প্রাচ্যবিদদের একটি পুরনো অভিযোগ হলো মধ্যযুগে মুসলিমসমাজে বিজ্ঞানচর্চা ছিল একটি প্রান্তিক কার্যক্রম, যা একটি ছোট্ট অভিজাত বৃত্তে আবদ্ধ ছিল। সমাজে তা শেকড় গাড়তে পারেনি। সর্বশ্রেণির ভেতর সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। তাদের অভিযোগের উত্তরে দার্শনিক আল-আমিন (মৃত্যু ৯৯২ খ্রি.) লেখেন, ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ইসলাম ও মুসলমানের জন্য শুধু প্রার্থিত বিষয় ছিল না; বরং তাকে মুসলমানের জন্য মানসিক প্রশান্তি ও আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির স্বীকৃতি ও সীমাহীন ক্ষমা লাভের মাধ্যম মনে করা হতো।’
বিজ্ঞানের প্রতি মুসলমানের এই মনোভাব ও সমাজে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের ধারণা পাওয়া যায় ইসলামী সাহিত্যের বইগুলোতেও। সাহিত্যের বইগুলোতেই প্রকৃত সমাজচিত্র দৃশ্যায়িত হয়। তাতে সর্বশ্রেণির মানুষ, তাদের জীবনচক্রের নানা বিষয় ও উপাদান বিচিত্র আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়, যা একই সঙ্গে শিক্ষিত মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ প্রদান করে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে দুটি বিশেষ সাহিত্যকর্মের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে :
ক. আহমদ আল-তিফাসি (মৃত্যু ১২৫৩ খ্রি.) রচিত ‘ফসল আল-খিতাব’,
খ. জামালুদ্দিন ওয়াত্তাত (মৃত্যু ১৩১৮ খ্রি.) ‘মাবাহিস আল-ফিকার ওয়া মানাহিজ আল-ইবার’।
তিফাসি তাঁর গ্রন্থে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জলবায়ু বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অ্যারিস্টটলের মহাজাগতিক চিন্তা ও ‘ডাবল এক্সহেলেশন’ তত্ত্বের ওপর নির্ভর করেছেন। আর আল-ওয়াত্তাতের গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে চারটি বিষয়। তা হলো—জান্নাত, পৃথিবী, প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ। এ ক্ষেত্রে তিনি আল-কিন্দি ও ইবনে সিনার অনুসরণ করেছেন।
এই গ্রন্থগুলোতে হয়তো বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবে একজন মানুষ অবশ্যই বুঝতে পারবে মুসলিমসমাজে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, গদ্য, পদ্য ও সাহিত্যের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এমন এক শ্রেণির মানুষের শিক্ষার অংশ ছিল, বিজ্ঞানের প্রতি যাদের বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না। এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে মুসলিমসমাজে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো চর্চায় কোনো বাধা ছিল না। ইসলাম বিজ্ঞানকে ধর্মবিরোধী মনে করত না। বরং বিজ্ঞান ছিল সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়া এমন একটি বিষয়, যার চর্চায় মানুষ মানসিক প্রশান্তি ও জ্ঞানানন্দ খুঁজে পেত।
আল-তিফাসি ১১৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিউনিসিয়ার গাসফায় (প্রাচীন কাসফা) জন্মগ্রহণ করেন। তিউনিসিয়া তখন আলমুদিদের শাসনাধীন। আলমুদি খলিফারা তিফাসির পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। জন্মস্থান তিফাসিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিউনিস যান। পরবর্তী সময়ে তিনি মিসর হয়ে দামেস্ক যান। শিক্ষা সমাপণের পর আহমদ আত-তিফাসি গাসফার বিচারক পদে নিয়োগ পান। শাসক পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় তিনি গাসফা ত্যাগে বাধ্য হন এবং মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার সময় জাহাজডুবিতে সন্তানদের হারান। সৌভাগ্যক্রমে বেদুইনরা আল-তিফাসিকে রক্ষা করে এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে দেয়।
মিসরের আইয়ুবীয় শাসক সুলতান কামিল মুহাম্মদ আল-মালিক তাঁকে আশ্রয় দেন। একসময় তিনি সুলতানের নৈকট্য অর্জন করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কায়রোতে স্থায়ী হন। তখন কায়রো ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ফলে নানা দেশের বিচিত্র মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি তাদের কাছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। যেমন তিনি রত্ন পাথর সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করেন এবং ‘আজহার আল-আলকার ফি জাওয়াহির আল-আহজার’ নামে বই লেখেন। মিসরে অবস্থানের সময়ই তিনি ‘ফাসলুল খিতাব’ রচনা করেন।
আল-তিফাসি ছিলেন একজন অনুসন্ধিত্সু ও নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে আগ্রহী। তিনি প্রচুর বই পড়তেন এবং সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশে অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা সাহিত্যপূর্ণ রসাল গদ্যে বর্ণনা করতেন। তিনি তাঁর বইয়ে যা লিখেছেন তা মূলত সমাজের সাধারণ মানুষেরই চিন্তা। এমনকি তাঁর বইয়ে বহু কুসংস্কারও আছে।
তিফাসির ‘ফাসলুল কিতাব’ বইয়ের বড় একটি অংশজুড়ে আছে বিজ্ঞানের আলোচনা, যা তৎকালীন সমাজে বিজ্ঞানচিন্তা ও চর্চার পরিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মিসরীয় সমাজের তৃণমূল পর্যায়েও যে বিজ্ঞানচর্চা হতো তা স্পষ্টত প্রমাণ করে।
আহমদ আল-তিফাসির ‘সুরুর আল-নাফস’ বইটি থেকেও মধ্যযুগে মুসলিমসমাজে বিজ্ঞানচর্চার পরিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সুরুর আল-নাফস সাহিত্যবিষয়ক রচনার অন্তর্ভুক্ত। যেখানে একজন বক্তা একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষের সামনে জ্ঞানের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে মানসিক তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করছেন। সুরুর আল-নাফস বইয়ে রাত, দিন, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, ঋতুগুলো, বজ্র, আলো, বৃষ্টি, বাতাস ও আগুন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি এসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন বিজ্ঞান, যুক্তি, ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অসংখ্য গদ্য ও পদ্য উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে ইয়াহইয়া আল-আনসারি, যিনি আল-ওয়াত্তাত নামে পরিচিত তিনি ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর উপাধি ছিল জামালুদ্দিন কুতুবি।
আল-ওয়াত্তাত ছিলেন একজন লিপিকার। বিভিন্ন বই ও পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এটাই তাঁকে বই সংগ্রহ, বিস্তৃত পাঠ ও জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দেয়। ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।
তাঁর ‘মাবাহিস আল-ফিকার ওয়া মানাহিজ আল-ইবার’ বইটি একই সঙ্গে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। বইয়ে উদ্ধৃতি গদ্য ও পদ্যের আবেশ আছে এবং বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনায় আছে তথ্য ও তত্ত্বের সমারোহ। এ ক্ষেত্রে বইয়ের ‘নুজহাত আল-উয়ুন ফি আরবাআত ফুনুন’ অধ্যায়টি অনবদ্য। অধ্যায়টিতে সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে।
সুতরাং বোঝা গেল, বিজ্ঞান মধ্যযুগে মুসলিমসমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের চর্চার বিষয় ছিল না; বরং তা সাধারণ শ্রেণির মানুষের শিক্ষার বিষয় ছিল। ফলে গদ্য-পদ্যের মতো নিছক সাহিত্যেও তার প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়।
তথ্য : মুসলিম হেরিটেইজ ডটকম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: