
ভারতের প্রাচীনতম শেয়ারবাজারগুলোর একটি ‘কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ’ (সিএসই) শতবর্ষের ইতিহাসে শেষ দীপাবলি ও কালীপূজা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে আজ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা আইনি জটিলতার অবসান ঘটিয়ে এক্সচেঞ্জটি এখন স্বেচ্ছায় কার্যক্রম বন্ধের পথে।
২০১৩ সালের এপ্রিলে ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (সেবি) নিয়ম না মানার অভিযোগে সিএসইতে শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে। এরপর থেকে এক্সচেঞ্জটি আদালতে নানা আইনি লড়াই চালালেও পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। অবশেষে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিএসই চেয়ারম্যান দীপঙ্কর বোস বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখের জরুরি সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে অনুমোদনও পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেবির কাছে আবেদন জমা দিয়েছি। সেবি বর্তমানে সম্পদের মূল্যায়নের জন্য একটি সংস্থাকে নিযুক্ত করেছে এবং সেই প্রক্রিয়া চলছে।
সেবি অনুমোদন দিলে, এক্সচেঞ্জটি হোল্ডিং কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। যদিও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিএসই ক্যাপিটাল মার্কেটস প্রাইভেট লিমিটেড (সিসিএমপিএল) এনএসই এবং বিএসইতে ব্রোকারেজ ব্যবসা চালিয়ে যাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিএসইর তিন একর ইএম বাইপাস সম্পত্তি সৃজন গ্রুপের কাছে ২৫৩ কোটি টাকায় বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে, যা সেবির অনুমোদনের পর এগিয়ে যাবে।
শতবর্ষের উত্তরাধিকার ও পতনের ইতিহাস
এক সময় কলকাতার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই স্টক এক্সচেঞ্জ ১৯০৮ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। বহু বছর ধরে এখানে রাজত্ব করেছে ছোট ও মাঝারি শিল্পের শেয়ার লেনদেন। কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ একসময় বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এবং কলকাতার অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে ১২০ কোটি টাকার কেতন পারেখ কেলেঙ্কারির পর এর পতন শুরু হয়। সে সময় বহু ব্রোকার লেনদেন নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয় এবং এক্সচেঞ্জ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
৯০-এর দশকের লায়ন্স রেঞ্জে জমজমাট ট্রেডিং ফ্লোরের স্মৃতি মনে করে অভিজ্ঞ স্টকব্রোকার সিদ্ধার্থ থিরানি বলেন, প্রতিদিন সকালে মা লক্ষ্মীর পূজা দিয়ে আমরা ট্রেডিং শুরু করতাম। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সেবি লেনদেন স্থগিত করলে সব থেমে যায়। এবারের দীপাবলি যেন সেই ঐতিহ্যকে বিদায় জানানোর অয়োজন।
আইনি লড়াইয়ের সমাপ্তি
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সিএসই বোর্ড কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে চলমান মামলা প্রত্যাহার করে স্বেচ্ছা প্রস্থান প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবছর ১৮ ফেব্রুয়ারি সেবির কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দেয় এক্সচেঞ্জটি এবং ২৫ এপ্রিল শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন পায়। সেবি বর্তমানে রাজবংশী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামের সংস্থাকে মূল্যায়নের দায়িত্ব দিয়েছে, মূল্যায়ন শেষ হলেই প্রস্থান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
চূড়ান্ত প্রস্তুতি
২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রতিবেদনে চেয়ারম্যান দীপঙ্কর বোস উল্লেখ করেন, এক্সচেঞ্জটি ভারতের মূলধন বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে সিএসইতে ১,৭৪৯টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ৬৫০ জন নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে। বোস নিজে এ সময়ে ৫.৯ লাখ রুপি পরিচালক ফি পেয়েছেন।
প্রস্থান প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এক্সচেঞ্জটি কর্মীদের জন্য স্বেচ্ছা অবসর ঘোষণা করে, যেখানে ২০.৯৫ কোটি রুপি এককালীন প্রদান ও বছরে প্রায় ১০ কোটি রুপি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সকল কর্মীই এই পরিকল্পনায় অংশ নেন, তবে কয়েকজনকে চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত কার্যক্রমে রাখা হয়েছে।
এইভাবে, ১০০ বছরের ইতিহাস গড়ে তোলা কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ এবার এক যুগের অবসান ঘটিয়ে শেষ দীপাবলি উদযাপন করতে যাচ্ছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: