গ্রামের বর্ণনা, জন্মভূমির প্রতি আশা এবং ভালোবাসা ইত্যাদি ফিলিস্তিনি সাহিত্যের সাধারণ আলোচ্য বিষয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশেষ করে শিক্ষাসুবিধার সম্প্রসারণ এবং প্রিন্টিং প্রেসের প্রবর্তন ফিলিস্তিনি সাহিত্যের উত্থানকে উদ্দীপিত করে। আরব দুনিয়া জুড়ে এ-সময় যে আরবীয় জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে, যায়নবাদের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন একটা বিশেষ ধরনের স্থানীয় রূপ পরিগ্রহ করে। যায়নবাদীরা তখন পাশ্চাত্য শক্তির মদদে ফিলিস্তিনে একটা ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন চালাচ্ছিল। ওসমানীয় শাসনের শেষদিকে, উদারবাদী সংস্কারের পর, ফিলিস্তিনে অনেক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, যেমন: ১৯০৮ সালে হাইফা থেকে বের হয় আল কারমেল, ১৯১১-তে জাভা থেকে প্যালেস্টাইন এবং তারপরের বছর জেরুজালেম থেকে আদ্-দস্তুর। উগ্র যায়নবাদের বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হতো এসব দৈনিকে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের আগমনের পর ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের প্রতি তাদের সমর্থনজ্ঞাপক নীতি ও পদক্ষেপের প্রতিবাদ করত এ-পত্রিকাগুলো। ফিলিস্তিনি লেখকরা অন্যান্য আরব দেশের সাময়িকীগুলোতেও নিয়মিত লিখত এবং সে-সময় আরবজুড়ে সাধারণভাবে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যের যে-পুনর্জাগরণ চলছিল তাতে তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিত। রওভি ইয়াসিন আল-খালিদী (১৮৬৪-১৯১৩), নাজিব নাসার (১৮৬৫-১৯৪৮), মুহাম্মদ ইস’আফ আন্-নাশ্শাশিবি (১৮৮২-১৯৪৮) এবং খলিল আস্-সাকাকিনী (১৮৭৮-১৯৫৩) হচ্ছেন এ-সময়কার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সৃজনশীল গদ্যকার। তারা পাঠককে উপহার দেন আধুনিকমনস্ক স্টাইল ও আইডিয়া। এভাবে এদের হাতেই ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সাহিত্যের অভিযাত্রা শুরু হয়।
ঐতিহাসিকভাবেই কবিতা হচ্ছে ফিলিস্তিন এবং আরব দুনিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যপ্রকরণ। বিশ^ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইবরাহিম তুক্কান (১৯০৫-১৯৪১), আব্দুর রহিম মাহমুদ (১৯১৩-১৯৪৮) এবং আব্দুল করিম আল্-কারমি’র (১৯০৭-১৯৮০) মতো কবিরা ঐতিহ্যবাদী প্রেমের বিষয়ের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জাতীয়তাবাদী আবেগ, দুর্নীতিবাজ ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরব নেতাদের বিদ্রƒপ ও প্রত্যাখ্যান এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ও তার যায়নবাদ-প্রীতির তীব্র সমালোচনাকে কবিতায় যুক্ত করেন। ১৯৪৮ সালে উগ্র যায়নবাদীদের ফিলিস্তিন দখলের বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন কবি আব্দুর রহিম মাহমুদ। ফিলিস্তিনি লেখকরা যে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং মৃত্যু অথবা বন্দিত্বকে অঙ্গীকার করেন সেই দীর্ঘ ঐতিহ্যের শুরু তার থেকেই।

তারপর ফিলিস্তিনি সাহিত্য একটি স্পষ্ট বাঁক নেয় ১৯৪৮ সালের নাকবার পরে। নাকবা বলতে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইল রাষ্ট্রের উত্থান এবং তার ফল হিসেবে ফিলিস্তিনি সমাজের ধ্বংস ও ছিন্নভিন্ন হওয়াকে বোঝায়। গদ্য এবং পদ্য উভয় প্রকরণেই নির্বাসনের নিদারুণ মনস্তাপ প্রতিফলিত হতে থাকে ফিলিস্তিনি সাহিত্যিকদের লেখায়। তবে ১৯৪৮ সালের নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের বেশ আগে থেকেই ফিলিস্তিনি সাহিত্য ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৪৮ সালের এই বিপর্যয় সাত লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে বসতবাড়ি থেকে ভিটেছাড়া করে সন্ত্রাসী উগ্র যায়নবাদী ইহুদীরা। অন্যদিকে ১৯৪৮ সালের পর ইসরাইলের দখলদারিত্বে বসবাস করতে থাকে অনেক ফিলিস্তিনি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, ইসরায়েলি অস্তিত্বের প্রথম আঠারো বছর তাদের বাস করতে হয় সামরিক শাসনের অধীনে। তাদের এই বন্দিত্ব ও পরাধীনতার বোধের কথাও উঠে আসে বিকাশমান সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের মধ্য দিয়ে।


১৯৬৭ সালে ইসরায়েল নতুন করে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই নিষ্ঠুর সামরিক দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনি লেখকদের অধিকতর বক্তব্যধর্মী সাহিত্যের দিকে ঠেলে দেয়। ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’ নামে নতুন একটি ধারাও গতিমান হয়। এর মূল সুর ছিল একদিকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের যথার্থ্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও গৌরবগাথা, অন্যদিকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরোধিতাকে উচ্চকিত করা। প্রতিরোধ সাহিত্যের মূল মাধ্যম ছিল কবিতা। নাকবা-পরবর্তী লেখায় ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তার সামরিক দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসরত এবং অন্যত্র নির্বাসিত ও শরণার্থী জীবনযাপনকারীসহ সকল শ্রেণির ফিলিস্তিনির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। এ-সময় আরেকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতর হয়, সেটা হলো নারী লেখকদের উত্থান। নারী লেখকরা জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে নারী-স্বাধীনতাকেও সম্পৃক্ত করে। তারা মূলত ছোটগল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমেই সক্রিয় হয়। ফাদওয়া তুক্কান (১৯১৭-২০০৩) এদের প্রধান পূর্বসূরি। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। তিনি সুস্পষ্টরূপেই জাতীয়তাবাদী কবিতা লিখেছেন, তবে প্রেম ও যৌনতার কথাও লিখেছেন প্রকাশ্যে। নাবলুসে জন্মগ্রহণকারী সাহার খলিফেহ (১৯১১-) ফিলিস্তিনি উপন্যাসিকদের পূর্বসূরি এবং অধিকৃত এলাকায় বসবাসকারী লেখকদের মধ্যে অন্যতম সফলকাম সাহিত্যিক। তার ছয়টি উপন্যাস পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়াইল্ড থর্ন’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে। এতে ইসরাইলী সামরিক দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিদের যাপিত জীবনের সূক্ষ্ম ও শিল্পীত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। খলিফেহ লেখেন শক্ত নারীবাদী আবেগ নিয়ে, ফিলিস্তিনি এবং বৃহত্তর আরব সমাজের পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এই যুক্তি দেখিয়ে যে, নারীমুক্তি হলো জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ইসরাইলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদেরও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম এমিলি হাবিবি (১৯২১-১৯৯৩), তওফিক জাইয়াদ (১৯২৯-১৯৯৪) এবং আন্তন শাম্মাস। ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনের অবশিষ্টাংশ ইসরাইল কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রায় কুড়ি বছরের বিচ্ছেদের পর পশ্চিম তীর ও গাজা নিবাসীদের সঙ্গে ইসরাইলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের যে ‘পুনর্মিলন’ সংঘটিত হয় তার মর্মভেদী চিত্র এঁকেছেন এমিলি হাবিবি তার সেক্সটেট অব দ্য সিক্স ডেইজ (১৯৬৯) উপন্যাসে। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তার রচনা দ্য সিক্রেট লাইফ অব সাঈদ দ্য পেস্অপটিমিস্ট ও দ্য সিক্রেট লাইফ অব সাঈদ দ্য ইল ফেটেড পেস্অপটিমিস্ট দ্য সিক্রেট লাইফ অব সাঈদ দ্য পেস্অপটিমিস্ট উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়ের আরবি সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। আঙ্গিক উদ্যোগ এবং প্রভাব, উভয় বিবেচনাতেই। এতে মন্দ রস এবং প্রহসনের সংমিশ্রণে ইসরাইলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মর্মান্তিক অনিশ্চিত অবস্থার চিত্রায়ন করা হয়েছে। তওফিক জাইয়াদ একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’ ধারার কবি। তার লেখাপড়া মস্কোয়। তিনি ফিলিস্তিনি পাঠকদের রুশ সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তওফিক জাইয়াদ ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ইসরাইলের অবৈধ দখলে থাকা সবচেয়ে বড় ফিলিস্তিনি শহর নাজারেথের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে জেরিকোয় পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। সন্দেহ করা হয়, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ঘাতকরা পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে। নিউইয়র্ক প্রবাসী আন্তন শাম্মাস আরবি এবং হিব্রু উভয় ভাষাতেই সমান পারদর্শী। তার হিব্রু ভাষায় লেখা উপন্যাস এরাবেস্ক ইসরাইলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। উপন্যাসের থিম এবং ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর যায়নবাদের সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের উপস্থাপনা তো বটেই, তার হিব্রু রচনার নির্ভেজাল সৌন্দর্যও তার কারণ।

আরবি সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনি সাহিত্যেও কবিতা মানোত্তীর্ণ প্রকরণ হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে।। সে-তুলনায় ছোটগল্প ও উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছে অনেক দেরিতে। তবে মহাবিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা যে মহাদুর্ভোগ ও ক্ষতির জগতে পতিত হয়, তার ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা আগের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় সুলভ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে ছোটগল্প ও উপন্যাস ফিলিস্তিনিদের স্মৃতি এবং আত্মপরিচয়কে তুলে ধরার জন্য দ্রুত সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যমে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষেই ফিলিস্তিনে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার বিচ্ছিন্নতা এবং পরিণতিস্বরূপ জাতীয় উত্তরাধিকার হারানোর কারণে ফিলিস্তিনি সাহিত্যে ছোটগল্প ও উপন্যাস আধুনিক সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার গভীর বোধকে ধারণ করেছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি উপন্যাস এবং গল্প সাহিত্যের মূল লক্ষ্য ছিল ‘নিপীড়িতদের সাহিত্য’কে উপস্থাপন করার মাধ্যমে হতাশদের মনে আশার সঞ্চার করা। এই বৈশিষ্ট্য তিনটি ধারায় প্রবহমান হয়। প্রথমত, এতে হৃত বাসভূমির অতি-সৌন্দর্যায়ন এবং ‘পুরনো ফিলিস্তিন’কে পৃথিবীর অবিকল্প স্বর্গ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, আর পবিত্র মাতৃভূমির ভাবমর্যাদা উদ্ধার করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা দেখা যায়। যেমন: কথাশিল্পী ইবরাহিম জাবরা ঈসা ও মুসা আ:’কে ফিলিস্তিনি মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। গাসসান কানাফানি ‘মানবীয় ইচ্ছার সৌন্দর্য’ এবং ‘সুপারম্যানের মিথ’ থেকে সেঁচে বের করেছেন খাঁটি ফিলিস্তিনকে। দ্বিতীয় মাত্রাটি উদ্ভুত হয় প্রথমটি থেকে, সেটা হলো আসল আশীর্বাদপুষ্ট ‘পুরনো ফিলিস্তিন’ তার পবিত্রতা সমেত ফিরে আসবে ভবিষ্যতে এবং অতীতের মতোই সুখী ও সমৃদ্ধ হবে, এই স্বপ্নের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনাগত ভবিষ্যতের মধ্যে। তৃতীয় মাত্রাটি ওপরের দুটি বিষয়ের যোগফল। এর প্রকাশ দেশত্যাগ এবং আশ্রয়সন্ধানের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে এটা দারুণ ক্লেশের একটা অসুস্থ সময় যা ফিলিস্তিনিদের তেজস্বিতার পরীক্ষা নেয় এবং তারপর ঘোষণা করে তার আসন্ন বিজয়। এই পুরো ধারণাটি, যে কেউ বুঝতে পারবেন, সুস্পষ্টরূপে শুরু হয় পতনের সময়। তারপর সময় আসে ক্ষতি এবং ভোগান্তির, যা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায় নিষ্কৃতি এবং নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলার কালে। নির্বাসিত লেখকদের যখন অতিরিক্ত ‘ধর্মীয় আশাবাদে’ আস্থাশীল হতে দেখা যায়, যা তাদের অতীত এবং বর্তমানকে একসূত্রে গাঁথতে সাহায্য করে, তখন ইসরাইলি দখলদারিত্বের মধ্যে বসবাসকারীরা, যেমন এমিলি হাবিবি, পছন্দ করেন রূঢ় ও কুৎসিত ব্যঙ্গ, যা অতীতের জন্য কাতর কিন্তু একইসঙ্গে ফিসফিস করে বলে অতীত আর ফিরছে না।


ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এ্যাডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) শুধু বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদই নন, তিনি তার সাহিত্য সমালোচনা, নৃতত্ত্বচিন্তা এবং মধ্যপ্রাচ্য, ইসলাম ও সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমেও বিশ্বকে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছেন। তার মৌলিক গ্রন্থ ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮) উপনিবেশোত্তরবাদ পাঠের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপ করে ‘প্রফেসর অফ টেরর’ উপাধি লাভ করে। কবি মাহমুদ দারবিশ (১৯৪২-২০০৮) তার বিষয়, চিন্তা এবং আঙ্গিকবৈচিত্র্যের কারণে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। মাহমুদ দারবিশ, সন্দেহাতীতভাবে, সবচেয়ে নন্দিত কবি। অন্য যে কোনো ফিলিস্তিনি কবির তুলনায় তার রচনা সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে। ১৯৪২ সালে ফিলিস্তিনে জন্ম তার, ইহুদী সন্ত্রাসী বাহিনী হাগানার হামলার ভয়ে সপরিবারে পালিয়ে যান লেবাননে, বছরখানেক পরে গোপনে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। এসে দেখেন তার জন্মগ্রাম বিরওয়াকে ধ্বংস করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন ইহুদী বসতি। চোখের পলকে নিজের মাতৃভূমিতে হয়ে পড়লেন বহিরাগত। মাহমুদ সাংবাদিকতা শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় উনিশ বছর বয়সে। ১৯৭১ সালে স্থায়ীভাবে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনের সামাজিক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ততোদিনে ফিলিস্তিনের জাতীয় রাজনীতিতে তার সাহিত্যিক অবস্থান ও খ্যাতি গড়ে উঠেছে এবং পিএলও-র বিভিন্ন সাংস্কৃতিক শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন। অন্য আর সব ফিলিস্তিনি কবির মতোই, দারবিশের প্রথম দিককার কবিতায় প্রেম ছিল মূল প্রতিপাদ্য, কিন্তু দ্রুত তা জাতীয়তাবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। তবে এ দুটি ধারার মেলবন্ধন ঘটান তিনি এবং প্রায়শই তিনি ফিলিস্তিন হারানোর যন্ত্রণা এবং দয়িতা-বিচ্ছেদের কষ্টকে সমান্তরালে স্থাপন করেছেন। দারবিশ তার নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন রামাল্লাহ এবং জর্দানের আম্মানের মধ্যে আসা-যাওয়া করে।

সাঈদ এবং দারবিশের মতো গুটিকয়েক নাম বাদ দিলে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি সাহিত্যিকই একাধিক শিল্প-প্রকরণের চর্চা করেছেন। যেমন জাবরা ইবরাহিম জাবরা (১৯২০-১৯৯৪) উপন্যাস, কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখেছেন সমান দক্ষতায়। মুঈন বুসাইসু কবিতার পাশাপাশি নাটক লিখেছেন। বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি লেখক আরবি ভাষাতেই সৃষ্টিশীল থেকেছেন, কিন্তু জাবরা এবং সাঈদের মতো অনেকেই ইংরেজীসহ অন্য ভাষাতেও কাজ করেছেন। ইসরাইল-অধিকৃত এলাকায় বসবাসকারী অনেক ফিলিস্তিনি সাহিত্যিক আজকাল হিব্রু ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছেন। অনুবাদের মাধ্যমে, বিশেষত ইংরেজী ভাষায়, ফিলিস্তিনি সাহিত্য এখন বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিয়েছে। কবি, অনুবাদক, সম্পাদক ও শিক্ষাবিদ সালমা খাদরা জায়্যুসি (১৯২৭-) গত শতাব্দীর সত্তর দশকের মাঝামাঝি ‘অনুবাদ প্রকল্প’ গড়ে তুলে এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সাহিত্য ও লেখকদের বিশ্বপাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন। তার সম্পাদিত মডার্ন প্যালেস্টিনিয়ান লিটারেচার গ্রন্থে সন্নিবেশিত তার লেখা ভূমিকাটি এ বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।

অন্য নির্বাসিত প্রধান ফিলিস্তিনি লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক-উপন্যাসিক গাসসান কানাফানি (১৯৩৬-১৯৭২) এবং সাংবাদিক-কবি কামাল নাসের (১৯২৫-১৯৭৩)। গাসসান কানাফানির জন্ম ফিলিস্তিনের আক্কায়। ১৯৪৮ সালে পালিয়ে যান সিরিয়ায়। তিনি জাতিসংঘ সাহায্য সংস্থার অধীনে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করেন এবং জড়িত হন আরব ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টে গোটা আরব বিশ্বের রাজনৈতিক ঐক্যের জন্যে কাজ করত এই সংগঠনটি। পরে এর থেকে জন্ম নেয়া পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব ফিলিস্তিন (পিএফএলপি)-এ যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বৈরুতে থিতু হন এবং পিএফএলপি-র পত্রিকা আল্-হাদাফ সম্পাদনা করেন। তার লেখা কয়েকটি ছোট উপন্যাস বহুলভাবে প্রশংসিত হয়। নির্বাসিত ফিলিস্তিনি লেখকদের মধ্যে সাংবাদিক-উপন্যাসিক গাসসান কানাফানির সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস মেন ইন দ্য সান প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। এর মূল চরিত্র তিনজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী। তারা কাজের সন্ধানে গোপনে কুয়েতে ঢোকার চেষ্টা করে। এই প্রসঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আরব সরকারগুলোর দুর্ব্যবহার এবং তাদের বঞ্চনা-বোধের ছবি এঁকেছেন। গাসসান কানাফানির আরেকটা বহুল পঠিত উপন্যাস রিটার্নিং টু হাইফা। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসটি। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থীর পশ্চিম তীর থেকে হাইফায় তার নিজের পরিবারের কাছে ফিরে আসার কাহিনী এতে বর্ণিত হয়েছে। যদিও তিনি কখনোই পিএফএলপি-র সামরিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হননি, তবুও, ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে, ইসরাইলী সন্ত্রাসীরা তার গাড়িতে বোমা ফাটিয়ে গাসসান কানাফানিকে হত্যা করে।

কবি কামাল নাসের ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর রামাল্লাহ থেকে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করেন। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল কর্তৃক নির্বাসিত হওয়ার পর তিনি বৈরুতে চলে যান। সেখানে তিনি পিএলও’র নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং পিএলও’র পত্রিকা ফিলাস্তিন আৎ-তাওরা’র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তার কবিতাগ্রন্থ সিঙ্গিং ওন্ড্স বের হয়। কয়েক শ’ প্রবন্ধ ও কলাম লিখেন তিনি। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে নিজ এপার্টমেন্টে আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি। আততায়ী তার মুখের ভেতর বন্দুকের নল রেখে গুলী করে। ইসরাইলী ঘাতক বাহিনী মোসাদের তৎকালীন সদস্য, পরবর্তীকালে (১৯৯৮-২০০১) ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী, এহুদ বারাক নারীর ছদ্মবেশে এই অপারেশন চালিয়েছিল। নাসেরের মৃত্যুর পর, ১৯৭৪ সালে তার রচনাবলী দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়।

ফিলিস্তিন সাহিত্যের জগতে সাম্প্রতিককালের খুবই উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে একদল আমেরিকা প্রবাসী লেখকের উত্থান। এরা লেখেন ইংরেজীতে এবং সমকালীন বিষয় ও আঙ্গিককে আত্মস্থ করে। কবি ও নাট্যকার সুহাইর হাম্মাদ ১৯৭৩ সালে জর্দানের আম্মানে শরণার্থী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তার কবিতাগ্রন্থ বর্ন প্যালেস্টিনিয়ান, বর্ন ব্ল্যাক ফিলিস্তিনি। স্মৃতিকথা ড্রপ্স অব দিস স্টোরিতে এই মহিলা ব্রুকলিনে আফ্রো-আমেরিকান ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একজন প্রবাসীর জীবনবাস্তবতা ও অনুভূতির কথা তুলে ধরেন। নাথালি হান্দালও একজন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান মহিলা কবি ও নাট্যকার। আরব নারী কবিদের কবিতা নিয়ে একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেন তিনি। এখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নাওমি শিহাব নাঈ (জন্ম ১৯৫২) কবিতা, প্রবন্ধ ও গান লেখেন। এই মহিলা সাহিত্যিকের কুড়িটিরও অধিক মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে শিশুদের জন্য লেখা দুটি উপন্যাস সিত্তিজ সিক্রেট্স (১৯৯৪) এবং হাবিবি (১৯৯৭)।

ইবরাহীম ফাওয়ালের জন্ম রামাল্লায়। অন্যদের মতো ১৯৪৮ সালে তাকেও ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হয়। শেষ পর্যন্ত আবাস গাড়েন আমেরিকায়। সেখানে, বার্মিংহামের ইউনিভার্সিটি অব এ্যালাবামা এবং বার্মিংহাম সাদার্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন এখন। কাজ করেন চলচ্চিত্র নিয়েও ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস অন দি হিল্স অব গড। এই গ্রন্থটির ভিত্তি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং বিস্তৃত ঐতিহাসিক গবেষণা। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগের ফিলিস্তিনকে চিত্রিত করেছেন তিনি। একজন ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান তরুণ এই উপন্যাসের নায়ক, যুদ্ধের আগে দ্রুত পরিবর্তমান পরিবেশে সে বন্ধুত্ব ও প্রেম করতে চেষ্টা করে, এর সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর ত্যাগ ও স্থায়ী নির্বাসনের করুণ অভিজ্ঞতাকে সম্পর্কিত করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনি সাহিত্যিকরা খুব দ্রুত নানা বাঁক পেরিয়ে নিজস্ব সমৃদ্ধ সাহিত্য জগত নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। বৃহত্তর আররি সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের বিশাল দরবারেও নিজেদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে স্বতন্ত্র অবস্থান। ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা যেমন একেবারেই পৃথক আর সবার থেকে, একেবারেই নিজস্ব ধরনের, ফিলিস্তিনি সাহিত্যও তেমনি, বৈশ্বিক আঙ্গিক ও ঐতিহ্যকে আত্মসাত করে গড়ে উঠলেও, নিখাঁদ ‘ফিলিস্তিনি’ চারিত্র্য অর্জন করেছে। ফিলিস্তিনি সাহিত্যে ইতিহাস, রাজনীতি এবং সাহিত্য এমনভাবে পরস্পর জড়াজড়ি করে থাকে যে, তাদের আলাদা করা যায় না। এমনিতে, সাধারণভাবে আরবি ছোটগল্প ও উপন্যাস-নিপীড়ক শাসকদের আইন ভাঙার ইতিহাস বহন করে, যাদের পতন সম্প্রতি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। সেন্সরশিপ এড়াতে লেখকরা প্রায়শই রূপক এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলের আশ্রয় নিয়েছে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ নাগিব মাহফুজের কয়েকটি উপন্যাস। মানুষের জীবনের ওপর সরকারের প্রবল প্রভাবকে শনাক্ত করার এই প্রবণতাকে কখনো কখনো একটা বাধা হিসেবে গণ্য করা হয়, যা আরব লেখকদের অধিকতর কল্পনা এবং সাহিত্যিক ধরনের লেখার মধ্যে আটকে রাখে। কিন্তু ফিলিস্তিনি লেখকরা মনে করে, তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই, এবং তারা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছে, বাস্তবতাকে তারা সকল রূঢ়তাসমেতই উপস্থাপন করে।

বাস্তুচ্যুতি, নির্বাসন এবং পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নতা, তবে টিকে থাকাও শেষ পর্যন্ত, ফিলিস্তিনি গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইহুদীবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে তাদের স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অধিকার দিতে অস্বীকার করেছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা আনুমানিক ৬০ লাখেরও বেশি, এর মধ্যে ১৪ লাখের বেশির বসবাস ৫৮টি স্বীকৃত শরণার্থী শিবিরে। এগুলোর অবস্থিত জর্দান, লেবানন, সিরিয়া, গাজা পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে। সন্ত্রাসী ইহুদীরা অর্ধসহস্রাধিকের বেশি গ্রামকে ইসরাইল একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আর যেসব ফিলিস্তিনি কোনোরকমে থেকে যেতে পেরেছে ইসরাইলে (বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ) তারা টিকে আছে বৈষম্য এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে। ফিলিস্তিনি কথাশিল্পীরা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবিচারের সাক্ষ্য সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে তাদের গল্প ও উপন্যাসে তারা এটা করে চলেছে বিতর্ক, বিমূর্ত এবং আদর্শবাদের মধ্যে নিমজ্জিত না হয়ে। ফিলিস্তিনি সাহিত্যে মুখে মুখে গল্প বলার প্রথা দীর্ঘ অতীত থেকে প্রচলিত। কিন্তু আধুনিক কথাসাহিত্য অর্থাৎ ছোটগল্প ও উপন্যাসের চর্চা মূলত ১৯৪৮ সালের নাকবা-পরবর্তী ঘটনা।

কোনো ফিলিস্তিনি নিজেকে ‘একা’ ভাবে না। তাদের মধ্যে ‘আমি’ নেই, ‘আমরা’ই তাদের অস্তিত্বের প্রধান স্মারক। ফিলিস্তিনি লেখকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা আজ পর্যন্ত, তাদের দুঃখকে বহুবাচনিক উত্তমপুরুষে গঠন করে। কারণ, ফিলিস্তিনি জনগণের একটা সমষ্টিগত আখ্যান রয়েছে, সেটা এমন একটা গল্প যার শেকড় বিস্তৃত ইতিহাসের মধ্যে এবং সাধারণত তার শুরু ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণা অর্থাৎ ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ইউরোপীয় অঙ্গীকার থেকে। এই জাতির মানবিক অর্থে রয়েছে গল্পের ভাব, নির্বাসন, প্রতিরোধ এবং বাসভূমির থিমের মধ্য দিয়ে এগোনো বিচিত্র অভিযান ও গন্তব্যের গল্পের সম্ভার। এসব গল্প, যা অনবরত পুনরাবিষ্কৃত হয়ে চলেছে এবং যা এখনো ঘটমান, তার অবস্থান ‘সাধারণ মানবাধিকারে’র একেবারে কেন্দ্রস্থলে, যা থেকে বঞ্চিত ফিলিস্তিনি লেখকরা। এভাবে তারা রূপান্তরিত হয় ধ্বস্ত মানব অস্তিত্বে। ফিলিস্তিনি লেখকরা তাই কেবলই বর্ণনা করে চলেন নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সেই সূত্রে জাতিগত ধ্বংসের গল্প।

এছাড়া ফিলিস্তিনি সাহিত্য সারাবিশ্বে চলমান উৎপীড়ন এবং বৈষম্য সম্পর্কে কথা বলে। ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিক গাসসান কানাফানি, যিনি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্য পরিভাষাটি প্রথম ব্যবহার করেন, তিনি তার বইয়ে লিখেন, ‘আমি আমার গল্পগুলোর চরিত্রসমূহকে কোন ধরনের মনোভাব সংবরণ ছাড়াই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দিয়েছি’। ফিলিস্তিনি কবিদের লেখায়ও এই আন্তর্জাতিক একতাবোধ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ মাহমুদ দারবিশ, সামিহ আল কাসিম প্রমুখের কবিতার কথা বলা যায়। মোটকথা প্রায় শতবছরের ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামের কথা তাদের জীবন ও সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। অধিকাংশ সমালোচকই ফিলিস্তিনি সাহিত্যকে সাহিত্যিকদের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন: ১) ইসরায়েলের ভিতরে বসবাসকারীদের সাহিত্য ২) দখলিকৃত অঞ্চলের ফিলিস্তিনিদের সাহিত্য ৩) মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে (ফিলিস্তিনি ডায়াস্পরায়) অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের সাহিত্য। হান্নাহ আমিত-কোচাভি মাত্র দুটি ভাগ বা শাখাকে সমর্থন করেন: ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিতরে লেখা সাহিত্য এবং এর বাইরে লেখা সাহিত্য। এছাড়াও তিনি ১৯৪৮ সালের পূর্বে ও পরে রচিত সাহিত্যের মধ্যেও পার্থক্য আছে বলে মনে করেন। ২০০৩ সালে ঝঃঁফরবং রহ ঃযব ঐঁসধহরঃরবং জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে স্টিভেন সালাইতা ইংরেজি ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্ম নিয়ে গঠিত চতুর্থ আরেকটি শাখার কথা উল্লেখ করেন, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিনি অভিবাসীদের লেখা, যেগুলোকে তিনি ফিলিস্তিন বিষয়ে বিদেশে রচিত সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। গবেষক মরিস এবিলিনির মতে, ফিলিস্তিনিদের লেখা ইংরেজি সাহিত্যকে চতুর্থ শাখা মনে করা যথেষ্ট নয়। কেননা, ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমি থেকে স্থানচ্যুতির কারণে তাদের মধ্যে যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধুমাত্র আরবি ও ইংরেজিভাষী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। এ জন্য এবিলিনি একটি বহুভাষিক শাখা প্রস্তাব করেন, যে শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে ফিলিস্তিনি অথবা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূতদের লেখা ইংরেজি, ইতালীয়, ডেনিশ, হিব্রু এবং অন্যান্য ভাষায় লেখা সাহিত্যকর্ম। ফিলিস্তিনি সাহিত্য তীব্র রাজনৈতিক হতে পারে, যেমনটা জোর দিয়ে বলেছেন, সালমা খাদরা জায়ুসি এবং উপন্যাসিক লাইনা বদর, যারা ফিলিস্তিনিদের ‘সামষ্টিক পরিচয়’ এবং তাদের সংগ্রামের বিষয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশের কথাও উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কবি মউরিদ বারগউতি বলেন, কবিতা কোন সরকারি চাকুরে নয়, কোন সৈনিকও নয়, কবিতা কারো অধীনস্থ নয়। প্রাক ইসলামী যুগের ক্লাসিক রীতির কবিতা ফিলিস্তিনে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০ বছর আগেও স্থানীয় লোক সঙ্গীত আবৃত্তি করা প্রতিটি ফিলিস্তিনি শহরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। ১৯৪৮ সালের নাকবার পর কবিতা রাজনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে পরিণত হয়। যে সকল ফিলিস্তিনি ১৯৫২ সালের নাগরিকত্ব আইনের পর ইসরাইলের আরব নাগরিক হয়েছিলেন, তাদের কেন্দ্র করে প্রতিবাদী কবিতার একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যে ধারাটিতে মাহমুদ দারবিশ, সামিহ আল কাসিম এবং তওফিক আল জাইয়াদের মতো কবিরা সম্পৃক্ত ছিলেন। আরবদেশসমূহের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্কের অভাবে এ সকল কবির বেশির ভাগ কবিতাই অন্যান্য আরবদেশে অজ্ঞাত ছিল। ফিলিস্তিনি লেখক গাসসান কানাফানি লেবাননে নির্বাসিত হওয়ার পর ১৯৬৬ সালে তিনি সেখান থেকে ফিলিস্তিনি কবিদের কবিতা সংকলন প্রকাশ করলে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। পদকজয়ী কবি, নাট্যকার এবং লেখক নাতালি হানযালে অনেক লেখা বিভিন্ন কাব্যসমগ্র ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তার লেখা ১২ টি ভাষায় অনূদিত হয়। তিনি গবেষণা এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে সুপরিচিত হন। তিনি ঞযব চড়বঃৎু ড়ভ অৎধন ডড়সবহ শীর্ষক একটি কবিতা সমগ্র সম্পাদনা করেন, যেটি আরব মহিলা কবিদের পশ্চিমা বিশ্বের পাঠকদের নিকট পরিচিত করে তুলে। ফিলিস্তিনি কবিরা প্রায়ই তাদের হারানো মাতৃভূমির প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং প্রত্যাশা বিষয়ে কবিতা লিখে থাকে।

হেকায়াতি/গল্পকথন আরবিভাষী দেশসমূহের সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ। আরব্য রজনীর গল্পগুলো আরবি সংস্কৃতিতে কোনো ব্যতিক্রম নয়। ফিলিস্তিনের প্রতিটি ছোট শহর এবং গ্রামে ভ্রাম্যমাণ হেকায়াতি/গল্পকথকরা ভ্রমণ করে এবং তাদের জানা গল্পগুলে বলে। যে গল্পগুলো গল্পকথকরা একদা সব বয়সের শ্রোতাদের বলতেন, বর্তমানে সেগুলো ফিলিস্তিনি ডায়াসপরা থেকে শিশুতোষ বই হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে।

 

লেখক: মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
গবেষক, কলামিস্ট

সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: