পিএনএএসের গবেষণাকর্ম : প্রাণিজগতে বিলুপ্তির নজিরবিহীন চিত্র

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২৯

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


বিশ্বের প্রাণিজগতের বিলুপ্তির এক নজিরবিহীন চিত্র উন্মোচন করেছেন গবেষকরা। সোমবার প্রকাশিত তাঁদের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শ্রেণিবিন্যাসের একটি বিশেষ ধাপের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। পুরো প্রাণিজগতের গাছের সঙ্গে তুলনা করে (ট্রি অব লাইফ) গবেষণায় বলা হয়েছে, গাছের আস্ত শাখা ধরে বিলুপ্ত হচ্ছে। এতে সতর্ক করা হয়েছে, অব্যাহত হারে বিলুপ্তি চলতে থাকলে প্রাণিকুলে ষষ্ঠ ধাপের ‘ম্যাস এক্সটিংকশন’ তথা ‘গণ বিলুপ্তি’ আসন্ন।

গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে (পিএনএএস)’। এর সহলেখক ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকোর অধ্যাপক জেরার্ডো সেবালোস বলেন, ‘বিলুপ্তির সংকটটি জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই নেতিবাচক। কিন্তু আমরা একে এখনো স্বীকার করিনি। ভবিষ্যতে মানবজাতি নিজেও বিপদাপন্ন হতে পারে।

এই গবেষণা অনন্য একটি কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এটি শুধু জীবজগতের শ্রেণিবিন্যাসের সর্বশেষ ধাপের বিলুপ্তিকে নির্দেশ করেনি, বরং ‘জেনেরা বা জেনাস’ (‘গণ’) ধাপের বিলুপ্তিকে নির্দেশ করেছে। প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাসে সাতটি ধাপ রয়েছে। ওপর থেকে নিচের ক্রম অনুযায়ী সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে প্রজাতি।

এর ওপরের ধাপই হচ্ছে গণ। যেমন কুকুর একটি প্রজাতি। এটি ‘ক্যানিস’ প্রাণীর গণভুক্ত যার আওতায় অনেক কুকুর ধরনের প্রজাতি রয়েছে। তার অর্থ, গণের বিলুপ্তি বলতে বহুসংখ্যক সমজাতীয় প্রাণীর অস্তিত্ব হারানোকে বোঝাবে। জীবজগতের গোটা শাখার বিলুপ্তির আশঙ্কা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের জীববিজ্ঞানী রবার্ট কাউয়ি বলেন, ‘এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা।

প্রথমবারের মতো কেউ প্রজাতির ধাপের ওপরের দিকে আধুনিককালের বিলুপ্তির হার মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইমেরিটাস অধ্যাপক অ্যান্টনি বার্নোস্কি বলেন, ‘এই গবেষণা শুধু গাছের ছোট শাখা কিংবা আগাছা কাটার মতো কোনো ঘটনা প্রকাশ করেনি, বরং এটি ঢাউস চেইনসের মতো মারাত্মক ধারালো যন্ত্র দিয়ে গাছের বড়সড় ডাল ছাঁটাই করার মতো কিছুকে উন্মোচন করেছে।’

সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থার (আইইউসিএন) তালিকাভুক্ত বিলুপ্ত প্রাণীর পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে গবেষণাটি করেন। তাঁরা মাছ ছাড়া বাকি মেরুদণ্ডী প্রাণীর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করেন। মূলত সহজলভ্য তথ্য পেতে এই কৌশল নেওয়া হয়।

৩৪ হাজার ৬০০ প্রজাতি নিয়ে গঠিত পাঁচ হাজার ৪০০ গণ এককভুক্ত প্রাণীর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, গত ৫০০ বছরে ৭৩টি গণ বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বিলুপ্তি ঘটেছে গত ২০০ বছরে। এর আগে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিনের জীবাশ্ম নমুনার ওপর ভিত্তি করে প্রাণিজগতের বিভিন্ন সদস্যের বিলুপ্তি অনুমান করেছিলেন। এবারের গবেষণায় পাওয়া বিলুপ্তির পরিসংখ্যানের সঙ্গে আগের সেসব তথ্যের তুলনা করা হয়।

মেক্সিকোর অধ্যাপক জেরার্ডো সেবালোস বলেন, ‘আগের লাখ লাখ বছরের বিলুপ্তির হারের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে আমরা দুটি গণ হারানোর ধারণা করেছিলাম। কিন্তু হারিয়েছি ৭৩টি।’ গবেষণায় বলা হয়, ‘এমন বিপুল বিলুপ্তির জন্য ১৮ হাজার বছর সময় লাগার কথা, মাত্র ৫০০ বছর নয়।’

বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়, শস্য উৎপাদন ও অবকাঠামোর জন্য প্রাণীদের আবাস ধ্বংস করার পাশাপাশি ব্যাপক হারে মাছ ধরা ও শিকার করাসহ নানা ধরনের কাজ এ জন্য দায়ী। সেবালোস মনে করেন, ‘একটি জেনেরা এককের বিলুপ্তি গোটা বাস্তুসংস্থান চক্রের জন্যই হুমকিস্বরূপ। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের জন্য এটি সভ্যতা ধ্বংস হওয়ারই সতর্কসংকেত।’

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি প্রজাতির ৭৫ শতাংশ বিলুপ্তির শিকার হলে সেই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা ব্যাপক বা গণ বিলুপ্তি বলেন। ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগের ডাইনোসর বিলুপ্তি এমন ঘটনার নজির। সর্বশেষ পরিসংখ্যান সেই ধরনের কিছুকে নির্দেশ করে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের জীববিজ্ঞানী রবার্ট কাউয়ি মনে করেন, ষষ্ঠ গণ বিলুপ্তির ঘটনা এখনো শুরু হয়নি। অবশ্য তিনি মোটের ওপর উদ্বিগ্নই। কাউয়ির ভাষ্য, বর্তমানে যে হারে প্রজাতির বিলুপ্তি হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ষষ্ঠ ধাপের গণ বিলুপ্তি শুরু হয়ে গেল প্রায়।

সেবালোস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, প্রাণিকুলের বিলুপ্তির এই ধারা ঠেকানোর সুযোগ ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হচ্ছে, প্রাণীদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস বন্ধ করা এবং যা নষ্ট করা হয়েছে তা ফিরিয়ে আনা। এখনো অনেক গণ একক রক্ষার সময় রয়েছে। পাঁচ হাজার ৪০০ জেনেরার অনেককেই বাঁচানো সম্ভব।


সূত্র : এএফপি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: