সাউথপোর্টে ছুরি হামলা: যুক্তরাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ, লন্ডনে শতাধিক গ্রেপ্তার

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২ আগস্ট ২০২৪ ০৮:০১

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

যুক্তরাজ্যের সাউথপোর্টে নৃত্য প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ছুরিকাঘাতে তিন শিশুকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। লন্ডনে এ বিক্ষোভ থেকে শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় ১৭ বছরের এক কিশোরকে অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার ডার্বি স্কয়ারের লিভারপুল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করার পর অভিযুক্ত কিশোরকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

গত সোমবার মার্সিসাইড শহরের সাউথপোর্টের হার্ট স্ট্রিটে একটি নৃত্য প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ছুরি হামলা হয়। ঘটনায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে হত্যা ও খুনের চেষ্টার সন্দেহভাজন হিসেবে ল্যাঙ্কাশায়ারের ব্যাঙ্কস থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে একটি ছুরিও জব্দ করা হয়।

এই ছুরিকাঘাতে এলিস দাসিলভা আগুয়ার (৯), বেবে কিং (৬) ও এলসি ডট স্ট্যানকম্ব (৭) নামের তিন শিশু নিহত হয়।

এসময় আরও আটটি শিশু ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও গুরুতর আহত হয়েছেন।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাউথপোর্টে বিক্ষোভ শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। ক্রমে হার্টলপুল, ম্যানচেস্টার এবং অ্যালডারশটেও সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

অভিযুক্ত হামলাকারী একজন উগ্র ইসলামপন্থি অভিবাসী বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর মঙ্গলবার স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ক্লিভল্যান্ড পুলিশ জানিয়েছে, হার্টলপুলে পুলিশের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র, কাঁচের বোতল ও ডিম ছুঁড়ে হামলা চালানো হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যায় হার্টলপুলের মারে স্ট্রিট এলাকায় একটি বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মানুষেরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এসময় তারা একটি পুলিশ গাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে।

ম্যানচেস্টার ইভিনিং নিউজ জানিয়েছে, ম্যানচেস্টারে ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওল্ডহ্যাম রোডের হলিডে ইন হোটেলের বাইরে বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী জড়ো হয়।

গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বালাক্লাভাস পরিহিত প্রায় ৪০ জন শিশু ও পুরুষ ওল্ডহাম রোড প্রাঙ্গণের বাইরে জড়ো হয়েছিল।

এতে আরও বলা হয়েছে, 'বর্তমানে হোটেলে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এসব মানুষ অবস্থান নিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে'।

অ্যালডারশটের স্থানীয় এমপি অ্যালেক্স বেকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, 'বিশৃঙ্খল আচরণের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই এবং পুরো অ্যাল্ডারশট এবং ফার্নবরোর পরিস্থিতি এরকম নয়।'

তিনি এক্স-এ শেয়ার করা একটি বিবৃতিতে বলেছেন, 'আমি আজ সন্ধ্যায় অলডারশটের পটার ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ে হ্যাম্পশায়ার পুলিশের সাথে যোগাযোগ করছি। সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও ভীতিজনক রূপ নিয়েছিল।'

তিনি বলেন, 'আমি নিজে আজ সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং প্রধান পরিদর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এই ঘটনায় আমাদের সম্প্রদায়ের বাইরের অনেক লোক উপস্থিত ছিল, যারা এখানে অশান্তি সৃষ্টি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম করা সাহসী পুলিশ অফিসারদের আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই।'

তিনি লিখেছেন, 'বিশৃঙ্খল আচরণের কোনো যৌক্তিকতা নেই এবং এই ঘটনাগুলো পুরো অ্যালডারশট এবং ফার্নবারোর প্রকৃত চিত্র নয়। আমরা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার আমাদের যৌথ অধিকারকে সমর্থন করি। তবে আমরা আমাদের শহরে আসা বাইরের সেসব লোকদের পক্ষ নেবো না, যারা এখানে ঝামেলা সৃষ্টি করতে এবং আমাদের সম্প্রদায়কে বিভক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।'

বুধবার লন্ডনে 'এনাফ ইজ এনাফ'- শিরোনামে একটি বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিন হোয়াইটহলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মেট্রোপলিটন পুলিশ বলেছে, 'সহিংস বিশৃঙ্খলা, জরুরি সেবাদান কর্মীকে লাঞ্ছিত করা এবং বিক্ষোভের পরিস্থিতি লঙ্ঘনসহ অপরাধের জন্য ১০০ জনেরও বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েকজন অফিসার সামান্য আহত হয়েছেন।'

বিক্ষোভকারীদের ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে রায়ট গিয়ার পরিহিত পুলিশের লাইন লক্ষ্য করে বিয়ারের ক্যান ও কাচের বোতল ছুঁড়তে এবং পার্লামেন্ট স্কয়ারে উইনস্টন চার্চিলের মূর্তিতে ফ্লেয়ার নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে।

ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা এসময় 'আমরা আমাদের দেশ ফিরে চাই' এবং 'ওহ টমি রবিনসন' উচ্চস্বরে প্রভৃতি স্লোগান দিচ্ছিলেন।

ক্লিভল্যান্ড পুলিশ আরও জানিয়েছে, বুধবার হার্টলপুলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর নাগরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং মারামারি করাসহ বিভিন্ন অপরাধে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

রাস্তায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও ওই এলাকায় এখনও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলে জানিয়েছে বাহিনীটি।

চিফ সুপারিনটেনডেন্ট ডেভিড সাদারল্যান্ড বলেন, 'এই পর্যায়ে আমরা বিশ্বাস করি যে এই সপ্তাহের শুরুতে সাউথপোর্টের ঘটনার সঙ্গে বিক্ষোভের সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা আমাদের সদস্যদের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র, কাচের বোতল এবং ডিম নিক্ষেপ করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সুরক্ষা রক্ষায় ওই এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ম্যানচেস্টারে স্থানীয় কাউন্সিলর জন ফ্লানাগান সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়েছেন।

তিনি এই 'জঘন্য' ঘটনার সাথে জড়িতদের 'নির্বোধ' বলে অভিহিত করেছেন।

নিউটন হিথের কাউন্সিলর বলেন, 'আমি এই নির্বোধ গুণ্ডাদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই, যারা আশ্রয়প্রত্যাশী নিরপরাধ মানুষদের ওপর আক্রমণ করছে। তারা কয়েক মাস ধরে সেখানে রয়েছে এবং আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি।'

তিনি বলেন, 'ভাবতে খারাপ লাগে যে শুধু জাতি বা ধর্মের কারণে তাদের (মুসলমান অভিবাসী) লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। আমি আশা করি এটি সাউথপোর্টের লজ্জাজনক ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, যেখানে গত রাতে একটি মসজিদে হামলা হয়েছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'এই নির্বোধরা নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া জিএমপির সাথে যোগাযোগ করেছি এবং তাদের সমর্থন করেছি। পুরো শহর এবং যুক্তিবাদী মানুষ এই কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত ও বিরক্ত হবে। আশা করি পুলিশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করবে।'

কাউন্সিলর বলেন, আমরা আমাদের দেশ ও শহরকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে পারি না।
সাউথপোর্টে সহিংস বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইট, পাথর ও বোতল নিক্ষেপ এবং গাড়িতে আগুন প্রভৃতিতে পুলিশ কর্মকর্তারা গুরুতর আহত হন।

দ্বিতীয় রাতে দাঙ্গা এড়ানোর চেষ্টায় মার্সিসাইড পুলিশকে বুধবার ফৌজদারি বিচার ও পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট ১৯৯৪ এর এস ৬০ এর অধীনে অস্ত্র বহনকারী সন্দেহভাজনদের থামানোর এবং তল্লাশি করার অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।

কমিউনিটি ইন্সপেক্টর ডগ চ্যাডউইক বলেছেন, দাঙ্গার 'লজ্জাজনক' দৃশ্য দেখে জনগণ 'হতবাক ও হতাশ'।

সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব সহিংসতায় ৫৩ জন কর্মকর্তা এবং তিনটি পুলিশ কুকুর আহত হয়েছে।

বিক্ষোভের মধ্যেই ছুরি হামলায় অভিযুক্ত কিশোরকে লিভারপুল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির করা হয়।

পুলিশের দাবি, ছুরি হামলার ঘটনাটি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং সন্দেহভাজন হামলাকারীর জন্ম যুক্তরাজ্যেই।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: