পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে ৪০ মাইল দূরে অ্যাব্রোলহস দ্বীপপুঞ্জটি বিশ্বের একটি বিশেষ অংশ। ধারণা করা হয়, সমুদ্রের ২৫ শতাংশ প্রজাতি প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে বা এর আশপাশে বাস করে। প্রবাল শুধু দেখতেই যে সুন্দর, তা নয়। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে এর অবদানও অসামান্য। প্রবালপ্রাচীর সমুদ্রের দুর্যোগপূর্ণ ঢেউ এবং বন্যার ক্ষতি থেকে উপকূলকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রক্ষা করে। সামুদ্রিক জীব ছাড়াও প্রবালপ্রাচীর লাখো মানুষের খাদ্য ও জীবিকার উৎস।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রের লবণাক্ততা বাড়ার কারণে ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। মনে করা হচ্ছে, ২০৭০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে পারে সমুদ্রের মহামূল্যবান প্রবালপ্রাচীর। অস্ট্রেলিয়ার জীববিজ্ঞানী টেরিন ফস্টার মনে করেন, স্বাস্থ্যকর ও উন্নত মানের প্রবাল পলিপ দিয়ে প্রবালপ্রাচীর প্রতিস্থাপন করা হলেও এদের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র ফিরে আসবে না। সুস্থ সামুদ্রিক পরিবেশে পলিপ সমুদ্রের পানি থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট সংগ্রহ করে প্রবাল কঙ্কাল গঠন করে। আর প্রবাল পলিপে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কঙ্কালের ওপর বিশাল প্রবাল তৈরি হয়। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন, পানিদূষণ, পানির তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ সেলসিয়াস বৃদ্ধির কারণে বায়ুমণ্ডলে ধীরে ধীরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা বাড়ায় পলিপের পক্ষে কঙ্কাল গঠন সম্ভব হচ্ছে না।
এমনকি আগে বানানো কঙ্কালগুলো লবণাক্ত পানিতে গলে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, পানির লবণাক্ততা প্রবালপ্রাচীরের বৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত করছে। টেরিন ফস্টারের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবালের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এর ক্ষতি কমানো সম্ভব। আর কাজটি করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট মানুষের পাশাপাশি কাজ করবে।
কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রবাল জন্মানো এবং তাদের প্রবালপ্রাচীরে প্রতিস্থাপন করা কষ্টসাধ্য কাজ। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর ও ব্যয়বহুল। সাধারণত প্রবাল খুব ধীরগতিতে বাড়ে। প্রজাতিভেদে একটি পলিপ পূর্ণবয়স্ক প্রবাল কঙ্কালে বেড়ে উঠতে ৩ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হয়। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ড্রাই কাস্টিং মেশিন ব্যবহার করে চুনাপাথর দিয়ে প্রবালের কঙ্কাল তৈরি করা হয়, যা মূলত ছোট প্রবালগুলোকে বেড়ে ওঠার একটা ভিত্তি তৈরি করে দেয়। ফলে প্রবাল দ্রুত বড় হয়। প্রবালপ্রাচীরের গঠন থেকে উৎসাহিত হয়ে ফস্টার প্রবাল কঙ্কালকে গম্বুজের আকারে তৈরি করেছেন, যার মধ্যে ছয়টি ছিপির মতো জায়গা রয়েছে। এই ছিপিগুলোর ভেতরে প্রবাল পলিপের টুকরা আঠা দিয়ে লাগানো যায়। এ ধরনের ভিতের কারণে প্রবাল দ্রুত ওপরের দিকে বাড়তে থাকে।
ফস্টার পরীক্ষা করে দেখেন, পরবর্তী সময়ে এই ভিতসহ প্রবাল সাগরে প্রতিস্থাপন করা হলে সেগুলো এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে পূর্ণ আকারে পৌঁছাতে পারে। প্রবাল উৎপাদনের অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে এর বেড়ে ওঠার গতি বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে গম্বুজাকৃতি প্রবালের ভিত তৈরি বেশ সময়সাপেক্ষ। এমনকি মোড়কজাত করা বা কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত করাও সহজ নয়।
সমস্যার সমাধানে ফস্টার ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘কোরাল মেকার’ অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমে অ্যাব্রোলহস দ্বীপে প্রবাল কঙ্কাল নিয়ে কাজ করেছে। প্রথম ধাপে তারা দেখেছে, ডুবুরিরা সহজেই চুনাপাথরের কঙ্কাল বহন করতে পারেন। এসব কঙ্কাল উপযুক্ত পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ফস্টার ও তাঁর সহকর্মীরা নকশার কিছু পরিবর্তন আনেন। এরপর প্রবাল কঙ্কালগুলো তাঁদের খামারে চাষ করেন। এ সময় তাঁরা চাকতি আকৃতির প্রবাল কঙ্কাল বানিয়ে সফলও হয়েছেন। কারণ পলিপগুলো প্রবাল কঙ্কালে খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং সেটি ঢেকে ফেলে। চাকতির মতো গঠনের সঙ্গে হাতল সংযুক্ত থাকার ফলে প্রবাল কঙ্কালগুলো ডুবুরিরা সহজেই বহন করার পাশাপাশি সেগুলো রিমোট কন্ট্রোল যানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
ফস্টারের এই প্রবাল কঙ্কাল উৎপাদনের প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা গেলে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ প্রবাল কঙ্কাল তৈরি করা যাবে। প্রবাল কঙ্কাল উৎপাদন স্বয়ংক্রিয় করতে ফস্টার অটোডেক্স এআই ল্যাবের সঙ্গে কাজ করছেন। এখানে তাঁরা ইমেজ সেন্সরসহ দুই ধরনের রোবট বানাচ্ছেন। প্রথমটি প্রবাল ছোট ছোট করে কেটে ছিপির সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগাতে পারবে। অন্যটি ছিপিসহ প্রবালগুলোকে চুনাপাথরের প্রবাল কঙ্কালে লাগাতে পারবে।
সূত্র: বিবিসি, উইয়ার্ড ডট কম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: