রাখাইনে গৃহযুদ্ধের জেরে নতুন করে বাংলাদেশে আসা প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন একাধিক শহরের পতন হওয়ায় আরো শরণার্থী অনুপ্রবেশের আশঙ্কা বেড়েছে।
মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের জাদিমুড়া এলাকায় পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করছেন। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪-এর বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে জানান সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
সম্প্রতি তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের ৬৪ হাজার ৭১৮ সদস্য বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন।
“গত আগস্ট থেকে অনুপ্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে,” জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মংডু আক্রমণ করার কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে, “সেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।”
গত ১৪ মাসে আসা নতুন রোহিঙ্গাদের জানুয়ারি থেকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন দেওয়ার কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি। প্রসঙ্গত, বায়োমেট্রিক আইডেন্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতি ব্যক্তিকে দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়ে থাকেন।
সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পরপরই নতুন রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তারা। তবে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য “তহবিল সংকট বড়ো উদ্বেগের বিষয়” বলে জানান তাঁরা।
তাঁরা জানান, চলতি বছর আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৫২ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা চেয়েছে, কিন্তু সহযোগিতা এসেছে ৪৭৪ দশমিক ১ মিলিয়ন, যা মোট চাহিদার মাত্র ৫৬ শতাংশ।
রোহিঙ্গাদের সহায়তা অব্যাহত রাখতে বেসরকারি সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহবান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এদিকে “নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল হতে পারে” এমন আশঙ্কায় সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক ফেরদৌসী শাহরিয়ার। তিনি বলেন, “রাখাইনে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। তাই আমাদের সেভাবে প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে।”
অনুপ্রবেশ ঘটছে বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে
কক্সবাজার টেকনাফের নাফ নদী সংলগ্ন স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, নাফ নদীতে কড়া নজরদারি থাকায় রোহিঙ্গারা এ পথে প্রবেশ করতে পারছে না। বান্দরবান জেলার সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন পথে দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে।
এ বিষয়ে গত ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে নতুন করে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। সীমান্তে দুর্নীতির কারণেই এটা ঘটছে।
দালালের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে কক্সবাজারের থাইংখালি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের মংডু এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাখাইনে অনেক রোহিঙ্গা যুবককে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। অনেকে তাদের হাতে নিহত হয়েছে। আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চেয়েও বেশি নির্যাতন করে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
“আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমি রাখাইনে পড়াশোনা করতাম। তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি। আরাকান আর্মি আমার ভাইকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। এখনো ছাড়েনি,” বলেন জাহাঙ্গীর।
বান্দরবানের সীমান্ত সংলগ্ন স্থানীয়রা বলছেন, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম, তুমব্রু, লেবুছড়ি, আলীকদম, পশ্চিমকুল আর টেকনাফের হ্নীলা ও হোয়াইক্যং এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় বাংলাদেশে ঢুকছে।
সম্প্রতি আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, উভয় সীমান্তে সক্রিয় থাকা দালালদের জনপ্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এর আগে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার এডমিরাল জিয়াউল হক বলেন, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় তাদের দিনরাত নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, টহল জোরদার থাকায় নৌপথে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ রয়েছে। মূলত কিছু দালালের মাধ্যমে অন্যপথে রোহিঙ্গারা ঢোকার চেষ্টা করছে।
ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভাসানচরে ৩৬ হাজার ৩৭৬ জনসহ কক্সবাজারের ৩৩ টি ক্যাম্পে ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৭৪ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। দফায় দফায় আলোচনা এবং প্রতিশ্রুতির পরও গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।
এরই মধ্যে আবার রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়েছে। গত কয়েকমাস ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে রোহিঙ্গাদের নতুন করে আসার খবর প্রকাশ হলেও সরকার এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার করেছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: