আধুনিক আরবি সাহিত্যের স্বপ্নদ্রষ্টা ইয়াহইয়া হাক্কি

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:০৩

ইয়াহইয়া হাক্কি : সংগৃহীত ছবি ইয়াহইয়া হাক্কি : সংগৃহীত ছবি

ইয়াহইয়া হাক্কি (১৭ জানুয়ারি ১৯০৫ - ৯ ডিসেম্বর ১৯৯২) মিসরীয় লেখক, ঔপন্যাসিক। কায়রোর এক সম্ভ্রান্ত তুর্কি পরিবারে জন্ম। মিসরীয় সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতের এক অবিস্মরণীয় নাম ইয়াহইয়া হাক্কি। সাহিত্যাঙ্গনে তার উত্তুঙ্গ অবস্থান তাকে নাজিব মাহফুজ ও ইউসুফ ইদ্রিসের পাশাপাশি স্থান করে দিয়েছে।

চারটি ছোটগল্প সংকলন, পাঁচটি উপন্যাস, আত্মজীবনী, দশটি প্রবন্ধ সংকলন, একাধিক অনুবাদগ্রন্থ এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অসামান্য অবদান রয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তার ঝুড়িতে জমা হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কার। দেশ, জাতি, সমাজ, রাজনীতির প্রভূত উন্নয়নে তার সাহিত্য সবাক থেকেছে সবসময়। তার সাহিত্য কীর্তি মিসরের এক অমূল্য সম্পদ।

ইয়াহইয়া হাক্কি কায়রোর জয়নব মহল্লার মিদাত অঞ্চলের কুটনৈতিক পাড়ার মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ১৭ জানুয়ারী ১৯০৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভুত। সাহিত্য অনুরক্তি তার পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া। তিনি বাবার আট সন্তানের তৃতীয়। চাকুরির সুবাদে তার বাবা মুহাম্মদ হাক্কি সারা দেশ চষে বেড়ান। আর সন্তানদের লালন-পালন ভার ন্যস্ত হয় তার মা সাইয়েদা হানিম হুসাইন এর উপর। তার মা ছিলেন সুশিক্ষিতা, সংস্কৃতিবতি ও দুরদৃষ্টি সম্পন্না মহিলা। তার কাছেই ইয়াহইয়া হাক্কির প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হয়। এরপর তিনি মক্তবে ভর্তি হোন।

১৯১২ সালে ছালিবিয়ার আব্বাস পাশা মাদার স্কুলে ভর্তি হোন। ১৯১৭ সালে এ স্কুলে পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর সুয়ুফিয়া স্কুল এবং ইলহামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দু’বৎসর পড়াশোনা করেন। ১৯২০ সালে সায়িদিয়া স্কুলে ভর্তি হোন। খেদিভ কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। ১৯২৫ সালে ফুয়াদ আওয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৪তম স্থান অধিকার করে আইন সনদসহ লিসান্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এ প্রতিষ্ঠানে তার সহপাঠি ছিলো তাওফিকুল হাকিম, হিলমি বাহজাত, আব্দুল হাকিম রিফায়ী প্রমুখ।

শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কর্মজীবনে আইন পেশায় নিয়োজিত হোন। তার পার্শবর্তী মহকুমায় আইন প্রাকটিস শুরু করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশি উপার্জনের তাগিদে তিনি রাজধানী কায়রো যান। কিন্তু সেখানেও তিনি আইন পেশায় ভালো করতে পারেন না। ব্যর্থ-মনোরথে আবার পাড়ি জমান আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী জাকি আরিবির হাত ধরেন। মাত্র ছয় গিনি মাসিক বেতনে চাকুরী নেন। আবারো কায়রো। অতপর বাহিরা। এবার তার চাকুরীর বেতন ১২ গিনি। কিন্তু, আইন পেশার ন্যাচার তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না। এ পেশার পেশাদারিত্ব কিংবা অর্থের বিনিময়ে অপরাধীর পক্ষ অবলম্বন ইত্যাদি তাকে ভাবিয়ে তোলে। মাত্র আঠারো মাসের মাথায় তিনি সব ছেড়ে দেন। ১৯২৭ সালে সায়িদের মানফালুতে তার বাবার পদে চাকুরীতে যোগদান করেন। কিন্তু এ পেশায় উপার্জন আরো কম হওয়ায় এতেও তার আত্মতুষ্টি পরিলক্ষিত হয় না। বরং চাকুরি নিয়ে সর্বদা তার মনে ক্ষেদ, ক্ষোভ, অভক্তি ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।

সায়িদে দু’বৎসর কাল থাকেন। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এম্বাসেডর ও হাইকমিশন নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এ বিজ্ঞপ্তির অধীনে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং কৃতাকার্য হন। ১৯২৭ সালে তিনি জেদ্দাস্থ মিসর এ্যাম্বেসির সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৩০সালে ইস্তাম্বুলস্থ এ্যাম্বেসিতে স্থানান্তরিত হোন। ১৯৩৪ সালে ইতালিস্থ মিসর এ্যাম্বেসিতে। সেখানে ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠা (১৯৩৯ খৃ.) পর্যন্ত অবস্থান করেন। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কায়রো আসেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থ-বিভাগের সচিব-৩ হিসেবে নিয়োগ পান। এখানে তিনি দশ বৎসর চাকুরী কালীন নানাবিধ পদায়ন ও পদোন্নতি লাভ করেন। শেষত সচিব-১ হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৩৯ সালে প্যারিসস্থ মিসর দূতাবাসে সচিব-১ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫২ সালে আঙ্কারায় মিসরের উপদেষ্টা এবং ১৯৫৩ সালে লিবিয়াস্থ মিসর দূতাবাসের হাইকমিশনার হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫৪ সালে ফরাসী ভাস্কর জন মেরিকে বিবাহ করলে তাকে কুটনৈতিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি সস্ত্রীক মিসর আসেন। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৫৫সালে চারু ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক নিযুক্ত হোন। ১৯৫৫ সালে ইনস্টিটিউটটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সেদিক থেকে তিনিই ছিলেন ইনস্টিটিউটের প্রথম ও শেষ মহাপরিচালক। এরপর দারুল কুতুব এর মহাপরিচালক নিযুক্ত হোন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত থেকে চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন।

এরপরই তিনি আল মাজিল্লা আল মিছরিয়া পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। মিসরে বহুল প্রচারিত এই পত্রিকার সাথে তিনি প্রায় আট বছর যুক্ত থাকেন। এ নিতান্ত কম সময় নয়। এ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ইতোপূর্বে আর কেউ এতো বেশি দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে তিনি এ পত্রিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কিংবদন্তিতে পরিণত হোন। এ পত্রিকা বলতেই মিসরীয় জনগণ ইয়াহইয়া হাক্কির পত্রিকা বুঝতেন। এ পত্রিকার সুবাদে তিনি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে সক্ষম হোন। এ পত্রিকায় তিনি নতুন নতুন কলাম চালু করে দেশ, জাতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা বিষয়ক নানাবিধ গল্প, প্রবন্ধ, ও সমালোচনা সাহিত্যের উন্মোচন করেন। তার অবসরের পর এসব কলাম বন্ধ হয়ে যায়। আর তিনি উঠেন খ্যাতির উত্তুঙ্গে।

বস্তুত ইয়াহইয়া হাক্কি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের মূর্তমান আধ্যাত্মিক সাহিত্য পুরুষ। রাজনৈতিক বাধা ও প্রতিকূলতার সমন্বয় করে এ পত্রিকার অগ্রযাত্রা তিনি অব্যাহত রাখতে পারলেও ১৯৭০ সালে নভেম্বর মাসে আনোয়ার সাদাত পাশার শাসনামলে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়।

তিনি ছিলেন খোলামেলা মনের মানুষ। তিনি পরিচ্ছন্ন ও নিরপেক্ষ জীবন যাপন করতেন। তিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধারার জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবন ও বৃদ্ধ কোনো কালেই তার চিন্তা-চেতনায় অপরিচ্ছন্নতা বা অশুদ্ধতা দেখা যাবে না। তার এ মানসিকতাই তার লেখক জীবনের মূল উপাত্তের যোগানদাতা।

ইয়াহইয়া হাক্কি তার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কুটনৈতিক চাকুরীতে ব্যাপৃত থাকেন। এ সময় তাকে সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়েছে চাকুরীর প্রয়োজনে। কিন্তু তিনি কখনই আত্মবিকৃতি করেননি কিংবা নিজেকে আত্মবিস্মৃৎ হননি। তিনি চাকুরী করেছেন ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তাকে অটুট রেখে। তিনি যেমন সরকারের সাথে সংঘর্ষে যাননি। তেমনি সরকারকে তোষামোদও করেননি। বরং তিনি যথার্থ মাত্রায় উত্তীর্ণ আমলা হিসেবে অত্যন্ত সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন।
ইয়াহইয়া হাক্কির বিবাহ বেশ বিলম্বিত হয়। তিনি ৩৭ বৎসর পর্যন্ত কুমার জীবনযাপন করেন। ১৯৪২ সালে নাবিলা নাম্মীয় এক মিসরীয় মহিলাকে বিয়ে করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মহিলা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। ইয়াহইয়া হাক্কি আবারও একাকী হয়ে পড়েন।

তাদের এ বিয়ে দশ মাস বা তার কিছু বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিলো। তিনি স্ত্রীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হোন। দীর্ঘদিন বিয়ে থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে ১৯৫২ সালে লিবিয়ায় মিসরের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলে সে সময় ভাস্কর জন মেরি নামক এক ফরাসী মহিলার সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং পরিণয়ের দিকে এগুতে থাকে। কিন্তু কুটনৈতিক চাকুরী জীবনে বিদেশি বিবাহ নিষিদ্ধ থাকায় তিনি বিবাহে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন। যাহোক সম্পর্কের গাঢ়তা ও আস্থায় তিনি ১৯৫৪ সালে এ পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। জন মেরির সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের এ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থায়ীত্ব লাভ করে। তারা একত্র বসবাস করতে থাকেন। ইয়াহইয়া হাক্কির মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সুখী দাম্পত্য চলমান থাকে।

ইয়াহইয়া হাক্কি ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হোন। ১৯৮৩ সালে ফরাসী সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত করেন। এ ছাড়াও একই বৎসর আল মানইয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৯০ সালে আরবি সাহিত্য শাখায় আধুনিক ছোটগল্পের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাদশা ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন।

ছোটগল্পকার হিসেবেই ইয়াহইয়া হাক্কির খ্যাতি সমধিক। ছোটগল্পের স্টাইল ও আঙ্গিক তিনি নবরূপে সাজান। আরবি ছোটগল্পের উৎকর্ষতা তার হাতেই সিদ্ধি লাভ করে। ইতোমধ্যেই ইউসূফ ইদরিস, তাহির লাশিন, মাহমুদ তাইমুর প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাঠক সমাজের সাথে আরবি ছোটগল্পের পরিচিতি ও সখ্য গড়ে উঠলেও ইয়াহইয়া হাক্কি নবতর স্বাদ ও নব ব্যঞ্জনায় আরবি ছোটগল্প উপস্থাপন প্রয়াসী হোন। বলাবাহুল্য অত্যল্প সময়ের মধ্যেই তার গল্পসমূহ পাঠকাদৃতি পায়। ইয়াহইয়া হাক্কির জীবন ঘনিষ্ট গল্পসমূহ পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। হাক্কির লেখকসত্তার প্রতি পাঠকের আগ্রহের মাত্রা চক্রগুণে বাড়তে থাকে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তিনি আরবি সাহিত্যের প্রাণপুরুষে পরিণত হোন। তার বেশ কয়েটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে: ক. দিমা ওয়া তিন (রক্ত ও মাটি) ১৯৫৫ সাল। খ. উম্মু আল-আওয়াজিজ (অক্ষমতা) ১৯৫৫ সাল। গ. আনতার ও জুলিয়েট- ১৯৬০ সাল। ঘ. সারিক আল-কাহল্্ (সুরমা চোর) ১৯৮৫ সাল প্রভৃতি।

তার একাধিক উপন্যাস রয়েছে- ক. কিনদিলু উম্মু হাশিম (হাশিমের মায়ের প্রদীপদানি) ১৯৪৫ সাল। খ. সাহ আল-নাওম (জেগে উঠো) ১৯৫৯ সাল। তার অনেকগুলো প্রবন্ধ সংগ্রহ রয়েছে। মিসরের বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত পত্রিকাসমূহে তার সাহিত্য, রাজনীতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, দেশ-জাতি বিষয়ক নানান অনুষঙ্গ নিয়ে লিখিত প্রবন্ধসমূহ পরবর্তীতে সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে- ক. খুতুওয়াত ফি আল-নাকদ (সমালোচনার সুত্রাবলী) ১৯৬০ সাল। খ. ফাজর আল-কিচ্ছা আল-মিসরিয়্যা (মিসরীয় গল্পের সুচনা) ১৯৬০ সাল। গ. ফিকরা ওয়া ইবতিসামাহ (চিন্তা ও হাসি) ১৯৬১ সাল। ঘ. দামআ ও ইবতিসামাহ (অশ্রু ও হাসি) ১৯৬৬ সাল। ঙ. তায়াল মায়ি ইলা আল-কুনসির ( চলো যাই কুনসিরে) ১৯৬৯ সাল। চ. হাকিবাতুন ফি ইয়াদি মুসাফির (মুসাফিরের ব্যাগ) ১৯৭১ সাল। ছ. আতর আল-আহবাব (প্রিয়জনের সুবাস) ১৯৭১ সাল। জ. ইয়া লাইল ইয়া আইন (হায় রাত হায় চোখ) ১৯৭২ সাল। ঝ. উনশুদাতু আল-বাসাতাহ (সুসময়ের সঙ্গিত) ১৯৭৩ সাল। ঞ. নাসুন ফি আল-জিল্ল (ছায়ার মাঝে মানুষ) ১৯৮৪ সাল।

ইয়াহইয়া হাক্কি চাকুরির সুবাদে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। নানান দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ও দুর্বল হয়ে পড়েন। কোনো কোনো ভাষায় দক্ষতাও অর্জন করেন। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় পা-িত্য অর্জন করেন। ড. কানুক ও গুল রোমান এর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নাটকসমগ্র অনুবাদ করে জগৎ জোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়াও মরিস মিট্রালঙ্ক এর নীল পাখি আরবিতে অনুবাদ করে মিসরে ঝড় তোলেন। এ দুটো নাটকের স্বার্থক অনুবাদ তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এর বাইরেও তিনি ক. আল-আব আল-আলিল (অসুস্থ বাবা) খ. স্টিফেনের লায়িব আল-সাতরঞ্জ (দাবাড়–) ১৯৭২। গ. মিখাইল সাদ এর আল-বালতাহ ঘ. টমাস রবম্যানের টুনি ও ক্রুজার প্রভৃতি উপন্যাসের অনুবাদ করেন।

ইয়াহইয়া হাক্কির প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের নাম ফুল্লা, মুশমুশ ওয়া লুলু। এটি মিসরের বিখ্যাত আল-ফাজর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি মুলত প্রাণীজগত নিয়ে লেখা। বিড়াল, বিড়ালী ও কুকুরকে আশ্রয় করে লেখা প্রতীকধর্মী গল্প এটি। এতিমের অধিকার, বঞ্চনা ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিই এ গল্পের সারাংশ। ইয়াহইয়া হাক্কি এ গল্পে তিনটি প্রাণীর আড়ালে মিসরীয়, ইতালী ও তুর্কি গৃহকর্ত্রীর চিত্র অঙ্কন করেছেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে। তারা অধীনস্থদের সাথে কেমন আচরণ করেন তারই অনবদ্য দৃশ্য অংকন করেছেন এ গল্পে।

ইয়াহইয়া হাক্কি সবসময়ই জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন। জীবনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়সমূহের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তার গল্পে বিমূর্ত আত্মপ্রকাশ করে। তার এমন একটি ছোটগল্প কিচ্ছাতু লুচ্ছ বা লম্পটের গল্প। এ গল্পে তিনি এক ধনীর দুলালের জীবন চিত্র তুলে এনেছেন পাঠক সমীপে। যে গ্রাম থেকে শহরে এসে বাপের টাকা দুহাতে খরচ করে। কোনো পরোয়া করে না। এরই মধ্যে সে এক নারীর সাথে অবৈধ ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। গ্রাম্য মানুষটি নষ্ট মানুষে পরিণত হয়। এ গল্প আমাদেরকে কষ্ট দেয়। তবে এমন ঘটনা অহর্নিশ ঘটতে দেখা যায়। এমন সব ঘটনার সহজ-সরল উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের সমাজের চিকিৎসা প্রয়াসী ছিলেন ইয়াহইয়া হাক্কি। এ গল্পে অনৈতিকতার অনুপ্রবেশে এমন ধারণার অবকাশ নেই যে, তিনি অশ্লীলতা প্রিয় ছিলেন। বরং তিনি ছিলেন সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ প্রয়াসী।

কাহওয়া দিমতিরি বা দিমতিরি কফি হাউজ। মিসরের সায়িদ এলাকায় বহুল প্রচলিত ও জমজমাট এক কফি হাউজের নাম। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানান কিসিমের মানুষের অনবরত যাতায়াতে সরগরম থাকে এ কফি হাউজ। এটি ছিলো সত্যিকার অর্থেই একটি কফি হাউজ। পরিছন্ন প্রতিবেশ, নির্মল পরিবেশ, অমল খাবার-দাবার, রুচিসম্মত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দিয়ে সাজানোগোটা কফি হাউজ। এর পরিবেশকরাও অত্যন্ত ভদ্র ও পরিশীলিত। লেখকের প্রত্যাশা মিসরের সব কফি হাউজই যদি এমন স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব হতো তবে কতই না ভালো হতো।

মান আল মাজনুন বা পাগল? ইয়াহইয়া হাক্কির এক অনবদ্য ছোট গল্প। মুহসিন আফেন্দিকে নিয়ে লেখা তার এ গল্প পাঠক প্রিয়তা পায় অতিমাত্রায়। মুহসিন আফেন্দি সদ্য আইন পাশ করা এক উদ্দীপ্ত মিসরীয় যুবক। আকস্মিকভাবে সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। টাইফয়েড তার জীবনের গতিধারা বদলে দেয়। তাকে অপ্রকৃতিস্থ বানিয়ে দেয়। কথাবার্তা, কাজে-কর্মে তার অসংলগ্নতা সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। সে অফিস সময়, দেশের প্রচলিত দ-বিধি, নিয়মকানুনের বৃত্ত ভাঙার আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত কৃষকরা যদি গরম থেকে বাঁচতে কিংবা সময়াভাবে রাতে কাজ করতে পারে তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেনো পারবেন না। প্রসঙ্গত কৃষক অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে গল্পের প্রাণ। কৃষক সমাজের দুর্দশা, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে কৃষকের অবদান ও অনিবার্যতার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে অনন্য শব্দ গাঁথুনিতে।

অনুরূপভাবে ইয়াহইয়া হাক্কির আল উদ্দাহ বা দংশন আরেকটি ছোটগল্প। এখানে মিসরীয় শাইখদের স্বভাব চরিত্রের পরিস্ফুটন ঘটেছে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে তা আমাদের খারাপ লাগলেও সমাজে এমন শাইখের অভাব হয় না। সমাজের এমন সত্য কথাগুলো অত্যন্ত সহজ করে বলতে পারতেন ইয়াহইয়া হাক্কি। এখানেই হাক্কির লেখক সত্তার স্বরূপ উদ্ভাসিত হয় আপন স্বকীয়তায়। প্রমাণিত হয় সত্যিই তিনি লিখেন দেশ-জাতি-সমাজের জন্য স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়।

নারী কিংবা প্রেম প্রসঙ্গের উপস্থিতি তার গল্প উপন্যাসে রয়েছে। কিন্তু তা নিতান্তই কাহিনি বা গল্পের পূর্ণতার্থে। অন্য কোনো কারণে নয়। তার গল্প বা উপন্যাসে কদাচ ধার্মিকদের প্রতি কটাক্ষ লক্ষণীয়। তবে তা ধর্মকে কন্টকবিদ্ধ করতে নয়। বরং অশুদ্ধতা ও পঙ্কিলতা থেকে পরিশুদ্ধ করতে। তিনি কোনো অর্থেই ধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন না। তিনি ধর্মের প্রাঞ্জলতা ও কল্যাণমুখীতার প্রতি ছিলেন অনুরক্ত।

তার অমর উপন্যাস কিনদিল উম্মু হাশিম বা হাশিম মাতার প্রদীপদানি। এ উপন্যাসে তিনি মিসরীয় সমাজ, সামাজিকতা, ধর্মান্ধতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভয়াবহ নিয়তি, শ্রেণীবৈষম্য প্রভৃতি বিষয়কে উপজীব্য করে তুলেছেন চাহিদাপযোগী করে। ক্লাসিক আরবি ও আঞ্চলিক শব্দের সমাবেশ এতে ছিলো। যা উপন্যাস আস্বাদনে আমাদের কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। তবে মিসরীয়রা এর স্বাদ আস্বাদন করেন পূর্ণমাত্রায় এবং তাৎক্ষণিক। ঔপন্যাসিকের যথার্থ সার্থকতা এখানেই।

প্রতিটি সাহিত্যিকের মতোই ইয়াহইয়া হাক্কিও কবিতা দিয়েই শুরু করেন তার সাহিত্য জীবন। সত্ত্বর কবিতার সাথে তিনি বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পথ চলা শুরু করেন গল্প ও উপন্যাসের পথে। ঝুড়ি ঝুড়ি ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করে তিনি আরবি সাহিত্যে তার অবস্থান দৃঢ় করেন। ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় তার অভিনবত্ব, আঙ্গিক নির্মাণ কৌশল, শব্দশৈলী, মিশ্রভাষার যথার্থ প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে তিনি আধুনিক আরবি সাহিত্যের ধারায় নবমাত্রা যোগ করেন। সেজন্যই তার সমসাময়িক ও তৎপরবর্তী প্রায় সকল সাহিত্যিকই তাকে আরবি সহিত্যের অন্যতম পথিকৃত ও স্বপ্নদ্রষ্টা বিবেচনা করেন।

বিংশ শতাব্দীর দুজন সফল ছোটগল্পকার হলেন ইউসূফ ইদ্্রিস ও ইয়াহইয়া হাক্কি। দুজনেরই ছিলো উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা। কিন্তু ইউসূফ ইদ্রিসের ছোটগল্পে কথোপথনের প্রাবল্য দেখা যায়। কারণ তিনি মনে করতেন কথোপকথন নাটকের একমাত্র অধিকার হতে পারে না। এ মতকে প্রতিষ্ঠা করতেই তার এ প্রয়াস। কিন্তু ইয়াহইয়া হাক্কি তার ছোটগল্পে কথোপকথনের ব্যবহার সীমায়িত রাখতে চেয়েছেন। কদাচ ও নিতান্ত প্রয়োজন বৈ কথোপকথনের আশ্রয় নেননি। তার বিশ্বাস অতিরিক্ত কথোপকথন গল্পের মান কমিয়ে দেয়।

সমূহ ব্যঞ্জনা আর টেকনিকে সমৃদ্ধ থাকতো তার গল্প। তার গল্পসমূহে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বর্ণনায় মুখর থাকতে দেখা যায় বর্ণনপটিয়সী ইয়াহইয়া হাক্কিকে। অস্থির ও উত্তাল মিসরে রাজনৈতিক টানাপোড়েন লেগেই থাকতো। তাই প্রতীকের আশ্রয় নিতে দেখা যায় এ গল্পকারকে। ঘটনা বর্ণনায় তিনি ছিলেন পটু। বাড়াবাড়ি নয় মৌলিকত্ব ঠিক রেখে তিনি পৌঁছতেন তার গন্তব্যে। জীবনের জন্য সাহিত্য এ দর্শনে বিশ্বাসী থেকে তিনি নির্মাণ করতেন তার গল্পের প্লট। তার প্রায় প্রতিটি গল্পেই শুরু ও শেষের বিষয়বস্তুর আবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তিনিই প্রথম ছোটগল্পে ফ্ল্যাশব্যাক প্রথার প্রচলন করেন।

তিনি একজন পরিশ্রমী লেখক। শুধু লিখতেন না। পড়তেনও অনেক বেশি। দেশ-ভ্রমণের সুবাদে অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ও দুর্বলতা এবং অন্য-সংস্কৃতির অনবদ্য রচনা আরবীতে ভাষান্তরের মতো শক্ত কাজে তিনি হাত দেন সাহসের সাথে। সফলভাবে বেশ কয়েকটি নাটক ও যাত্রাপালার সফল অনুবাদ করেন। তার যাত্রাপালা মিসরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মনে করা হয় যদি তার সকল সাহিত্যেকর্ম যদি কোনো দিন লুপ্ত হয়ে যায় তবুও ইয়াহইয়া হাক্কি বেঁচে থাকবে তার যাত্রাপালার মধ্য দিয়ে।

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ইয়াহইয়া হাক্কির সব থেকে বড়ো সফলতা হলো তার চলচিত্র নির্মাণ। তিনি চারটি চলচ্চিত্রের সফল প্রযোজনা করেন। তার বুস্টজি ও কিন্দিল উম্মু হাশিম দুটি চলচ্চিত্র ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। এর আগে তার আরো দুটি চলচ্চিত্র ছাড় হয়।

সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় সফল পদচারণা রেখেছেন ইয়াহইয়া হাক্কি। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাহিত্য সখ্য তাকে সাহিত্যের শিখরে আরোহন করিয়েছে। ব্যক্তি জীবনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবং মিসরের রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা ছাপিয়ে তিনি যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন সত্যিই তা আরবি ও বিশ্ব সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। তার বিশাল সাহিত্য সৃষ্টি তাকে দিয়েছে অমরত্ব। তার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে আরবি সহিত্যের স্বপ্নদ্রষ্টার আসন। এ মহান সাহিত্যিক তার অসংখ্য গুণগ্রাহী ভক্তকুল, বিশাল পাঠকগোষ্ঠী এবং পৃথিবীকে কাঁদিয়ে ৯ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে স্রষ্টার ডাকে সাড়া দেন। আমরা এ সাহিত্যিকের সকল সাহিত্য সম্পদ বাংলা ভাষায় অনুবাদের প্রত্যাশা করি।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: