মুসলিম ছাত্রকে চড় দিতে শিক্ষার্থীদের নির্দেশ শিক্ষিকার

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৭ আগস্ট ২০২৩ ১৯:২৩

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


মুসলিম শিশু শিক্ষার্থীকে চড় মারার জন্য তার সহপাঠীদের নির্দেশ দিয়েছেন নারী শিক্ষিক। তারাও সেই নির্দেশ পালন করছে অক্ষরে অক্ষরে। ২৪ আগস্ট, বৃহস্পতিবার এমন ঘটনা ঘটেছে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরের বেসরকারি নেহা পাবলিক স্কুলে। এরই মধ্যে ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, চেয়ারে বসে আছেন নারী শিক্ষক। সামনে টেবিল। বাঁ পাশে ক্লাসের মেঝেতে বই-খাতা ও ব্যাগ নিয়ে বসে আছে বেশ কয়েকটি শিশু শিক্ষার্থী। প্রত্যেকের বয়সই সাত-আট বছর। শিক্ষকের ডানে এক ছাত্র মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষক অন্য ছাত্রদের বলছেন, একে একে এসে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটিকে চড় মারতে। শিক্ষকের কথামতো একেকজন এসে চড় মেরে যাচ্ছে। একজন আস্তে চড় দেওয়ায় শিক্ষিকা পরের জনকে ধমক দিয়ে বললেন আরও জোরে মারতে। ওই সময় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি মাথা নিচু করে কাঁদছিল। ‘সব মুসলিম শিশুকেই মারা উচিত’ বলতেও শোনা যায় শিক্ষককে।

অভিযুক্ত শিক্ষিকার নাম ত্রিপ্তা ত্যাগী। তিনি মানসুরপুর থানার অন্তর্গত খুব্বাপুর গ্রামে ওই বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। ওই শিক্ষিকা ক্লাসের সবাইকে পাঁচের নামতা মুখস্ত করে আসতে বলেছিলেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুল বন্ধ থাকলেও ওই শিশুটি মুখস্ত করে আসেনি। আর তাই শাস্তি হিসেবে সহপাঠীদের ওই শিক্ষার্থীকে চড় মারতে বলেন শিক্ষক।

প্রথম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীকে চড় মারার ভিডিওটি মোবাইলে ধারণ করে তারই চাচাতো ভাই নাদিম। তিনি বলেন, আমি কিছু কাজে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার চাচাতো ভাই সেখানে পড়াশোনা করতে যায়। আমি দেখি যে শিক্ষিকা ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের আমার ভাইকে থাপ্পড় মারতে বলছেন।

ওই শিশু শিক্ষার্থী বলে, ‘পাঁচের ঘরের নামতা না পারায় শিক্ষক আমাকে শাস্তি দেন। আমি ভুল করেছি বলে আমাকে মারা হয়েছিল। আমি নামতা শিখিনি, তাই আমার সহপাঠীরা আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল। শিক্ষিকা আমার সহপাঠীদের আমাকে জোরে মারতে বলেছিল। তাই তারা আমাকে এক ঘণ্টা ধরে মারতে থাকে।’

উত্তরপ্রদেশের সাড়ে ২৩ কোটি মানুষের মধ্যে মুসলিমরা প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।

শিশুটির মা রুবিনা বলেন, 'গতকাল আমার ছেলে কাঁদকে কাঁদতে বাসায় ফেরে। সে ছিল সন্ত্রস্ত্র। এভাবে তো শিশুদের সাথে আচরণ করা ঠিক নয়।

এ ঘটনায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, সবার মধ্যেই ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তবে ওই শিক্ষকের দাবি, ভিডিও কাটছাঁট করে প্রচার করা হয়েছে।

ত্রিপ্তা ত্যাগী বলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির মধ্যে বাস করি। আমাদের স্কুলের অনেক ছাত্রই মুসলমান। সেই শিশুটি সেদিন তার বাড়ির কাজ নিয়ে আসেনি। আমি ভিডিওতে বলেছিলাম, পরীক্ষা ঘনিয়ে আসায় মায়েদের তাদের সন্তানদের মামার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু তারা এই ভিডিও কাটছাঁট করে তৈরি করেছে। শিশুর বাবা-মায়েরাই চাপ দিতে বলতেন। আমি প্রতিবন্ধী, তাই আমি কিছু ছাত্রকে তাকে চড় মারতে বলেছিলাম, যাতে সে তার বাড়ির কাজ শুরু করে।’ এটিকে ‘ছোট সমস্যা’ বলেও দাবি করেন শিক্ষক।

তিনি আরও দাবি করেন, এটা তার উদ্দেশ্য ছিল না। ওরা সবাই তার বাচ্চার মতো। ভুল স্বীকার করেছেন দাবি করে এটিকে অকারণে বড় ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ত্রিপ্ত ত্যাগী।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিকর্তা শুভম শুক্লা বলেন, ‘ছাত্ররা ছাড়াও ভিডিওতে দুজনকেও দেখা যাচ্ছে, যাদের মধ্যে একজন শিক্ষক, অপরজনকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং স্কুল পরিচালনার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মুজাফফরনগরের পুলিশ সুপার সত্যনারায়ণ প্রজাপথ জানান, স্থানীয় মানসুরপুর পুলিশ থানায় একটি ভিডিও জমা পড়েছে। তাতে দেখা গেছে, নামতা মুখস্ত না পারার কারণে ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তাদেরই সহপাঠীদের চড় মারার নির্দেশ দিচ্ছেন এক শিক্ষিক। ওই ভিডিওতে কিছু আপত্তিকর বক্তব্যও শোনা যায়।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, ওই ভিডিওটিকে প্রাথমিক তদন্তের পর দেখা যায়, ওই শিক্ষকে বলতে শোনা যায়, মুসলিম শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দেয় না, সেইসব বাচ্চাদের পড়াশোনা একেবারে শেষ হয়ে যায়।

বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও সরব হয়েছে। কংগ্রেস সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধী টুইট করে লেখেন, ‘নিষ্পাপ শিশুদের মনে বৈষম্যের বিষ বপন করা এবং স্কুলের মতো একটি পবিত্র স্থানকে ঘৃণার বাজারে পরিণত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন শিক্ষক দেশের জন্য এর চেয়ে খারাপ কিছু আর করতে পারেন বলে মনে হয় না।’

রাহুল আরও জানায়, ‘এটা হলো বিজেপির সেই একই কেরোসিন যা ভারতের প্রতিটি কোণে আগুন জ্বালিয়েছে। শিশুরা ভারতের ভবিষ্যৎ, তাদের ঘৃণা করবেন না, আমাদের সবাইকে একসঙ্গে ভালোবাসা শেখাতে হবে।’

এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র সুস্মিতা দেব এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, ‘মুজাফফরনগরে নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এক শিশুকে মারধর করা হয়েছে, আমরা এ ঘটনায় নিন্দা জানাই। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে শিশু এবং যুবকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব লিখেছেন, ‘মুজাফফরনগরের একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক শিক্ষক অন্য ছাত্রদের হাতে এক ছাত্রকে মার খাওয়াচ্ছে। ওই নারী শিক্ষক তার দ্বিগুণ অপরাধের জন্য দোষী, একদিকে তিনি অন্য ছাত্রদের শিশুটিকে মারতে বলছেন এবং অন্যদিকে তিনি তাদের হিংস্র করে তুলছেন। বিজেপি সরকারের উচিত এই ভিডিওটি জি২০ বৈঠকে দেখানো এবং এই ঘৃণার রাজনীতি কতটা ন্যায়সঙ্গত তার ব্যাখ্যা করা উচিত।’

ভিডিওটি প্রসঙ্গে অনেকে বলেন, স্কুলগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ইসলামফোবিয়ার উদাহরণ হলো এটি। 'মাদারিং অ্যা  মুসলিম' গ্রন্থের লেখক নাজিয়া ইরাম আল জাজিরাকে বলেন, 'সমাজে একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠেছে, যাদের কাছে বৈরিতা ও ঘৃণা হলো স্বাভাবিক বিষয়।'

ভিডিও লিঙ্ক:

https://twitter.com/muslimdaily_/status/1695116083521339475

 

সূত্র : আল জাজিরা ও অন্যান্য

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: