সর্বজনীন বর্ষবরণের পর ঈদের উৎসবই এখন বাংলাদেশের প্রধানতম সাংস্কৃতিক প্রথা। ঈদ বাঙালি মুসলমানের বড় উৎসব। নানা পেশার নানা বয়সি মানুষ ঈদের জন্য যেমন সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে, তেমনি ঈদ সামনে রেখেই তাদের নতুন কাজের পসরা সাজান।
ঈদ সামনে রেখে চিত্রশিল্পী ছবি আঁকেন, শিল্পী বাঁধেন নতুন গান। অভিনেতা অভিনয় করে দর্শককে তাক লাগিয়ে দেন। নির্দেশক সর্বোচ্চ দিয়ে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র। ঔপন্যাসিক গল্প লেখেন দেশের জাতীয় দৈনিকে ছাপাবেন বলে। টেলিভিশন ও রেডিওতে চলে ৭ দিনব্যাপী ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠানমালা। পণ্য উৎপাদনকারীরাও তাদের নতুন পণ্যের প্রমোশনাল চালান ঈদকে ঘিরে। ঈদে নিজের অবয়ব বা গৃহে বাঙালি প্রস্তুতি নেয় নিজেদের সাধ্যমতো।
প্রায় একশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রকৃত ইতিহাসকার দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) তার সুবিখ্যাত বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছিলেন :
ব্রাহ্মণগণ প্রথমত ভাষাগ্রন্থ প্রচারে বিরোধী ছিলেন। কৃত্তিবাস ও কাশীদাসকে ইহারা ‘সর্বনেশে’ উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন এবং অষ্টাদশ পুরাণ অনুবাদকগণের জন্য ইহারা রৌরব নামক নরকে স্থান নির্ধারিত করিয়াছিলেন।/...আমাদেরবিশ্বাস, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।/মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতে আসুন না কেন, এদেশে আশিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হইয়া পড়িলেন। তাহারা হিন্দু প্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পাশে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল, মহররম, ঈদ, শবেবরাত প্রভৃতির পাশে^র্^ দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ ও মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এদেশে-বাস-নিবন্ধন বাঙালা তাহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল।
মুসলমানদের জন্য প্রধান ঈদ নিয়েই আমাদের অগ্রজ পথিকৃৎ কবিরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা।
কায়কোবাদের কবিতাটা তো কোনোভাবে ভুলতেই পারি না। কি অসাধারণ উচ্চারণ, ‘আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনপ্রাণ/ জাগায়ে মোসেøম যাবে গাহ আজি মিলেনের গান/ ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি/ জীবন সার্থক হবে, হইবে যে এ দরিদ্র কবি।’
গোলাম মোস্তফার চোখে ঈদের চাঁদটা কেমন? তিনি লিখেছেন এভাবে, ‘আজ নূতন ঈদের চাঁদ উঠেছে নীল আকাশের গায়/ তোরা দেখবি কারা ভাই-বোনেরা আয়রে ছুটে আয়/ আহা কতই মধুর খুবসুরাত ঐ ঈদের চাঁদের মুখ/ ও ভাই তারও চেয়ে, মধুর যে ওর স্নিগ্ধ হাসিটুক/ যেন নবীর মুখের হাসি দেখি ওই হাসির আভায়।’
চল্লিশ দশকের কবি ফররুখ আহমদের উচ্চারণে ঈদ এসেছে এভাবে, ‘আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এল ছবির মতন/ নতুন কিশতি বুঝি এল ঘুরে অজানা সাগর/ নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর/ আজ এ স্বপ্নের মধ্যে রাঙা মেঘ হল ঘনবন।’
শাহাদাত হোসেন তার ‘শাওয়ালের চাঁদ’ কবিতায় লিখছেন, ‘নিভে যাক, হাহাকার মহা-মহামার/বিশ্ব নিখিলের; ডুবে যাক প্রশান্তির/ গভীর অতলে; রূপ-রস গন্ধভারে/ দগ্ধসৃষ্টি হোক পুন ঋতুপর্ণা রূপা।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অজস্র গদ্যের পাশাপাশি আবার ‘রমজানের চাঁদ’ নিয়ে কবিতাও লিখেছেন, ‘পুনরাজ রমজানের এই অগ্রচর/ বসন্ত ঋতুর যথা দূত পিকবর/ অথবা এ বিধাতার শরীরিণী বাণী/ রোজাব্রত পালিবার যাকিছে সবায়/ কিংবা পাঠায়েছে এযে পূর্বে ঈদরাণী/ যেমনি পাঠায় ঊষা শুক্র তারকায়।’
ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা আমাদের জীবন রাঙাতে পারি, তবেই আমাদের ঈদ উৎসব স্বার্থক হবে। ঈদ এলে যেভাবে ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির ভেদাভেদ ভুলে যাই, সারা বছর সেই ভেদাভেদের দেয়ালকে উপড়ে ফেলতে হবে।
কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায়, ‘আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লাভিয়াছে হর্ষে/ আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়াছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে/ এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য, নিখিল মানবের মিলন জন্য/ শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।’
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় ঈদ-সংখ্যার প্রকাশ তাকে আরও একটু গতি দেয়। তবে কথাসাহিত্যে এই বাস্তবতার পুরোপুরি ছাপ যে পড়েনি, তাও স্বীকার করা ভালো। বাঙালি-মুসলমানের যে বিশিষ্ট জীবনযাপন, আমাদের তথাকথিত বাস্তববাদী কথাসাহিত্য তাকে অস্বীকার করে অনেক সময় এক কল্পিত বাস্তবতার দাবি তুলে এনেছে। কিন্তু তারপরও গত শতবর্ষ ধরে ঈদের কবিতা-গান-কথাসাহিত্য আমাদের ধর্মীয় আনন্দের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আনন্দকে একটু একটু করে মিশিয়ে তুলেছে। এই শতাব্দীর সূচনায় যার সূত্রপাত হয়েছিল, শতাব্দীর শেষে এসে দেখতে পাচ্ছি তার পরিণত রূপ। ঈদ ধর্মীয় উৎসব তো বটেই, আজ সাংস্কৃতিক উৎসবেও পরিণত হয়েছে। আমাদের গৃহ ও সাহিত্যকে খানিকটা হলেও আনন্দময় করে তুলেছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: