
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে উপসাগরীয় অঞ্চলে লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিকের জীবনকে একটি একক শব্দ সংজ্ঞায়িত করেছে, কাফালা—আরবিতে যার অর্থ ‘পৃষ্ঠপোষকতা’। এই ব্যবস্থাটি নির্ধারণ করত যে শ্রমিকরা কাজ পরিবর্তন করতে পারবে কি না, দেশ ছাড়তে পারবে কি না, বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে কি না। সমালোচকরা এই ব্যবস্থাটিকে ‘আধুনিক দাসত্বের’ সঙ্গে তুলনা করতেন।
জুন মাসে সেই কাফালা প্রথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরবে বিলুপ্ত করা হয়েছে।
দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ বিদেশি শ্রমিকের জীবনে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
কাফালাব্যবস্থা কী ছিল
কাফালাব্যবস্থা ছিল একটি আইনি কাঠামো, যা উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে অভিবাসী শ্রমিকদের চাকরি এবং বসবাসের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৫০-এর দশকে তেল-সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো শহর ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সস্তা শ্রমের প্রয়োজন অনুভব করলে এই প্রথার উদ্ভব হয়। তবে এই দেশগুলো শ্রমিকদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি বা নাগরিকত্ব দিতে চাইত না।
কাফালাব্যবস্থার অধীনে, একজন বিদেশি শ্রমিকের আইনি অবস্থান সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়োগকর্তা বা ‘কাফিল’ এর সঙ্গে বাঁধা থাকত। এই পৃষ্ঠপোষক শ্রমিকের ভিসা, দেশে বসবাসের অধিকার এবং প্রায়ই কাজ পরিবর্তন বা দেশ থেকে বের হওয়ার ক্ষমতাও নিয়ন্ত্রণ করত। পৃষ্ঠপোষকের অনুমোদন ছাড়া শ্রমিকরা নিয়োগকর্তা পরিবর্তন করতে পারতেন না, দেশ ত্যাগ করতে পারতেন না (অনেকেরই ‘এক্সিট ভিসা’ প্রয়োজন হতো) এবং নির্যাতিত হলে আইনি প্রতিকার চাইতে পারতেন না।
এই ব্যবস্থাটি সরকারি আমলাতন্ত্র কমিয়ে ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকদের মাধ্যমে শ্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে, এটি ক্ষমতার একটি বিশাল ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছিল। নিয়োগকর্তারা পাসপোর্ট জব্দ করতে পারতেন, মজুরি আটকে রাখতে পারতেন বা দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারতেন এবং শ্রমিকদের তাদের চ্যালেঞ্জ করার কার্যত কোনো সুযোগ ছিল না।
এটি কেন এত বিতর্কিত ছিল
গত কয়েক দশক ধরে কাফালা বিশ্বের অন্যতম সমালোচিত শ্রম ব্যবস্থায় পরিণত হয়। মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) উপসাগরীয় সরকারগুলোর বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতার আড়ালে জোরপূর্বক শ্রম ও মানব পাচারকে উৎসাহিত করার অভিযোগ আনে।
যেহেতু শ্রমিকরা অনুমতি ছাড়া কাজ ছাড়লে গ্রেপ্তারের বা দেশ থেকে বহিষ্কারের ঝুঁকিতে থাকতেন, তাই অনেকেই শোষণমূলক বা অপমানজনক পরিস্থিতিতে থাকতে বাধ্য হতেন—বিশেষত গার্হস্থ্য কাজ, নির্মাণ এবং কৃষিক্ষেত্রে।
চরম ক্ষেত্রে, এনজিওগুলো বন্ধককৃত দাসত্বের মতো পরিস্থিতির নথিও প্রকাশ করেছে।
এর মাত্রা ছিল বিশাল। সৌদি আরবে প্রায় এক কোটি ৩৪ লাখ অভিবাসী শ্রমিক বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ। লাখ লাখ শ্রমিক ভারত, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইন সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আসেন। আনুমানিক ৪০ লাখ গার্হস্থ্য শ্রমিক প্রায়শই বিচ্ছিন্ন এবং নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে।
সৌদি আরব কেন এটি বিলুপ্ত করছে
২০২৫ সালের জুনে কাফালা বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্তটি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিস্তৃত পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’-এর অংশ। এর লক্ষ্য হলো সৌদি অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করা, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং দেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি আধুনিকায়ন করা।
এই পদক্ষেপ ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিফলনও। উচ্চ-পর্যায়ের ইভেন্ট এবং অংশীদারিত্বের আগে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের শ্রম রেকর্ড নিয়ে বৈশ্বিক অধিকার গোষ্ঠী, পশ্চিমা সরকার এবং এমনকি বহুজাতিক সংস্থাগুলোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কাতার ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপের আগে আংশিক সংস্কার করেছিল।
নতুন ব্যবস্থায় কী পরিবর্তন এসেছে
সৌদি আরব বলছে, তারা কাফালাকে একটি চুক্তি-ভিত্তিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপন করছে, যার লক্ষ্য শ্রমিকদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
মূল পরিবর্তনগুলির মধ্যে রয়েছে : কাজ পরিবর্তনের স্বাধীনতা—শ্রমিকরা তাদের বর্তমান নিয়োগকর্তার অনুমোদনের প্রয়োজন ছাড়াই নতুন নিয়োগকর্তার কাছে যেতে পারবেন। দেশ ছাড়ার স্বাধীনতা— তারা এক্সিট ভিসা বা পৃষ্ঠপোষকের সম্মতি ছাড়াই দেশ ত্যাগ করতে পারবেন। আইনি সুরক্ষা— শ্রমিকরা শ্রম আদালত এবং অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়ায় উন্নত প্রবেশাধিকার পাবেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংস্কারগুলো উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, শোষণ হ্রাস করবে এবং বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সৌদি আরবের সুনাম বৃদ্ধি করবে।
আসলে কতটা পরিবর্তন হবে
এই ঘোষণাটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হলেও, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, শুধুমাত্র আইনি সংস্কার রাতারাতি নির্যাতনের অবসান ঘটাবে না।
অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এটি বাস্তবায়নে ফাঁক রয়ে গেছে — অনেক নিয়োগকর্তা এখনও কাজ পরিবর্তনের জন্য সম্মতি চান বা এক্সিট ভিসা নিয়ন্ত্রণ করেন। সবচেয়ে দুর্বল গার্হস্থ্য শ্রমিকরা নতুন সুরক্ষা থেকে সমানভাবে উপকৃত নাও হতে পারে।
উৎস দেশগুলোতে (যেমন ভারত, বাংলাদেশ) উচ্চ ফি এবং চুক্তি পরিবর্তনের মতো নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্যাতন এখনো প্রচলিত এবং সৌদি আইন দ্বারা তা মোকাবিলা করা হচ্ছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ‘আইন পরিবর্তন করা প্রথম ধাপ। মাঠের বাস্তবতা পরিবর্তন করতে আরো অনেক সময় লাগবে।’
কেন এই পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশের লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের জন্য কাফালা বিলুপ্তি শুধু একটি আইনি সংস্কার নয়, এটি দীর্ঘকাল ধরে অস্বীকৃত মৌলিক অধিকারের পুনরুদ্ধার। একজন নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার, স্বাধীনভাবে দেশ ত্যাগ করার বা ভয় ছাড়াই ন্যায়বিচার চাওয়ার ক্ষমতা উপসাগরীয় অর্থনীতিগুলো শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে তাদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন সূচিত করবে।
সৌদি আরবের জন্য এটি বিশ্বকে একটি সংকেত যে দেশটি আধুনিকায়নের বিষয়ে গুরুতর এবং বুঝতে পেরেছে যে অর্থনৈতিক সংস্কার অবশ্যই মানবাধিকার সংস্কারের সঙ্গে হাতে হাত রেখে চলতে হবে। তবে কর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কর্মীরা যেমনটি বলছেন, এটি কাফালা কাহিনীর শেষ নয়—এটি একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু। আসল পরীক্ষা হবে সৌদি আরব বাস্তবে এই অধিকারগুলো কতটা কার্যকর করে এবং অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের অনুসরণ করে কিনা।
কাফালা ব্যবস্থার বিলুপ্তি নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রম সংস্কার। এটি লাখো দুর্বল অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং আইনি সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে আইন এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যেকার ব্যবধান একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, যা শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় শ্রম ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়কে সংজ্ঞায়িত করবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: