মহাশ্মশান মহাকাব্য কবি কায়কোবাদের অমর সৃষ্টি

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:২৭

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


বাংলা ভাষায় সর্ববৃহৎ মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’ এর রচয়িতা কবি কায়কোবাদ। কায়কোবাদ তৃতীয় পানি পথের যুদ্ধের বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে এই মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৯০। তৃতীয় পানি পথের যুদ্ধ হয়েছিল ভারতীয় মুসলমান ও মারাঠা শক্তির মধ্যে। সেই যুদ্ধে মারাঠারা মুসলমানদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিল। ‘মহাশ্মশান’ লিখে কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যে তার আসন অক্ষয় করে রেখে গিয়েছেন।

১৮৫৭ সালে কায়কোবাদ ঢাকা নওয়াবগঞ্জ থানার এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে ২১ জুলাই তিনি মহাপ্রয়ানে যাত্রা করেন। তার গ্রামের নাম আগলা পূর্বপাড়া। তার পিতার নাম শাহ রহমতউল্লাহ আল কোরায়শী ওরফে এমদাদ আলী। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন। মায়ের নাম জরিফুন্নেসা খাতুন।

কায়কোবাদ বাড়িতে আরবি ফারসি শিখতেন। তখন মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম মনে করত। তিনি গ্রাম থেকে ঢাকা এসে সদরঘাটের পগোজ স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই শুরু হয় তার প্রকৃত শিক্ষাজীবন। এক বছর পর পিতা মারা যান। তিনি গ্রামে ফিরে যান। গ্রামের এক মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেই সময় তিনি মাদ্রাসার পাঠ্য বইর চেয়ে বেশি কাব্য সাহিত্যের বই পড়তেন। কবিতা লেখার চেষ্টা করতেন। ধীরে ধীরে তার কবিতা লেখা এক রকম নেশা হয়ে পড়ল। ছাত্রজীবন থেকে তিনি কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে পড়েন।

এক সময় তার লেখা কবিতাসমূহ নিয়ে দুইটা ছোট কবিতার বই বের করেন। একটির নাম ছিল ‘কুসুমকানন’ অন্যটির নাম ‘বিরহবিলাপ’। তখনকার কাশিম বাজারের মহারানি কবিতা গ্রন্থ দুইটি পড়ে দশ টাকা এবং কাশীর ভুবনমোহনী চতুর্ধারিণী পাঁচ টাকা উপহার পাঠিয়ে এই কিশোর কবিকে অভিনন্দন জানান। ফলে কবির লেখনীস্পৃহা বেড়ে যায় বহুগুণে।

প্রবেশিক পরীক্ষা দিতে পারেননি। অল্প বয়সে পোস্ট মাস্টারের চাকরি নেন। গ্রামে থাকেন। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ঐ চাকরি করেন। যৌবনে কায়কোবাদ তার মামা হেদায়েত আলী বড় মেয়ে তাহেরুন্নেসা খাতুনকে বিয়ে করেন।

চাকরি জীবন এবং কবিতা লেখা একসঙ্গে চলতে থাকে। আমাদের স্কুল জীবনে কায়কোবাদের কবিতা পাঠ্য বইতে ছিল। আজও মনে পড়ে তার বিখ্যাত ‘আযান’ কবিতা:


‘ কে ঐ শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।
কি মধুর আযানের ধ্বনি!’


বাংলা সাহিত্যে কায়কোবাদকে ‘মহাকবি’ বলা হয়। তার প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়সী। মীর মোশাররফ, কায়কোবাদ, মোজম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছে সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তার মধ্যেই লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি কায়কোবাদ।

বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ তার ‘পাঁচ শত মনীষীর জীবন কথা’ গ্রন্থে মহাকবি কায়কোবাদ সম্পর্কে বলেন:

“চাকরি জীবন ও কবিতা লেখা এক সঙ্গে চলছিল। অনেক কবিতা জমা হয়ে গেছে। তিনি বই ছাপাতে মনস্থ করলেন। কয়েকজন প্রকাশকের কাছে গেলেন। কিন্তু কেউ তার বই ছাপাতে আগ্রহ দেখালেন না। শেষে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী তার বই প্রকাশে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর টাকায় কায়কোবাদ ১৩০২ বঙ্গাব্দে বের করলেন তার ‘অশ্রুমালা’ কাব্যগ্রন্থটি।’

অশ্রুমালা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর কায়কোবাদ কবি হিসেবে বেশ প্রশংসিত হন। দেশের নানা কবি সাহিত্যিক তার প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে তখনকার আলীপুর থেকে কবি নবীব চন্দ্র সেন কবিকে লিখেছিলেন –

‘মুসলমান যে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর কবিতা লিখতে পারে, আপনার বই ‘অশ্রুমালা’ না পড়লে তাহা বিশ্বাস হইত না।’

এই সকল প্রশংসাবলী কায়কোবাদ কাব্য রচনায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করলো। তিনি ভাবলেন, হ্যাঁ তাকে লিখতে হবে। লিখতে হবে এমনভাবে যাতে করে মুসলমানরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, তাদের অতীত ইতিহাস ছিল অত্যন্ত গৌরবমণ্ডিত।

কায়কোবাদ ছিলেন দেশের কবি, মানুষের কবি, মানবতার কবি। তিনি দেশ ও জাতিকে নিয়ে চিন্তা করতেন। দেশকে ভালোবাসতেন। দেশের মানুষের মর্যাদা, সম্মান, গৌরব কীভাবে ফিরে আসবে তা নিয়ে নিয়ত ভাবতেন, লিখতেন। তাই তার ‘দেশের বাণী’ কবিতায় তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে:

‘কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?
এ দেশের লোক যারা,
সকলইতো গেছে মারা,
আছে শুধু কতগুলো শৃগাল শকুনি!
সে কথা ভাবিতে হায়
এ প্রাণ ফেটে যায়,
হৃদয় ছাপিয়া উঠে- চোখ ভরা পানি।
কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!
এ দেশের লোক যত
বিলাস বাসনে রত
এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা।
দেশ গেল ছারেখারে,
এ কথা বলিব কারে?
ভেবে ভেবে তবু মোর হয়ে গেছে সারা!
প্রাণভরা হাহাকার
চোখ ভরা অশ্রুধার,
এ হৃদি যে হয়ে গেছে মরুভ‚মি-পারা!


মহাকবি কায়কোবাদ মাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ না হয়ে কাব্য সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেন। বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করে তিনি মুসলিম জাতিকে সাহিত্য চর্চার নতুন দর্শন দেখিয়ে গিয়েছেন। কিশোরকাল থেকে তার কবিতা তখনকার পাঠকসমাজে বহুল সমাদৃত। ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য আন্দোলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভ‚ষণ,’ ‘বিদ্যাভ‚ষণ,’ ও ‘সাহিত্যরতœ’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন।

কবির কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: বিরহ বিলাপ (১৮৭০) তার প্রথম কাব্য। কুসুমকানন (১৮৭৩), অশ্রুমালা (১৮৯৬), মহাশ্মশান (১৯০৪), শিবমন্দির বা জীবন্ত সমাধি (১৯২১), অমিয় ধারা (১৯২৩), শ্মশানভষ্ম (১৯২৪), মহররম শরীফ (১৯৩৩), শ্মশান ভসন (১৯৩৮), প্রেমের বাণী (১৯৭০), প্রেম পরিজাত (১৯৭০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

কোনো কোনো গবেষকদের মতে কবির অশ্রুমালা কাব্যগ্রন্থটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে। ‘বিরহ বিলাপ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রথম তার প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। কবির অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থ বৃটিশ আমলে প্রকাশিত হয়। তথ্য সূত্রে দেখা যায়, ‘প্রেমের বাণী’ ও ‘প্রেম পারিজাত’ এই দুইটি কাব্যগ্রন্থ ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত হয়েছে। কবি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।


যখন মুসলিম সমাজ নানাভাবে অবহেলিত ছিল, মুসলমানদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা ছিল না যখন ইংরেজি শেখা ‘হারাম’ বলে কিছু লোক ‘ফতোয়া’ দিত, তখনকার সমাজে একজন প্রগতিশীল, সৃজনশীল সৃষ্টিশীল কবি কায়কোবাদের আগমন। জাতিকে পথ দেখার জন্য, চলার শক্তি যোগানোর জন্য তার সকল সৃষ্টি। তাই তার কবিতায় বেজে ওঠে –


‘বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার জন্মভ‚মি।
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,
যাহার চরণ চুমি।
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,
যাহার পুণ্য গাথা!
সেই সে আমার জন্মভ‚মি,
সেই সে আমার মাতা!
আমার মায়ের সবুজ আঁচল
মাঠে খেলায় দুল!
আমার মায়ের ফুল বাগানে,
ফুটছে কতই ফুল!
শত শত কবি যাহার।
গেয়ে গেছে গাথা!
সেই সে আমার জন্মভ‚মি,
সেই সে আমার মাতা!
আমার মায়ের গোলা ছিল,
ধন ধান্যে ভরা!
ছিল না তার অভাব কিছু,
সুখে ছিলাম মোরা!
বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভ‚মি!
সূত্র: কবির লেখা- ‘বঙ্গভ‚মি ও ভঙ্গভাষা’ কবিতা

লেখক: আবুল কাসেম হায়দার 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: