গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। সে সময় কয়েকটি থানার পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। তখন তাদের অনেকেই থানাসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র ফেলে যায়। সুযোগ পেয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ১২ আগস্ট থেকে কয়েক দফায় সেই অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়েছে অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়।
গতকাল বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে পিস্তল, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, শটগান, গ্যাসগানসহ নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। একই দিন ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২ রাউন্ড গোলাবারুদ লুট হয়। এ ছাড়া সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল লুট হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লুণ্ঠিত এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ৩ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার অভিযান ছাড়াও অনেকে পুলিশ সদর দপ্তরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি জমা দিয়ে গেছেন। তবে জমা দেওয়ার সেই নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় এখনো বেহাত থাকা ২ হাজার ৬৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়েছে।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় তা উদ্ধারে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকেই দেশজুড়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে পুলিশের ব্যবহৃত বেহাত অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্রও উদ্ধার করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যেসব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বেসামরিক জনগণকে প্রদান করা হয়েছে, তাদের প্রদানকৃত লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট এ বিষয়ে লাইসেন্সধারীদের বার্তা পাঠিয়ে তাদের আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। যারা গতকাল পর্যন্ত সেই আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেননি, তাদের বিরুদ্ধেও যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছে।
গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির প্রথম সভা শেষে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা এবং কমিটির আহ্বায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আজ (গতকাল)। রাত ১২টা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করবে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে সারা বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে করণীয়, অস্ত্র জমা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায়, মাদকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, মিয়ানমার সীমান্ত ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছর ধরে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়ে অনেকেই তা জমা দিয়েছেন। কতজন জমা দিয়েছেন, সেই তালিকা তৈরি হচ্ছে। কারা নির্দেশ অমান্য করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেননি, সেই তালিকাও তৈরি হচ্ছে। এরপর তালিকা ধরে অভিযান চালানো হবে। যারা জমা দেননি, তাদের অস্ত্র অবৈধ বলে গণ্য হবে এবং অস্ত্র আইনে মামলা হবে।
এদিকে, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানের নির্দেশ পাওয়ার পর এরই মধ্যে গত সোমবার স্থানীয় প্রশাসন পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, কোস্টগার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও আনসার বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করে অভিযানের করণীয় ঠিক করেছে। সে অনুযায়ী যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো হবে।
পুলিশের যেসব অস্ত্র-গুলি লুট: পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে চায়না রাইফেল (৭.৬২ পয়েন্ট ৩৯ মি.মি) ১ হাজার ১৪৭টি, ৭.৬২ পয়েন্ট ৩৯ মি.মি বাংলাদেশি টি-৮ রাইফেল ১০টি, চায়না এসএমজি ২৫১টি, চায়না এলএমজি ৩২টি, ৭.৬২ পয়েন্ট ২৫ মি.মি এবং ৯ পয়েন্ট ১৯ মি.মি পিস্তল ১ হাজার ৫৫৬টি, ৯ পয়েন্ট ১৯ মি.মি এসএমজি/এসএমটি ৩২টি, ১২ বোরের শটগান ২ হাজার ১৯০টি, সিঙ্গেল শটের ৩৮ মি.মি গ্যাসগান ৫৯৩টি। এ ছাড়া সিক্স শটের ৩৮ মি.মি টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার ১৫টি এবং ৩টি ২৬ মি.মি সিগন্যাল পিস্তল রয়েছে।
এর বাইরে বিভিন্ন বোরের ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪২ রাউন্ড গুলি, বিভিন্ন ধরনের টিয়ার গ্যাসের শেল ৩১ হাজার ৪৪টি, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ১ হাজার ৪৫৫টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৪ হাজার ৬৯২টি, কালার স্মোক গ্রেনেড ২৯১টি, মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড ৫৫টি, ফ্লাশ ব্যাং গ্রেনেড ৮৯৩টি এবং ১৭৭টি হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে লুট হয়।
এখন পর্যন্ত বেহাত যেসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ: পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে এখনো ৩৩৮টি চায়না রাইফেল (৭.৬২ পয়েন্ট ৩৯ মি.মি), একটি ৭.৬২ পয়েন্ট ৩৯ মি.মি বাংলাদেশি রাইফেল, ৬৬টি চায়না এসএমজি, ১১টি চায়না এলএমজি, ৮৪৯টি সেভেন পয়েন্ট ৬২ এবং নাইন পয়েন্ট ওয়ান নাইন পিস্তল, একটি নাইন পয়েন্ট ওয়ান নাইন মি.মি এসএমজি/এসএমটি, ৬২২টি ১২ বোরের শটগান, ১৬৮টি সিঙ্গেল শটের ৩৮ মি.মি গ্যাসগান, ৮টি সিক্স শটের ৩৮ মি.মি টিয়ার গ্যাস লাঞ্চার এবং ২টি ২৬ মি.মি সিগন্যাল পিস্তল।
এ ছাড়া বিভিন্ন বোরের ৩ লাখ ২০ হাজার ৬৬০ রাউন্ড গুলি, বিভিন্ন ধরনের ৮ হাজার ৯০৫টি টিয়ার গ্যাসের শেল, ৭৫১টি টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড, ২ হাজার ৫৭৬টি সাউন্ড গ্রেনেড, ৭৮টি কালার স্মোক গ্রেনেড, ৩৭টি মাল্টিপল ব্যাং স্টান গ্রেনেড, ৩৬০টি ফ্লাশ ব্যাং গ্রেনেড এবং ৮৩টি হ্যান্ড হেল্ড টিয়ার গ্যাস স্প্রে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: