ইবনে খালদুন এবং তার আল মুকাদ্দিমা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:২১

ছবি : সংগৃহীত ছবি : সংগৃহীত

 

ইবনে খালদুন চেয়েছিলেন তার কোনো উত্তরসূরির দ্বারা তার সূচিত গবেষণা বাস্তবায়িত হোক; কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। তার যেমন কোনো পূর্বসূরি ছিলেন না, তেমনি তার কোনো উত্তরসূরি নেই। তিনি জ্ঞানের জগতে এককভাবে অপ্রতিন্দ্বী ব্যক্তি হিসেবে রয়ে গেলেন। - ডাচ পণ্ডিত টি জে দ্যা বোয়ার

আরবের বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে খালদুনকে বলা হয় সমাজ বিজ্ঞানের অনানুষ্ঠানিক জনক। পাশ্চাত্য জ্ঞানজগতে যখন সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসতত্ত্বের সূচনা হয়নি, তার আগেই তিনি তার লিখনিতে এ বিষয়ের অবতারণা করেছেন।

এজন্য তার গ্রন্থ বিধৃত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে ঐতিহাসিকরা তাকে ইতিহাস লিখনবিদ্যা তথা ইতিহাস বিজ্ঞানের একজন শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক বলে গণ্য করেছেন। আর তাই চতুর্দশ শতকের পাশ্চাত্য লেখকদের জন্য তার ধ্রুপদী মুকাদ্দিমা গ্রন্থটি ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের ইতিহাস তত্ত্বের ভিত্তি রচনা করেছে।

ইবনে খালদুন ৭৪ বছর বেঁচে থাকলেও জ্ঞানের জগতে তার সক্রিয় বিচরণকাল ৫৪ বছর।

ইবনে খালদুন সম্পর্কে বাংলা ভাষায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়নি। গোলাম সামদানী কোরায়শী আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থের দুটি খণ্ড অনুবাদ করে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রংগলাল সেনের একটা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ আছে ইবনে খালদুনকে নিয়ে। আর আল মুকাদ্দিমার একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলেন নূর মোহাম্মদ মিয়া নামে একজন ব্যক্তি। এর বাইরে তেমন কোনো লেখাপত্তর দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে ভবিষ্যতে তাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় আরো গবেষণা করার সুযোগ আছে। পাশ্চাত্যে তাকে নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে, ভবিষ্যতে আরো হবে।

ইবনে খালদুন আরো অনেক বিষয়ে কাজ করলেও, তিনি মূলত তার বিখ্যাত আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থের জন্য বিশ্বের বিদ্বৎ সমাজের কাছে বেশি পরিচিত। বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানকাণ্ডের পরিসরে তিনি আজও আলোচিত ব্যক্তি। তাকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখানেই তিনি অনন্য।

ইবনে খালদুন তিউনিসিয়ার তিউনিস শহরে ১৩২৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ওয়ালী আল-দ্বীন আবদ আল-রাহমান ইবন মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন আবি বকর মুহাম্মদ ইবন আল-হাসান ইবন খালদুন।

আরবি ভাষাতত্ত্ব ছিল তার অধ্যয়নের অন্যতম বিষয়। কোরআন, হাদিস, শরিয়া (আইন), ফিকাহও (দর্শন) পড়েছেন। সেইসাথে তিলিমসানের (উত্তর-পশ্চিম আলজেরিয়ার অঞ্চল) দার্শনিক ও গণিতবিদ আল-আবিলির কাছে গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন শেখার সুযোগ হয়েছিল তার। তিনি আবু রুশদ, ইবনে সিনা, আল-রাজির কাজ নিয়েও পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন।

২০ বছর বয়সে খালদুন তিউনিসিয়ার শাসক ইবনে তাফরাকিনের দরবারে ক্যালিগ্রাফার হিসেবে কাজ নেন। দরবারের কাজকর্মের বিবরণ লিখে রাখতেন। ১৩৫২ সালে কনস্টানটিনের সুলতান আবু জিয়াদ তিউনিস দখল করে নিলে খালদুন তার শিক্ষক আবিলিকে অনুসরণ করে ফেজে (মরক্কোর একটি শহর) চলে যান। সেখানে তিনি রাজকীয় ফরমান লেখার কাজ পান। তবে রাজার কথা ঠিকমতো মেনে না চলার কারণে তিনি ২২ মাস কারাগারে বন্দি ছিলেন। এভাবে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে খালদুন সময় অতিবাহিত করেছেন। জীবনের শেষ দিকটা কাটিয়েছেন মিসরে। পড়িয়েছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও।

তিনি ছিলেন একজন কঠোর সমাজ সমালোচক। তিনি তার দেশে যখন যে অবস্থায় অবস্থান করেছিলেন, তখন সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে নিরলসভাবে নিয়োজিত ছিলেন। এভাবে তিনি এ অঞ্চলের জনগণ ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রচুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করেন।

১৩৭৪ সাল থেকে তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে চার বছর সামাজিক ইতিহাস রচনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। উক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ১৩৭৭ সালের মে-অক্টোবর তিনি তার ধ্রুপদী মুক্কাদ্দিমার রূপরেখা প্রণয়ন করেন, যার বিশদ ব্যাখ্যার জন্য তাকে অন্তত আরো সাত বছর সময় ব্যয় করতে হয়। তিউনিসিয়ার রাজধানী শহরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ লাইব্রেরি থেকে তিনি ১৩৭৮ সালে এ উদ্দেশ্যে আফ্রিকার নীল নদের তীরবর্তী প্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া ও কায়রোয় অবস্থান করেন।

মুকাদ্দিমা গ্রন্থটি রচনায় তিনি দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তিনি তার সমকালীন লিখিত সূত্রসমূহ পর্যালোচনা করে প্রচুর উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। আবার উত্তর আফ্রিকার আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত তার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, উক্ত অঞ্চলের লোকজন ও তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ছিল তার সুগভীর আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠ ও দীর্ঘ পরিচয়। তিনি তার ওই গ্রন্থটি রচনায় শুধু রাজদরবারে সংরক্ষিত দলিল দস্তাবেজই পাঠ করেননি, অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত বিপুল তথ্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ যথাসম্ভব যৌক্তিকভাবে পরিবেশনের প্রয়াস পেয়েছেন।

মুকাদ্দিমাকে সামাজিক বিজ্ঞানের যে তিনটি প্রধান শাখার আকরগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা যায়, সে সব হলো- সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি। যদি শুধু সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে মুকাদ্দিমাকে মূল্যায়ন করা যায়, তাহলে ওই গ্রন্থের ছয়টি অংশকে সমাজবিজ্ঞানের ছয়টি ক্ষেত্রে অনায়াসে বিভক্ত করা সম্ভব। ক্ষেত্রগুলো হলো যথাক্রমে- সামাজিক ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, জাতিতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞান, রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞান বা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ সমাজবিজ্ঞান, সমাজ কাঠামো ও সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং শিক্ষার মনোবিজ্ঞান।

মুকাদ্দিমা সম্পর্কে বৈরুত-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক চার্লস ইসাবী বলেছেন, ‘চতুর্দশ শতকের আরব দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের গবেষণা কর্মকে আমরা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারি। সর্বজনীন ইতিহাসে তার মুখবন্ধ ইতিহাসতত্ত্বের উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেছে, যাতে উনিশ শতকের কার্ল মার্কসসহ আঠারো শতকের ইউরোপীয় লেখকদের ধ্যান-ধারণার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। খালদুন সত্যিই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব।’

জর্জ সার্টনের মতে, ‘ইবনে খালদুন একজন ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও মানুষের কর্মকাণ্ডের গভীর অনুসন্ধিৎসু ছাত্র। তিনি মানবজাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উপলব্ধির জন্য এর অতীতের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণে বিশেষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন। খালদুন কেবল মধ্যযুগের ঐতিহাসিকই ছিলেন না। তিনি মেকিয়াভেলি, বোদে, ভিকো ও সমাজবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক জনক অগাস্ট কোৎয়েরও ছিলেন অগ্রপথিক। এছাড়া যেটি সমভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো এই যে, খালদুন সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক গবেষণা পদ্ধতির বিকাশ সাধনে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।’

অষ্ট্রিয়ার প্রাচ্যবাদী সামাজিক ঐতিহাসিক ব্যারন ভন ক্রেমারের বিবেচনায় খালদুনের সবচেয়ে বড় অবদান ঐতিহাসিক গবেষণা পদ্ধতির মৌলিক প্রস্তাবসমূহের বিকাশ সাধন, যা পরবর্তীকালে পাশ্চাতের সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারা অনুসৃত ঐতিহাসিক পদ্ধতি তথা ঐতিহাসিক সমাজবিজ্ঞান নামে অভিহিত হয়েছে।

অন্যদিকে ডাচ পন্ডিত টি জে দ্যা বোয়ার এর মতে, খালদুন মূলত দার্শনিক। তার দর্শনচিন্তার আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য এই যে, খালদুন নিজে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কখনো রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন না।

তিনি আরো বলেন, ইবনে খালদুনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ ধর্মের দ্বারা কখনো প্রভাবিত হয়নি; বরং এরিস্টটল ও প্লেটোর যুক্তিশীল ভাবাদর্শের দ্বারাই তার ধ্যান-ধারণা অধিকতর রূপায়িত হয়েছিল। কিন্তু ইবনে খালদুন এমন একটি নতুন দার্শনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন, যা এরিস্টটলের চিন্তায় কখনো আসেনি। এর কারণ খালদুন তার ইতিহাসতত্ত্ব থেকে ওই দার্শনিক ব্যবস্থার বিকাশ সাধন করতে চেয়েছিলেন, যা সামাজিক জীবন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। অধিকন্তু সমাজের অভ্যন্তরেই মানুষের বৌদ্ধিক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে।

এ মহান দার্শনিক ব্যক্তির আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থটি আজো জ্ঞানকাঠামোর পরিষরে দীপ্তমান আলো ছড়াচ্ছে। তাই বলা যায় মৌলিক কাজের কখনো সমাপ্তি ঘটে না, বরং তা যুগ যুগ ধরে নতুন নতুন জ্ঞানের উন্মেষ ঘটিয়ে থাকে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: