সেনাবাহিনীতেই আইএস, কী করবেন ট্রাম্প?

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৭ জানুয়ারী ২০২৫ ২১:১৩

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা নিউ অরলিন্সে ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ উদ্‌যাপনের সময় ভিড়ের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে দেন এক ব্যক্তি। এতে ১৪ জন প্রাণ হারান এবং আহত হন বেশ কয়েকজন। বছরের শুরুতেই এমন হামলা এবং হামলাকারীর ধর্ম পরিচয় রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, হামলাকারী শামসুদ–দিন জব্বার (৪২) সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে।

ঘটনার আগের রাতে তিনি পরিবারের উদ্দেশে একটি ভিডিও বার্তায় জানান, তিনি আইএসআইএস–এ যোগ দিয়েছেন। যে ট্রাকে করে হামলা চালিয়েছিলেন সেটিতে আইএসের একটি পতাকাও মিলেছে।

একই দিন ম্যাথিউ লাইভ লস বার্গার নামে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সৈনিক ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল লাস ভেগাস হোটেলের বাইরে একটি টেসলা সাইবার ট্রাক বিস্ফোরণ ঘটনা। এ ঘটনায় সাতজন আহত হন। গাড়ির ভেতরে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর পায়ের কাছে একটি বন্দুক পড়ে ছিল। বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

উভয় ব্যক্তিই এক সময় আফগানিস্তানে মোতায়েন ছিলেন। পেন্টাগন প্রেস সেক্রেটারি বলেছেন, দুটি ঘটনার মধ্যে সম্পর্কের কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর মধ্যকার গুরুতর কিছু সমস্যা সামনে এনেছে।

এই ঘটনার পর বোঝা যাচ্ছে, আইএস এখনো সক্রিয়। যদিও ২০১৯ সালে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কথিত ‘খিলাফত’–এর পতন হয়েছে বলে জানিয়েছিল পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। কিন্তু সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান এবং আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে আইএস পুনর্গঠিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সংগঠনের গোপন কার্যক্রম পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

থিঙ্কট্যাঙ্ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির গবেষক অ্যারন জেলিন বলেন, ‘আইএসের প্রভাব শেষ হয়ে যায়নি। গত কয়েক বছরে সিরিয়ায় তাদের হামলার সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। নিউ অরলিন্সের হামলাকারী অনলাইনে আইএসের প্রোপাগান্ডা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য একটি বড় সতর্ক সংকেত।’

শামসুদ-দিন জব্বার নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর উপদেষ্টারা এ ঘটনার জন্য বাইডেনের অভিবাসন নীতিকে দায়ী করছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের মনোনীত সন্ত্রাসবিরোধী উপদেষ্টা সেবাস্তিয়ান গর্কা দাবি করেন, বাইডেনের সীমান্ত নীতি আমেরিকাকে জিহাদিদের হামলার মুখে ফেলেছে।

সে যাই হোক, শামসুদ–দিন জব্বারের এই ঘটনা প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু সীমান্তে কঠোর হলেই অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে জন্মগ্রহণ করা বা নাগরিকত্ব থাকা সন্ত্রাসীদের রুখতে কৌশলগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রয়োজন।

ঘটনার পরপরই ট্রাম্প এবং তাঁর দল বাইডেন প্রশাসনের সীমান্ত নীতিকে কাঠগড়ায় তুলেছে। ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালের পোস্টে লিখেছেন, ‘আমরা বহুবার বলেছি, বাইডেনের উন্মুক্ত সীমান্তনীতি আমেরিকাকে উগ্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এ ধরনের মন্তব্য শুধু রাজনৈতিক বিভাজন বাড়ায় এবং সমস্যার মূল কারণগুলোকে আড়াল করে। জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্র্যাডলি মস বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাস্তব তথ্য, প্রমাণ এবং কৌশলের প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিতর্কের চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপই এখানে জরুরি।’

এদিকে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার। কিন্তু নিউ অরলিন্সের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে অনন্য বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সেনাঘাঁটি বহাল রাখার পক্ষে এই ঘটনা অজুহাত হিসেবে এখন ব্যবহার করা হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে বলাবলি করছেন, ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ আইএসের পুনরুত্থানের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে। বর্তমানে সিরিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলে –সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের কাছে প্রায় ৯ হাজার আইএস যোদ্ধা বন্দী রয়েছে।

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায়। শিগগিরই একটি জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার পরিকল্পনা তারা করছে। তবে বাশারকে উৎখাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন আবু মোহামেদ আল-জাওলানি, তিনি এক সময় আইএসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে অনেক আগেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। তবে ইসলামি মতাদর্শ ত্যাগ করেননি। পশ্চিমা বিশ্ব আল–জাওলানিকে সমর্থনের কথা বললেও আসন্ন নির্বাচিত সরকারে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের শক্ত অংশীদারত্ব নিয়ে আইএস উত্থানের শঙ্কাকে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির অ্যারন জেলিন সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের হাতে বন্দী আইএস যোদ্ধারা পালাতে সক্ষম হলে, তারা ইরাক এবং সিরিয়ায় একটি নতুন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্ম দিতে পারে। তাই সিরিয়া থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে এই অঞ্চলে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি করবে।’

এদিকে নিউ অরলিন্সের হামলার পর স্বভাবসুলভভাবেই আইএস সমর্থকেরা অনলাইনে শামসুদ–দিন জব্বারের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেছে। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা ভবিষ্যতে আরও হামলার জন্য উগ্রবাদীদের উৎসাহিত করতে পারে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।।

বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সৌফান গ্রুপের গবেষণা পরিচালক কলিন ক্লার্ক বলেন, ‘যারা এই আদর্শে বিশ্বাসী, তারা এখন নিজেদের জয়ী দলের অংশ মনে করবে এবং নতুন করে হামলার পরিকল্পনা করতে পারে।’

ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও জাতীয় নিরাপত্তার ভারসাম্য রক্ষা করা। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত এফবিআই পরিচালক কাশ প্যাটেল আগে থেকেই এজেন্সির সংস্কার এবং ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগকারী কর্মকর্তাদের বরখাস্তের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে, নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, এ ধরনের রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল করতে পারে।

তবে নিউ অরলিন্সের এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা থেকে বোঝা গেছে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শুধু অভিবাসন নীতি বা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট নয়। সুনির্দিষ্ট কৌশল, তথ্য এবং আন্তঃসংস্থার মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।

এখন দেখার বিষয়, নতুন করে আইএস উত্থানের শঙ্কার অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সিরিয়ার মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে কীভাবে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে যুক্তরাষ্ট্র।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: