ইবনে বতুতা : মরক্কোর কাজী থেকে ইতিহাস বিখ্যাত পর্যটক

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:১০

ইবনে বতুতা : মরক্কোর কাজী থেকে ইতিহাস বিখ্যাত পর্যটক : গ্রাফিক্স ইবনে বতুতা : মরক্কোর কাজী থেকে ইতিহাস বিখ্যাত পর্যটক : গ্রাফিক্স


ইবনে বতুতার নাম শোনেনি এমন লোক হয়তো খুব কমই আছে। ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিত্ব এবং পর্যটকের মধ্যে ইবনে বতুতার নাম থাকবে তালিকার প্রথম দিকেই, যিনি ঘুরে বেরিয়েছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পদধূলি ফেলেছেন দেশ-দেশান্তরে।

ইবনে বতুতা নামে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও তাঁর মূল নাম শেখ আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ। তিনি একাধারে একজন পর্যটক, বিচারক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সুন্নি ইসলামের মালেকী মাযহাবের অনুসারী একজন ধর্মতাত্ত্বিক।

ইবনে বতুতা ২০ বছর বয়সে বেরিয়ে পড়েন বিশ্বভ্রমণে। এরপর একটানা ৩০ বছর ঘুরে বেড়ান বিশ্বের নানা প্রান্ত। এ সময় তিনি ভ্রমণ করেন ১,২০,০০০ কিলোমিটার। তৎকালে তিনি পৃথিবীর সকল মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন এবং সেসব অঞ্চলের শাসকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

এই দীর্ঘ পথ ভ্রমণের পর ইবনে বতুতা যখন তার নিজ দেশ মরক্কোতে ফিরে আসেন, তখন মরক্কো সুলতান আবু ইনান ফারিস ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য তাকে তাগাদা দেন। তার সমগ্র ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য সাহায্যকারী হিসেবে কবি ইবনে জোযাইয়াকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৩৫৫ সালে তার ভ্রমণকাহিনী নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়।

তার এই ভ্রমণকাহিনীর নিবন্ধটির নাম রাখা হয় ‘রিহলা‘। এটি ছিল ১৪ শতকের পূর্বে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক দলিল। এই গ্রন্থটি ১৯৫৮ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় এবং তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। আরবী ভাষায় লিখিত এই গ্রন্থের পূর্ণনাম হলো ‘তুহফাতুন-নুজ্জার ফি গারাইবিল আমসার ওয়া আজাইবিল আস্ফার’।

ইবনে বতুতার ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে বের হয়ে আসে ঐ সমস্ত অঞ্চলের তৎকালীন মানুষের জীবনযাপন, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক অবস্থা। একইভাবে তার বিবরণ থেকেই আমরা জানতে পারি সে সময়ে বাংলার অধিবাসীদের জীবন ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে।

তার ভ্রমণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি সর্বসাধারণের পর্যায়ে মিশে যেতেন। কথা বলতেন সব ধরনের মানুষের সাথে। আর এসমস্ত অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধকরে রাখতেন। তার বর্ণনায় প্রকাশ পেত সেসমস্ত অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও নয়নাভিরাম প্রকৃতিক সৌন্দর্য। প্রাণবন্ত অনুভূতি, সূক্ষ্ম হৃদয়াবেগ এবং তার সাবলীল ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী সেই সময়কার বাস্তব চিত্রটাই যেন তুলে ধরেছে।

ইবনে বতুতা জন্মগ্রহণ করেন মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৩০৪ সালে এক সম্ভ্রান্ত সুন্নি মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন কাজী। ধারণা করা হয়, তার পরিবার পশ্চিম আফ্রিকার ‘লাওয়াতা’ যাযাবর শ্রেণীর উত্তরসূরী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাপক পান্ডিত্য অর্জন করেন। এছাড়া তাঞ্জিয়ার আইনশাস্ত্র এবং সাহিত্যে উপর জ্ঞান অর্জন করেন।

তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় পরিব্রাজক হওয়া। মিশর, সিরিয়া ও হিজাজ অঞ্চলের খ্যাতনামা আলেমদের অধীনে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা। তিনি ইসলামী আইন শাস্ত্রের উপর বিপুল জ্ঞান অর্জন করেন, পরবর্তীতে যা বিভিন্ন ইসলামিক রাজ্য তাকে কাজীর আসনে সম্মানিত করে।

১৩২৫ সালে হজ্জ পালনের জন্য তিনি তার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ার ছাড়েন। যখন তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। সে সময় সাধারণত মরক্কো থেকে হজ্জ করে আবার মরক্কোতে ফিরতে প্রায় ১৫ মাস সময় লেগে যেত। কিন্তু ইবনে বতুতা প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে তিনবার হজ্জ করে ২৪ বছর পর তার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ারে ফেরেন। এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, ‘হজ্জ পালন ও বিশ্ব নবীর রওজা মোবারক জিয়ারতের জন্য ১৪ই জুন ১৩২৫ সালে আমি আমার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ার ছেড়ে যায়। সেই হিসেবে তখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর। এই পথে যাওয়ার জন্য সঙ্গী হিসাবে আমি কাউকেই পাইনি। কাফেলার খোঁজ করেও যখন আমি পেলাম না তখন একাই বেরিয়ে পড়লাম। সে সময় আমার মা-বাবা জীবিত ছিলেন। তাদের ছেড়ে আসাটা খুব কষ্টের ছিল। বিদায়বেলায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।’


বিশ্বভ্রমণ

ইবনে বতুতা প্রায় ৪৪টি দেশ ভ্রমণ করেন, দৈর্ঘ্যে যা প্রায় ১,২০,০০০ কিলোমিটার বা ৭৫,০০০ মাইল। বিশেষ করে তিনি সেই সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেন। ইবনে বতুতা ১৩২৫ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে মক্কায় হজ পালনের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করেন। সে সময় তিনি উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রের তীর ধরে পায়ে হেঁটে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যাত্রাপথে তিনি আব্দ আল ওয়াদিদ এবং হাফসিদ সাম্রাজ্য তিমসান, বিজাইরা এবং তিউনিস হয়ে মক্কায় এসে পৌঁছান।

উল্লেখ্য, যাত্রাপথে তিনি তিউনিসে দুই মাস সময় কাটান। তখন তিউনিসের সুলতান ছিলেন আবু ইয়াহিয়া। তিউনিসিয়ার একটি শহর ছিল কাবিস। এই কাবিস শহরে তিনি তিউনিসের এক উকিলের মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। ত্রিপোলিতে পৌঁছার পর উকিলের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় এবং বিয়ে ভেঙে যায়। পরে ত্রিপোলির ফেজে এসে তিনি পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

৫ই এপ্রিল, ১৩২৬ সালে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে পৌঁছান। আলেকজান্দ্রিয়ার দুজন বিখ্যাত সুফি সাধকের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শেখ বোরহানুদ্দিন। তিনি ইবনে বতুতাকে বলেন, “আমার মনে হচ্ছে তুমি বিশ্বভ্রমণ করবে।” শেখ বোরহানউদ্দিন বলেন, “তুমি ভারতে আমার ভাই ফরিদউদ্দিন, সিন্ধু প্রদেশের রোকনউদ্দিন এবং চীনে বুরহানউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করবে এবং আমার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবে।“

অপরজন হলেন শেখ মুর্শিদি। এই দুই সাধকের কাছ থেকে ইবনে বতুতা বিশ্বভ্রমণের জন্য সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান। যদিও প্রথমদিকে তার বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু এই দুই সাধকের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনেন।

১৩২৬ সালের সম্পূর্ণ রমজান মাস তিনি সিরিয়ার দামেস্কে কাটান। এরপর সেখান থেকে মদিনাগামী একটি কাফেলার সাথে যোগ দেন। মদিনায় মোহাম্মদ (সা) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার পর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মক্কায় হজ্জ পালন সমাপ্ত করে তিনি তার জন্মভূমি তাঞ্জিয়ারে না ফিরে মধ্য এশিয়ায় যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইবনে বতুতার মক্কা ভ্রমণ নিয়ে ২০০৯ সালে একটি ডকুমেন্টারি মুভি নির্মিত হয়। ৪৫ মিনিটের এই ডকুমেন্টারি মুভিটি পরিচালনা করেন ব্রুস নীবাউর। এই মুভিতে ইবনে বতুতা ভূমিকায় অভিনয় করেন কেমস-এডাইন জিনউন।

১৭ই নভেম্বর, ১৩২৬ সালে ইবনে বতুতা মক্কা থেকে ইরাকগামী একটি কাফেলার সাথে যোগ দেন। এরপর নাজাফে হযরত আলী (রাঃ) এর মাজার জিয়ারত করেন। মাজার জিয়ারত শেষে কাফেলাটি ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু ইবনে বতুতা কাফেলার সাথে যোগ না দিয়ে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরার দিকে রওনা দেন।

বসরা থেকে তিনি যাত্রা করেন পারস্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্পাহানের দিকে। ইস্পাহান থেকে তিনি রওনা দেন শিরাজ শহরে। সে সময় শিরাজ শহরটি মোঙ্গলদের আক্রমণে বিপর্যস্ত ছিল। এরপর ১৩২৭ সালের জুনে তিনি বাগদাদে এসে পৌঁছান।

ইবনে বতুতার বর্ণনানুযায়ী, ১২৫৮ সালে চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের সৈন্যরা বাগদাদ আক্রমণে করে। কিন্তু তখনও আক্রমণের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল বাগদাদ শহরে। তিনি বাগদাদের সম্রাট আবু সাঈদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি সম্রাটের রাজকীয় কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে সিল্ক রোড হয়ে তাবরীজ শহরে যান। জুলাই মাসে তিনি পুনরায় বাগদাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে মসুল, সিজরা, মারদিন শহরগুলো ভ্রমণ করেন। পথিমধ্যে একটি আশ্রমে তিনি কুর্দিদের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন। কুর্দিদের কাছ থেকে তিনি বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা উপহার পান। এখান থেকে আরেকটি কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে মক্কায় এসে দ্বিতীয়বার হজ্জ করে পরবর্তী তিন বছর মক্কায় অবস্থান করেন।

এডেন বন্দর থেকে তিনি জাহাজে করে সোমালিয়ার তীরবর্তী জায়লা শহরে এসে পৌঁছান। জায়লা থেকে ১৫ দিনের যাত্রা শেষে সোমালিয়ার মোগাদিসুতে এসে পৌঁছান।

তার বর্ণনা মতে, তৎকালীন মোগাদিসু ছিল ঐ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। তখন মোগাদিসু ভালো মানের একধরনের সুতি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই কাপড় মিশর, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হত। মোগাদিসুর তৎকালীন সুলতান ছিলেন আবু বকর। সুলতান তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন এবং আতিথিয়তার সাথে তিনি সেখানে চারদিন অবস্থান করেন।

এরপর মোগাদিসু ছেড়ে তিনি সাওয়াহি’লি এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আরবিতে সাওয়াহি’লি শব্দের অর্থ ‘উপকূলীয় এলাকা’। তৎকালীন সময়ে সাওয়াহি’লি ‘বিলাদ-আল-জাঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল।

সাওয়াহি’লি আসার অন্যতম কারণ ছিল কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়া ভ্রমণ করা। ইবনে বতুতা এই দুই শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন। তার ভ্রমণকালে এখানকার সুলতান ছিলেন আবু মোজাফফর হাসান। সে সময় তিনি ওই অঞ্চলে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী রাজ্য চালাতেন।

সে সময় আফ্রিকান এ অঞ্চলটিতে খুব ভাল জাতের ঘোড়া পাওয়া যেত। এখান থেকে প্রসিদ্ধ ঘোড়া ভারতে রপ্তানি হত। মৌসুমী বায়ুর পরিবর্তন হলে ১৩৩০ সালে ওমান, হরমুজ প্রণালী হয়ে পুনরায় তিনি হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাত্রা করেন।

মক্কায় হজ্জ পালন শেষে আরো এক বছর অবস্থান করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেন ভারতবর্ষের সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে চাকরি করবেন। ১৩৩৬ সালে কাফেলার খোঁজে তৎকালীন আনাতোলিয়া বর্তমানে তুরস্কের দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে ব্যবসায়ীরা সচরাচর ভারতের উদ্দেশ্যে ব্যবসা করতে যেত।

সেখানকার খানদের আমিরের সাথে দেখা করেন তিনি। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন আমির উজবেক খানের রাজধানী সারা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইবনে বতুতা আমিরের সাথে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে আমির তাকেও সঙ্গে নেন।

১৩ শতকে প্রতিষ্ঠিত খান সাম্রাজ্য পরে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটির নাম হয় ব্লু হোর্ড, অপরটি হোয়াইট হোর্ড। ব্লু হোর্ড এলাকা ছিল বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ককেশাস, আরাল সাগর ও খিবা পর্যন্ত। ব্লু হোর্ড সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন সুলতান মুহাম্মদ উজবেক খান। যাত্রাপথে আস্ত্রখানে সুলতানের একটি মহল্লার (ভ্রাম্যমাণ গ্রাম) সাথে দেখা হয়ে যায় ইবনে বতুতার। সেই মহল্লাতেই সুলতান তুঘলক খানের সাথে ইবনে বতুতার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়। সেই সাথে তিনি সুলতানের স্ত্রীদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন এবং বিপুল পরিমাণ উপহারসামগ্রী পান। সুলতানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন কন্সট্যান্টিপোলের দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্রাট আন্দ্রোনিকা তৃতীয় মেয়ে বায়লুন।

বায়লুন সেই সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সুলতানের কাছে তিনি অনুমতি চান যেন এই সময়টা বাবার বাড়িতে কন্সট্যান্টিপোল এ কাটাতে পারেন। সুলতান অনুমতি প্রদান করেন। বায়লুনের কাফেলার সাথে ইবনে বতুতাকেও যাওয়ার অনুরোধ করেন সুলতান। এরপর তিনি ১৩৩৪ সালের শেষের দিকে কন্সট্যান্টিপোল এ পৌঁছান। এটাই ছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের বাইরে ইবনে বতুতার প্রথম সফর।

তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল শহরের বিভিন্ন জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন। তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন সেন্ট হেলেনা গির্জায় কথা। এই গির্জাটি নির্মাণ করেছিলেন আসাফ, বেরেচিয়াহর ছেলে। তিনি ছিলেন হযরত সুলাইমান (আঃ) এর ভাতিজা। গ্রিকদের যত গির্জা আছে সেন্ট হেলেনা তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চারদিক দিয়ে দেয়ালে ঘেরা গির্জাটি একটি ছোট শহরের মতো মনে হয়।

কিছুদিন কনস্ট্যান্টিনোপল থাকার পর ইবনে বতুতা আস্ত্রখানে ফিরে এসে দেখেন সুলতান তুঘলক তার রাজধানীতে সারাতে চলে গেছেন। তার রাজধানীতে গিয়ে সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতবর্ষ এবং চীনের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

সারা থেকে দীর্ঘ তিন মাস যাত্রা করে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে গজনি পৌঁছান তিনি। যাত্রাপথে তিনি তৎকালীন প্রসিদ্ধ শহর সমরকন্দ এবং আফগানিস্তানের কিছু সময় কাটান। ১৩৩৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর পাঞ্জাবে পৌঁছান ইবনে বতুতা। পাঞ্জাবে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই ইবনে বতুতার আগমনবার্তা মুলতানের গভর্নর এবং দিল্লির বাদশাহর কাছে পৌঁছানো হয়। তখন দিল্লির বাদশাহ ছিলেন মোহাম্মদ শাহ।

তখন বহিরাগত যে-ই হোক ভারতে ঢুকতে পারবে কি না সুলতানের তরফ থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। এছাড়া বহিরাগত ব্যক্তিকে কোন শ্রেণীর মর্যাদা দেয়া হবে তা সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হতো। ইবনে বতুতাকেও অপেক্ষা করতে হয় এবং তাকে সর্বশেষে আজিজ (সম্মানিত) পদবী দেয়া হলো।

পাঞ্জাবের হয়ে নলখাগড়ার জঙ্গল দিয়ে জননী শহরের মধ্য দিয়ে সাওয়াসিতান পৌঁছান। এখানে বিখ্যাত ডাক্তার আলা আল মুককের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তিনি পাঁচ দিন অবস্থান করেন। এরপর আবোহার হয়ে ভারতে এসে পৌঁছান। আবোহার ছিল সে সময় ভারতের মূল ভূখণ্ডের প্রথম শহর।

ভারতে এসে ইবনে বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেন। এখানকার সুলতানদের উদারতা তাকে মুগ্ধ করে। সে সময় সুলতান তাকে দুটি গ্রাম দিয়ে দেন যেন সেখান থেকে রাজস্ব আদায় করে নিজে ব্যয় করতে পারেন। এছাড়া এসময় সুলতান তাকে মালিকি সম্প্রদায়ের কাজী হিসেবে নিয়োগ দেন। কারণ পূর্ব থেকেই ইসলামী আইন শাস্ত্র সম্পর্কে এবং বিচারকার্য সম্পর্কে ইবনে বতুতার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। এছাড়া তার পিতাও একজন কাজী ছিলেন।

এরপর সুলতানের নির্দেশে দুটি জাহাজ করে চীনের সম্রাটের জন্য উপঢৌকন, কর্মচারী ও ক্রীতদাস নিয়ে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রওয়ানার উদ্দেশ্যে সমুদ্র তীরের দিকে যাওয়ার সময় ডাকাতদল কর্তৃক আক্রান্ত হন। এই আক্রমণে তিনি কোনো রকম প্রাণে বেঁচে যান। প্রায় দশদিন পর সঙ্গী-সাথীদের সাথে মিলিত হন এবং এরপর রওনা হন গুজরাটের দিকে।

সুলতানের মূল্যবান উপঢৌকোনগুলোর সুরক্ষার জন্য তিনি প্রায় পঞ্চাশজন হাবশি যোদ্ধা ভাড়া করেন এবং বেশ কিছুদিন যাত্রা করে অবশেষে কালিকোট বন্দরে এসে পৌঁছান, যেখান থেকে তার চীন যাত্রা করার কথা ছিল। ইবনে বতুতা যখন কালিকোটের মসজিদসমূহ পরিদর্শনে ব্যস্ত ছিলেন ঠিক তখন এক আচমকা ঝড় এসে সুলতানের মূল্যবান উপঢৌকোনসহ তার একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এর ফলে ঐ জাহাজের সব নাবিক মারা যায়। সুলতানের প্রেরিত সমস্ত উপহার হারিয়ে ফেলে তার আর দিল্লি ফেরৎ যাওয়া হলো না । তাই তিনি তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের শাসনকর্তা জামাল-উদ-দীনের অধীনে কিছুদিন থাকলেন। চীনের সম্রাটের কাছে পাঠানো উপহারসামগ্রী হারিয়ে ফেলার পর ভারত ছেড়ে যাওয়া ছাড়া ইবন বতুতার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। কিন্তু তিনি চীন যাওয়ার ইচ্ছার প্রতি অনড় ছিলেন। তাই তিনি অবশেষে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।

মালদ্বীপে তিনি প্রায় ৯ মাসের বেশি সময় অবস্থান করেছিলেন বলে জানা যায়। সে সময় মালদ্বীপ ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অধ্যুষিত এলাকা। তাকে মালদ্বীপের কাজী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ইবনে বতুতা তার নিবন্ধে বর্ণনা করেন, এখানকার মানুষরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। মেয়েরা শরীরের নিম্নাংশ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেও উপরের অংশ অনাবৃত রাখত। তিনি কাজী থাকা অবস্থায় অনেক ইসলামিক নিয়ম চালু করতে পারলেও কোনোভাবেই মেয়েদের পোশাক পরিবর্তন করতে পারেননি।

এসমস্ত ছোটখাট বিষয় নিয়ে মালদ্বীপের উজিরের সাথে ইবনে বতুতার মনোমালিন্য দেখা দেয়। এজন্য তিনি শ্রীলংকা হয়ে চীন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশেষে একটি জাহাজে করে শ্রীলংকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।

ইবনে বতুতা তার বিখ্যাত গ্রন্থে তৎকালীন বাংলা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তার বর্ণনা থেকেই বের হয়ে আসে তৎকালীন আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজব্যবস্থা, মানুষের জীবনাচরণ এবং রাজনৈতিক কাঠামো।

ইবনে বতুতা ৯ই জুলাই, ১৩৪৬ সালে বাংলায় এসে পৌঁছান। তিনি প্রথমে বাংলার যে অংশে প্রবেশ করেন তার গ্রন্থে তিনি সেই জায়গার নাম উল্লেখ করেছেন ‘সাঁদকাও’ (চাটগাঁও) সেখান থেকে তিনি কামরূপের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলেন।

তার গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন,

’একটানা ৪৩ দিন সাগরে ভেসে আমরা বাংলাদেশে এসে পৌঁছালাম। সবুজে শ্যামলে ঘেরা বিশাল এক দেশ। এখানে প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিস এত সস্তায় পাওয়া যায় যা অন্য কোথাও আমি দেখিনি। তবে দেশটির কিছু হতাশাব্যঞ্জক দিক রয়েছে খোরাসানের (আফগানিস্থান) লোকেরা দেশটিকে বলে ‘প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা জাহান্নাম’।’

ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায় তৎকালীন বাংলাদেশ ১ দিরহাম দিয়ে আটটি মুরগি পাওয়া যেত। এছাড়া এক দিরহাম দিয়ে ১৪টি কবুতর পাওয়া যেত। দুই দিরহামের পাওয়া যেত একটি ভেড়া। দাস-দাসী কিনতে পাওয়া যেত এক স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও কম মূল্যে।

তৎকালে এখানকার শাসক ছিলেন সুলতান ফখর-উদ্দিন। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করা। শাহজালাল (রহ.) এর পাহাড় থেকে অনেক দূরেই দুজন অনুচরের সাথে দেখা হয় ইবনে বতুতার। তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, শাহজালাল (রহ.) আদেশ দিয়েছেন পশ্চিম থেকে একজন পর্যটক তার সাথে সাক্ষাত করতে আসছেন। তারা যেন তাকে স্বাগত জানিয়ে তার দরবারে নিয়ে আসেন।

অথচ ইবনে বতুতার সাথে শাহজালালের (রহ.) ইতিপূর্বে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি এবং তার আগমনের কোনো খবরও তিনি শাহজালাল (রহ.)-কে দেননি। এখান থেকে ইবনে বতুতা শাহজালাল (রহ.) এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে অবগত হন।

শাহজালাল (রহ.) ইবনে বতুতাকে একটি ভেড়ার পশমের পোশাক উপহার দেন। ইবনে বতুতা তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,

’শাহজালাল (রহ.) একটি পাহাড়ে বসবাস করতেন। দুধ এবং মাখনের জন্য সেখানে ছাগল পুষতেন। তার সহযোগীরা ছিল সবাই সুঠাম দেহের অধিকারী। তারা কেউই এদেশীয় ছিল না।’

এরপর সেখান থেকে সোনারগাঁও আসেন তিনি। সেখানে কিছুদিন থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তার বর্ণনা মতে, সাঁদকাও আসা থেকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া পর্যন্ত প্রায় দুই মাস বাংলায় অবস্থান করেন (১৩৪৬ সালের জুলাই ও আগস্ট)

৪০ দিনের যাত্রা শেষে চট্টগ্রাম থেকে জাভা দ্বীপে এসে পৌঁছান তিনি। সেখানকার সুলতান ছিলেন আল-মালিক আল জহির। সুলতান তাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করেন। চীনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ছোট জাহাজসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করে দেন।

ইবনে বতুতার বর্ণনায় চীনের স্থাপত্য, নকশাশিল্প ও শিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া যায়। তিনি চিত্রকলার প্রশংসা করলেও চীনের খাদ্যভ্যাসকে উপভোগ্য মনে করেননি। চীনের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করলেও চীন তাকে কোনোভাবেই বিমোহিত করতে পারেনি। তা-ই স্পষ্ট বোঝা যায় তার বর্ণনা থেকে,

কেন যেন চীন নামক দেশটি আমাকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলো। দুঃখ হলো এই ভেবে যে, এত বিশাল একটি দেশ বিধর্মীদের কব্জায় পড়ে আছে। যখনই আমি বাইরে যেতাম তখনই খেয়াল করতাম কোনো দিকে কোনো বিদ্রোহের আভাস পাওয়া যায় কি না। তারপর হতাশা নিয়ে ফিরে আসতাম। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হতাম না।

ইবনে বতুতা চীনে পরিচিত ছিল শামস-উদ-দিন নামে। ধারণা করা হয় শামস-উদ-দিন থেকেই চীনা ভাষায় ‘শিং-শু-ডিং’ পরিবারের উৎপত্তি হয়েছে। অবশেষে ১৩৪৬ সালে তিনি তার নিজের দেশ মরোক্কোতে ফেরার জন্য সম্রাটের কাছ থেকে একটি জাহাজ চেয়ে নেন। জাহাজে করে তিনি কুয়ানজু থেকে পশ্চিমের দিকে রওনা দেন।

দু’মাস জাহাজে কাটিয়ে কুয়ানজু থেকে সুমাত্রায় এসে পৌঁছান। সেখানে দুই মাস কাটিয়ে ১৩৪৭ সালের এপ্রিলে ভারতে এসে পৌঁছান। এরপর ভারত থেকে একটি বাণিজ্যিক জাহাজে করে মাসকট, হরমুজ প্রণালী, ইস্পাহান হয়ে ১৩৪৮ সালে বাগদাদে এসে পৌঁছান।

১৩৪৮ সালের শুরুতেই তিনি দামেস্কে এসে পৌঁছান। সেখানে তার সাথে দেখা হয় তাঞ্জিয়ার এক বিখ্যাত শেখের সঙ্গে। তার মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন ১৫ বছর পূর্বেই তার বাবা মারা গেছেন। কিন্তু মা এখনও বেঁচে আছেন। ১৩৪৮ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি দামেস্কে ছিলেন। তখন ঐ সমস্ত অঞ্চলে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল কালাজ্বর। তার বর্ণনা মতে, প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২১,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর কায়রো থেকে মিশরের সাঈদ বন্দর হয়ে ১৩৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মক্কায় এসে পৌঁছান। মক্কায় হজ্জ সমাপ্ত করে ঐ বছরই ফেজ হয়ে নিজের দেশ জাঞ্জিয়ারে পৌঁছান। জাঞ্জিয়ারে পৌঁছানোর পর তিনি জানতে পারেন তার মা ইন্তেকাল করেছেন।

জীবনের পরবর্তী অংশগুলোতেও তিনি তার ভ্রমণ থামিয়ে রাখেননি। আল-আন্দালুজ, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, সাহারা মরুভূমি, মালিসহ সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন।

রিহলার বর্ণনা শেষ হওয়ার পর ইবনে বতুতার সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। উল্লেখ্য, তার বর্ণনা শেষ হয় ১৩৫৫ সালে। এরপর তিনি মরক্কোতে একজন কাজী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৩৬৮ সালে মরক্কোর মারকেশে ইন্তেকাল করেন এই বিখ্যাত পরিব্রাজক।


সূত্র : রোর মিডিয়া



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: