ফাইল ছবি
বাংলার ইতিহাসের দীর্ঘ করিডোরে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেন একটি নীরব শিখার মতো হাঁটেন। ক্ষীণ আলোয়, অবিনশ্বর দীপ্তিতে। এমন এক সময়ে জন্ম তার, যখন মেয়েদের জীবনকে দেয়াল আর নিষেধাজ্ঞার অদৃশ্য পর্দায় আবদ্ধ করে রাখা হতো। সেই পর্দা ভেদ করেই তিনি নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন আলোর একটি ছোট দরজা। তার জীবন ছিল অসংখ্য নারীর ভবিষ্যৎ পথচলার প্রথম মানচিত্র। এক শতাব্দী পেরিয়ে আজও বেগম রোকেয়া কেবল ইতিহাসের চরিত্র নন। তিনি এক স্পন্দন, এক চলমান চেতনা।
তার এ স্পন্দন ধরতে চেয়েছে দুটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র। স্প্যানিশ অ্যানিমেশন ‘El sueño de la sultana’ (সুলতানার স্বপ্ন), যা রোকেয়ার বিখ্যাত রচনা ‘সুলতানা’স ড্রিম’-এর সৃজনশীল পুনর্নির্মাণ, এবং বাংলা ভাষার ডকুমেন্টারি ‘রোকেয়া: আলোর দূতী’, যা কিংবদন্তির আড়ালে থাকা প্রকৃত নারীটিকে খুঁজে বের করেছে। একটি চলচ্চিত্র স্বপ্নের ডানা মেলে, অন্যটি ফিরে যায় স্মৃতির মাটিতে। অথচ দুটোই শেষ পর্যন্ত একই সত্যকে আলোকিত করে রোকেয়া কোনো একটি সময়, ভাষা বা দেশের অন্তর্গত নন। তিনি অন্তর্গত তাদের, যারা ন্যায় ও সমতার স্বপ্ন দেখে।
El sueño de la sultana- (সুলতানা’স ড্রিম)
গল্পটি শুরু হয় এক বৃষ্টির দিন দিয়ে, কারণ মহৎ যাত্রা অনেক সময়ই হঠাৎ থেমে যাওয়া মুহূর্তগুলোর ভেতরেই জন্ম নেয়। স্প্যানিশ নির্মাতা ইসাবেল হেরগুয়েরা ভারতে ভ্রমণের সময় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছিলেন একটি শিল্প গ্যালারিতে। সেখানে একটি বইয়ের প্রচ্ছদ তার দৃষ্টি আটকে দিল, এক নারী এক অদ্ভুত উড়ন্ত যন্ত্র পরিচালনা করছেন, চোখে বিদ্রোহ ও বিস্ময়ের দীপ্তি। সে আকস্মিক মুহূর্তই পরবর্তী সময়ে জন্ম দেয় অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘El sueño de la sultana’কে। যে বইটিতে তার দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল, সে বইটিই হলো বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘Sultana’s Dream’, যা ১৯০৫ সালে ‘দি ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন’-এ প্রথম প্রকাশিত হয়।
হেরগুয়েরা সহজ কোনো পথ বেছে নেননি। তিনি সরলভাবে গল্প অনুবাদ করেননি; বরং বুনেছেন তিনটি জগৎ। এক আধুনিক নারীর অনুসন্ধানের যাত্রা, রোকেয়ার জীবনের ছায়াঘেরা বাস্তব স্মৃতি এবং সেই আলোকোজ্জ্বল ‘লেডিল্যান্ড’, যা রোকেয়া এক শতাব্দী আগে স্বপ্নে এঁকেছিলেন। জলরঙ, ছায়ানাট্য, কাট-আউট অ্যানিমেশন ও বিভিন্ন নকশার মতো উপাদান মিলিয়ে তৈরি হয় এক দৃশ্যভাষা, যা একই সঙ্গে পুরনো ও ভবিষ্যৎগামী। যেমন ছিল বেগম রোকেয়ার লেখার ভেতরের আভা।
এ চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান লেডিল্যান্ড কেবল কল্পনা নয়। ১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের এ সিনেমায় যেন কোনো প্রাচীন স্মৃতি ফিরে আসে। বাংলার চিরায়ত মেহেদি নকশার নরম আঁকিবুঁকিতে গড়ে ওঠে এক শহর, নারীদের হাসি ভেসে ওঠে অতীতের অন্ধকার ভেদ করা সুরের মতো। অনেক মুহূর্তে মনে হয় রোকেয়া যেন এ অ্যানিমেশনের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছেন অবাক বিস্ময়ে আর ভাবছেন কেমন করে তার স্বপ্ন আজ সীমান্ত পেরিয়ে নতুন রূপে ফিরে আসে।
২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া এ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ঠিক বেগম রোকেয়ার জীবনীনির্ভর নয়। বরং এটি রোকেয়ার কল্পনার ভেতরের জগৎকে দেখায়। এ বইয়ে তিনি কী লিখেছেন, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কেন লিখেছেন? কীভাবে কঠোর পর্দার আড়ালে থাকা এক নারী আকাশযান, সৌরশক্তির রান্নাঘর, নারীশাসিত বিজ্ঞানসমাজের স্বপ্ন দেখলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই চলচ্চিত্রটি হয়ে উঠেছে এক মুনশিয়ানাপূর্ণ পুনঃখোঁজ, যা বেগম রোকেয়াকে কেবল সংস্কার-সংগ্রামী হিসেবে নয়, সম্ভাবনার উচ্চশিল্পী হিসেবে দেখার নতুন পথ উন্মোচন করেছে।
রোকেয়া: আলোর দূতী
যদি ‘El sueño de la sultana’ হয় স্বপ্নের দরজা, তবে ‘রোকেয়া: আলোর দূতী’ হলো ফিরে দেখা স্মৃতির উঠোন। এ প্রামাণ্য চিত্রের ভাষা সংযত, তার ছন্দ শান্ত, কিন্তু তার সততা গভীর। এখানে রোকেয়া কোনো প্রতীক নন। এখানে তিনি শ্বাস নেয়া, সংগ্রাম করা, ভাবতে থাকা এক মানুষ।
এ চলচ্চিত্রে আমরা দেখি সেই কিশোরীকে, যিনি লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলা ও ইংরেজি শিখেছিলেন। সেই তরুণীকে, যিনি প্রগতিশীল স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের উৎসাহে লেখালেখিতে প্রবেশ করেন। সেই বিধবাকে, যিনি সমাজের প্রতিরোধ সত্ত্বেও মেয়েদের জন্য স্কুল গড়ে তুলেছিলেন। সেই লেখককে, যিনি ধৈর্য ও সংকল্প দিয়ে ইতিহাসের মানচিত্রে নিজের নাম লিখে গেছেন। এ চলচ্চিত্র আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার বসতবাড়ির উঠোনে, সে পাঠশালার ছোট ঘরগুলোয়, যেখানে তার স্বপ্ন প্রথম দানা বাঁধে।
অ্যানিমেশনের কল্পলোক যেখানে রঙিন, সেখানে এ সিনেমার শক্তি সত্যের সরলতায়। চিঠি, সাক্ষাৎকার, সংরক্ষিত ছবি সব মিলিয়ে এ চলচ্চিত্রে তিনি হয়ে ওঠেন আরো কাছের, আরো মানবিক। প্রায় ১ ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের সিনেমটি পরিচালনা করেছেন মুজিবর রহমান। চিত্রনাট্য ও সম্পাদনা করেছেন বাপ্পাদিত্য চট্টোপাধ্যায়। ভাষ্যপাঠে রয়েছেন দেবাশিস বসু ও সুতপা চট্টোপাধ্যায়।
আজ যখন সমতা, নারীর স্বাধীনতা, ন্যায়, এসব প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত, তখন বেগম রোকেয়ার লেডিল্যান্ড বারবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বপ্ন হিসেবে নয়, পথনির্দেশ হিসেবে। এ দুই চলচ্চিত্র দর্শকের সামনে তুলে ধরে দক্ষিণ এশিয়ার নারীচিন্তা আজকের নয়, তার শেকড় বহু পুরনো, বহু গভীর। একজন বাঙালি মুসলিম নারী যে শত বছর আগে এমন ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন, এ তথ্যই বিশ্বদর্শনকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: