বিশ্বসভ্যতা বিকাশে আরবি ভাষা ও সাহিত্য

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৩১

গ্রাফিক্স গ্রাফিক্স

বিশ্বে মানবসভ্যতার বিকাশে আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। আরবি সাহিত্য প্রায় দুই হাজার বছরের বিশ্বসভ্যতা ও সংস্কৃতি, কৃষ্টিকালচার, জীবনবোধ ও ঐতিহ্যবোধের ধারকবাহক। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় আরবি সাহিত্যের অবাধ বিচরণে মুখরিত এই সাহিত্যকে আরো বহু গুণে সমৃদ্ধ করেছে। এজন্যই বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে আরবি সাহিত্য সগর্বে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।

পৃথিবীর বিশাল একটি অংশের মাতৃভাষা আরবি। তাদের কৃষ্টিকালচার জীবনবোধ সবকিছুই আরবি কে ঘিরে আবর্তিত। সেই জাহেলি যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান আধুনিক যুগ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সগৌরবে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বের বুকে টিকে রয়েছে আপন মহিমায়। প্রাচীন যুগে আরবি সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর এই আরবি ভাষার গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। যে কারণে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বব্যাপী মর্যাদার আসন অলংকৃত করে। ব্যাপক আকারে মানুষ এই ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন হয়।

আরবি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ব্যবহারিক ও রাষ্ট্রীয় ভাষা। পৃথিবীব্যাপী প্রায় ২৭.৩৯ কোটি মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে। এই ভাষায় কথা বলা জনসংখ্যায় দিক থেকে আরবি পৃথিবীর ষষ্ঠতম ভাষা। যার মধ্যে প্রধানত সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো প্রধানত আরবি ভাষায় কথা বলে থাকে। পৃথিবীতে বর্তমান ২২ দেশের রাষ্ট্রভাষা হলো আরবি। জাতিসংঘসহ পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার দাপ্তরিক ভাষা আরবি। মুসলমানদের পবিত্রগ্রন্থ কোরআন ও হাদিস আরবি হওয়ায় এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বর্তমানে অন্য মুসলিম দেশগুলোয় আরবি ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। তথ্য বলছে, আরবি ভাষা ও আল্ আরবিয়্যাহ্ বা আরবিয়্য সেমেটীয় ভাষা পরিবারের জীবন্ত সদস্যগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। এটি একটি কেন্দ্রীয় সেমেটীয় ভাষা এবং হিব্রু ও আরামীয় ভাষার সঙ্গে এ ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আধুনিক আরবিকে একটি ‘ম্যাক্রোভাষা’ আখ্যা দেওয়া হয়। এই আরবি ভাষা মূলত ২৭ রকমের উপভাষা থেকে এসেছে।

বিশ্বে ৪০ শতাংশ ভাষা এখন প্রায় বিপন্ন অর্থাৎ ২৮৯৫টি ভাষা পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে এবং অনেক এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে। তাই ভাষাকে একটি মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারণ ভাষার উদ্ভব হয়, বিবর্তন হয়, উন্নতি হয়, এমনকি সংকটেও পড়ে। আবার কখনো কখনো ভাষার মৃত্যুও ঘটে।

আরবি সাহিত্য বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্য। বিশ্বব্যাপী অনেক সাহিত্যের উত্থানপতন ঘটলেও আরবি সাহিত্য তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। আরবি সাহিত্য শব্দটি একটি যৌগিক শব্দ। প্রথমটি আরবি, যার প্রতি শব্দ আরবি। যা মূলত আরবি ভাষা হিসেবে পরিচিত। আর দ্বিতীয়টি হলো সাহিত্য যার আরবি প্রতিশব্দ আদব। শাব্দিক অর্থ ভদ্রতা, শিষ্টাচার, শিক্ষা, নৈতিকতা ইত্যাদি। এককথায় বলতে পারি সাহিত্য যেহেতু সমাজের দর্পণ; তাই তাতে নৈতিকতাবোধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। আর এই লেখনীর মাধ্যমে সমাজের সুখ-দুঃখ, সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়। বিশ্বের অন্যসব সাহিত্যের মতো আরবি সাহিত্য রচনা ও চর্চার কিছু উপাদান বা উপকরণ রয়েছে। আরবি সাহিত্যের সমলোচকরা ঐকমত্য পোষণ করেন, এই সাহিত্য রচনার মোট উপকরণ চারটি। প্রথমত, আবেগ-অনুভূতি। এটি যেকোনো সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপকরণ। দ্বিতীয়ত, খেয়াল বা কল্পনা। এটিও আরবি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। সাহিত্যকরা কল্পনাকে মৌলিক উপকরণ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন; যার কল্পনাশক্তি যত প্রখর, তার সাহিত্য রচনা তত আকর্ষণীয়। তৃতীয়ত, চিন্তা। একজন লেখক হওয়ার জন্য বা সাহিত্য রচনার জন্য বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তা অন্যতম উপাদান। একটি সাধারণ মানুষ কোনো একটি বিষয়কে যেভাবে দেখবে, ঠিক তার চেয়ে ভিন্নভাবে একজন সাহিত্যক সেটার দৃশ্যায়ন বা বিশ্লেষণ করবে। চতুর্থত, আকৃতি, তথা একজন সাহিত্যিক তার কল্পনা, চিন্তা ও আবেগকে কীভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করবে, সেটিই মূলত আকৃতি। এই চার মূল উপকরণকে পাথেয় করে প্রায় সব সাহিত্যচর্চা হয়। আরবি সাহিত্য তার ব্যতিক্রম নয়।

আরবি সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এই পথচলার ইতিহাসের সূতিকাগার হলো আরবি কবিতা। আরবি কবিতার ইতিহাস মানেই আরবি সাহিত্য। কবিতার মাধ্যমে আরবি সাহিত্যের পথচলা। প্রাচীনকালে আরব দেশে কোনো কণ্টকাকীর্ণ পথচলায় আরবি কবিতা অনুপ্রেরণা জোগাত। যুদ্ধের ময়দানে আরবি কবিতা বারুদের মতো কাজ করত। সৈনিকদের মানসিক শক্তি জোগাতে আরবি কবিতার কদর ছিল অপরিসীম। আবার কোনো আরবদের বিশেষ অনুষ্ঠান বা আনন্দদায়কের খোরাক জোগাত আরবি কবিতা। তবে কালের পরিক্রমায় আরবি সাহিত্যের ইতিহাসকে সাহিত্যিকরা পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।

প্রথমত জাহেলি যুগ। এই যুগের সঠিক সময় নির্ধারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। তবে অনেকেরই মতে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামের আবির্ভাব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কে জাহেলি যুগ বলা হয়। তবে অনেকের মতে, জাহেলি যুগ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিধি আনুমানিক ১৫০ বছর। যার ব্যাপ্তিকাল ছিল ৫০০ খ্রিস্টাব্দ বা তার কিছু পূর্ব থেকে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। জাহেলি যুগের সবচেয়ে বেশি কবিতা চর্চা হতো এবং কবিদের তাদের গোত্রে আলাদা সম্মান প্রদর্শন করা হতো। তবে জাহেলি যুগের বা প্রাক ইসলামি যুগে দুই ধরনের কবিতা বেশি রচিত হয়, গীতিকবিতা ও কাসিদা। এই দুই ধরনের কবিতায় বেশি চর্চা হতো তৎকালীন সময়ে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, আরবি কাব্যের প্রকৃত চর্চা শুরু হয় আবদুল মোত্তালিব ফাহিম ইবনে আবদে মানাফের সময়কাল। জাহেলি যুগের কিছু কবি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হলো মুআল্লাকা। এতে সাতজন কবির নাম উল্লেখযোগ্য। যারা হলেন ইমরুল কায়েস (জন্ম ৪৯৭ খ্রি.-মৃত্যু ৫৪৫ খ্রি.), ত্বরফা বিন আল আবদ (জন্ম ৫৩৮ খ্রি.-মৃত্যু ৫৬৪ খ্রি.), যুহায়ের বিন আবি সুলমা (মৃত্যু ৬০৯ খ্রি.), লাবিদ বিন রাবিয়া (জন্ম ৫৬০-মৃত্যু ৬৬১ খ্রি.), আমর বিন কুলসুম (মৃত্যু ৬০০ খ্রি.), হারিস বিন হিল্লিজা (মৃত্যু ৫৬০ খ্রি.), আনতারা বিন সাদ্দাদ (মৃত্যু ৬১৫ খ্রি.) প্রমুখ। এ ছাড়াও জাহেলি যুগের আরো অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের নাম পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত, ইসলামি যুগ তথা মহানবী খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কাল। এ যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এর কবিতা চর্চায় জাহেলি কাব্যের ধারা অব্যাহত ছিল। পরে কোরআনের প্রভাবে তাদের চিন্তা ও চেতনায় নতুনত্ব আসে। ফলে কোরআন ও হাদিসের ভাষা বর্ণনাশৈলী কৌশল তাদের কাব্যধারাকে প্রভাবিত করে। তৎকালীন ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এবং সাহাবিদের নিয়ে কিছু মানুষ কুৎসা ও নিন্দা রটানোর জন্য কবিতা লিখত। কিন্তু সাহাবিরা নবী ইসলাম অমুসলিমদের মর্যাদা সুখ্যাতি প্রচার করার জন্য ইসলামি ভাবধারায় কবিতা ও সাহিত্য রচনা করতেন। ইসলামি যুগে বিখ্যাত কবিদের মধ্যে রয়েছেন হাসান বিন সাবিত (মৃত্যু ৫৪ হিজরি ৬৭৪ খ্রি.), কাব ইবন যুহায়র (মৃত্যু ২৪ হিজরি ৬৬২ খ্রি.), কাব ইবন মালিক (জন্ম ৫৯৮ খ্রি.-মৃত্যু ৬৭০ খ্রি.), সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব (মৃত্যু ২০ হিজরি), আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (মৃত্যু ৫২৯ খ্রি.) প্রমুখ। ইসলামি যুগের বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের পাশাপাশি সমাজে সমান সমাদৃত ছিলেন প্রসিদ্ধ খতিবরা।

তৃতীয়ত, উমাইয়া যুগ। এ যুগেও ইসলামি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জাহেলি যুগের ভাবধারায় অনেকেই কবিতা রচনা করতেন। উমাইয়া যুগের কাব্যচর্চায় যেসব কবি বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি ওমর ইবন আবি বারি আহ (জন্ম ৬৪৪ খ্রি./২৩ হিজরি-মৃত্যু ৭১১ খ্রি. ৯৩ হিজরি), কবি আখতাল (জন্ম ২০ হিজরি-মৃত্যু ৯৫ হিজরি), কবি ফারাজদাক (জন্ম ৬৪১ খ্রি.-মৃত্যু ৭৩২ খ্রি.) প্রমুখ। চতুর্থত, আব্বাসী যুগ। ইসলামের ইতিহাসে আরবদের রাজনীতি ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে আব্বাসী যুগকে। আব্বাসীয় শাসকদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এ যুগে আরবি কবিতা বিদেশি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে উন্নতি এবং সমৃদ্ধি লাভ করে। জীবের বৃদ্ধিকাল ছিল ৭৫০ থেকে ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগের কিছু প্রসিদ্ধ কবির নাম। কবি বাশশার ইবন বুরদ (জন্ম ৭১৪ খ্রি.-মৃত্যু ৭৮৪ খ্রি.), কবি আবুল আতাহিয়া (জন্ম ৭৪৮ খ্রি .-মৃত্যু ৮২৬ খ্রি.), কবি আবু নুওয়াস ও আবু তাম্মাম প্রমুখ।

পঞ্চমত, আধুনিক যুগ। আধুনিক যুগের শুরু হয় ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে। যখন নেপোলিয়নের নেতৃত্বে মিসর আক্রমণ করা হয়। সে সময় থেকে বর্তমান সময় অবধি সময় আধুনিক যুগ। মিসরে নেপোলিয়নের অভিযানের ফলে আরবি সাহিত্যজগতে এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। এ যুগের আরবি সাহিত্য স্বমহিমায় প্রতিটি শাখায় বিকশিত হয়। নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, সমালোচনা সাহিত্যের উৎকর্ষতা, মহাকাব্য রচনা সহজ সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। কবিতাচর্চায় আগের প্রশংসা, নিন্দা, প্রেম ইত্যাদি বর্জন করে, গণমানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনীয়তায় নতুনভাবে কবিতাকে চর্চায় নিয়ে আসে সাহিত্যকরা। আধুনিক যুগের উল্লেখযোগ্য প্রসিদ্ধ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রয়েছেন আহমাদ শাওকি, মহম্মদ রশিদ রেজা, জুরজি যায়দান, মুস্তফা লুতফি আল মান ফুলুতি, হাফিজ ইব্রাহিম, খালিল মুতরান, জুবরান খলিল জুবরান, ত্ব হা হুসেন, আহমাদ আমিন, তৌফিক আল হাকিম, আরবি সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী কবি নাজিব মাহফুজসহ অনেকেই।

তাই বলা যায়, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস মানেই মানবসভ্যতার ইতিহাস। যে দেশের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে আরবি সাহিত্য তার সুনাম অক্ষুণœ রেখেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি একটি প্রাচীন-সমৃদ্ধ সাহিত্য হলেও আমাদের দেশে তার চর্চা খুব একটা চোখে পড়ে না। অন্যান্য সাহিত্যের মতো আরবি সাহিত্যেরও রয়েছে সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, রম্য রচনাসহ সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্র; যা চর্চার মাধ্যমে মানুষের রুচিবোধ ও আত্মতৃপ্তি লাভ করা সম্ভব। তাই আরবি ভাষা ও সাহিত্যচর্চা অন্য সব সাহিত্যের মতো গুরুত্ব পাক সেই প্রত্যাশা রইল।"



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: