ইসমাইল কাদারে ও তার সাহিত্যভুবন

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১২ জুলাই ২০২৪ ২২:০৭

ইসমাইল কাদারে : সংগৃহীত ছবি ইসমাইল কাদারে : সংগৃহীত ছবি

বর্তমান সময়ের বিশ্বের একজন সেরা সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ইসমাইল কাদারে ১ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তার সাহিত্যকৃতী নানা সাফল্যে ও বৈশিষ্ট্যে বাঙময়, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত একজন ছিলেন। তিনি গত মার্চে নতুন করে আলোচনায় আসেন বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজের ২০২৪-এর একজন শর্টলিস্টভুক্ত লেখক হিসেবে। এই পুরস্কারের ইতিহাসের সাথে তার নাম মিশে আছে। তিনি ছিলেন প্রথম বুকার ইন্টারন্যাশল প্রাইজ জয় করা লেখক। তার নাম এবার আসার পর সবাই ধারণা করেছিল হয়তো তিনি দ্বিতীয়বার এ পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। না, তা হয়নি। শর্টলিস্টে থাকার সুবাদে তার বই জেতে পাঁচ হাজার পাউন্ডের পাইজমানি। তার মৃত্যু তাকে আবার আলোচনায় নিয়ে এলো। কাদারেকে ’২০ এবং ’২১ শতকের অন্যতম সেরা লেখক ও বুদ্ধিজীবী এবং সর্বগ্রাসীবাদের বিরুদ্ধে সর্বজনীন কণ্ঠস্বর হিসেবে গণ্য করা হয়।

কঠোর সেন্সরশিপের সময়ে আলবেনিয়ায় বসবাস করে তিনি কমিউনিস্ট সেন্সরদের ছাড়িয়ে যাওয়ার কৌশল তৈরি করেছিলেন। এই শাসকরা তার তিনটি বইকে নিষিদ্ধ করেছিল। তার বই ৪৫টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে যে, তিনি আলবেনিয়ার একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্ক টোয়েনের সাথে তুলনীয় এবং ‘কাদারে বই ছাড়া আলবেনিয়ান পরিবার খুব কমই আছে’। কাদারে ২০০৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ, ২০০৯ সালে প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস প্রাইজ এবং ২০১৫ সালে জেরুসালেম প্রাইজ পান। এ ছাড়া ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক লেখালেখিতে আজীবন অবদানের জন্য তিনি আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড পান। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ ও চিত্রনাট্যও লিখেছেন।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য ১৫ বার মনোনীত হন। এবার বুকার পুরস্কারের ১১ মার্চ প্রকাশিত দীর্ঘ তালিকায় স্থান পান কাদারে তার লেখা উপন্যাস ‘আ ডিক্টেটর কলস’-এর জন্য। ২০০৫ সালে দেয়া প্রথম ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারটিও পেয়েছিলেন ইসমাইল কাদারে। সে বছর শর্টলিস্টে ছিলেন বিখ্যাত আরো ১৫ জন লেখক। তারা হলেন- মার্গারেট অ্যাটউড, সল বেলো, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, গুন্টার গ্রাস, মিলান কুন্ডেরা, স্ট্যানিসলা লেম, ডরিস লেসিং, নাগিব মাহফুজ, টমাস এলয় মার্টিনেজ, ইয়ান ম্যাকইওয়ান, কেনজাবুরো ওয়ে, সিনথিয়া ওজিক, ফিলিপ রথ, মুরিয়েল স্পার্ক, অ্যান্তোনিও তাবুচ্চি, জন আপডাইক ও আব্রাহাম বি ইহোশুয়া। তাদের মধ্যে অনেকেই পরে নোবেল জিতেছেন। সেই সময়ে ১৬ জনের শর্টলিস্ট থেকে বিচারক প্যানেল কাদারেকে বেছে নেয়।

ইসমাইল কাদারের জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রনাট্যকার এবং নাট্যকার। কাদারের জন্মের তিন বছর পর ইতালির প্রধানমন্ত্রী বেনিটো মুসোলিনির সৈন্যরা আলবেনিয়া আক্রমণ করে এবং রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ইতালীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার সময় তার বয়স ছিল ৯ বছর এবং কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন গণসমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র আলবেনিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। কাদারে জিরোকাস্টারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর তিনি তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব অনুষদে ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি একটি শিক্ষক ডিপ্লোমা পেয়েছিলেন।

ইসমাইল কাদারের সাহিত্যজীবন শুরুর আগে কিছু ঘটনা ঘটেছে। ১১ বছর বয়সে কাদেরে উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটক ম্যাকবেথ পড়েন। তিনি কয়েক বছর পরে বলেন, ‘আমি তখনো বুঝতে পারিনি যে, আমি এটিকে একটি বইয়ের দোকানে কিনতে পারি, তাই আমি এটির অনেক অংশ হাতে কপি করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার শৈশব কল্পনা আমাকে নাটকসহ-লেখকের মতো অনুভব করতে বাধ্য করেছিল।’ এর প্রভাবে তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। ১২ বছর বয়সে কাদারে তার প্রথম ছোটগল্প লেখেন যা শিশুদের জন্য একটি কমিউনিস্ট ম্যাগাজিন তিরানার পাইওনিয়ারি (পায়োনিয়ার) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ত্তহফল্টৎৎরসবঃ (স্বপ্ন) নামে একটি কবিতা সঙ্কলন প্রকাশ করেন। ১৭ বছর বয়সে কাদারে তিরানায় একটি কবিতা প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেন, যা তাকে ম্যাক্সিম গোর্কি সাহিত্য ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নের জন্য মস্কো যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

তিনি ক্রুশ্চেভ যুগে সাহিত্য অধ্যয়ন করে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। নতুন আলবেনিয়ার সংস্কৃতি গঠনে সাহায্য করার জন্য তার প্রশিক্ষণের লক্ষ্য ছিল একজন কমিউনিস্ট লেখক এবং ‘মানব আত্মার প্রকৌশলী’ হয়ে ওঠা। মস্কোতে তিনি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ লেখকদের সাথে দেখা করেছিলেন- শিল্পের একটি শৈলী যা সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির মতো বিপ্লবী কমিউনিস্ট মূল্যবোধের আদর্শ চিত্রিত দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। জাঁ পল সার্ত্রে, আলবার্ট কামু এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের রচনাসহ কাদারে সমসাময়িক পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরে তিনি সমাজতান্ত্রিক নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং অভ্যন্তরীণভাবে গোঁড়ামিবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে নিজেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকাকালীন কাদারে রাশিয়ান ভাষায় একটি কবিতার সঙ্কলন প্রকাশ করেন এবং ১৯৫৯ সালে আলবেনিয়ার সমাজতান্ত্রিক কেরিয়ারবাদের একটি সমালোচক, কিতেতি পা রেকলামা (দ্য সিটি উইদাউট সাইনস) নামে তার প্রথম উপন্যাসও লেখেন। ইউএসএসআরের সাথে আলবেনিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে আলবেনিয়ার নির্দেশে কাদারে অক্টোবর ১৯৬০ সালে দেশে ফিরে আসেন। তিনি পরবর্তী ৩০ বছর তিরানায় বসবাস করেন। সেই অ্যাপার্টমেন্ট বর্তমানে ইসমাইল কাদারে হাউজ জাদুঘর এবং সংরক্ষণাগার। তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। সাহিত্য সাময়িকী লেস লেট্রেস আলবানাইজেস (আলবেনিয়ান লেটার্স; আলবেনিয়ান এবং ফরাসি ভাষায় একই সাথে প্রকাশিত)-এর প্রধান সম্পাদক হন। ১৯৬১ সালে শেকুল্লি ইম (মাই সেঞ্চুরি) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার কাজ আলবেনিয়ান তরুণদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল।

প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অব ডেড আর্মি’ প্রকাশের আগ পর্যন্ত কবিতার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন কাদারে। উপন্যাসটি তাকে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত করে তোলে। কাদেরে ১৯৬০-এর দশকে তার প্রথম রচনাগুলোর মধ্যে একটি, ‘দ্য প্রিন্সেস আরজিরো’ শিরোনামের একটি কবিতা লিখেছিলেন। স্থানীয়ভাবে অনুপ্রাণিত, কবিতাটি ১৫ শতকের কিংবদন্তি রাজকুমারী আরগজিরোর শতাব্দী-প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীকে রূপান্তরিত করে, যিনি অটোমানদের দ্বারা বন্দী হওয়া এড়াতে তার সন্তানের সাথে জিরোকাস্টার দুর্গ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলে কথিত আছে। কবিতাটিকে নিন্দা করা হয়েছিল; কাদেরে সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যনীতি অবজ্ঞা করার জন্য পরোক্ষভাবে সমালোচিত হয়েছিল। ১৯৬২ সালে কফি হাউস ডেজ শিরোনামে একটি ছোটগল্প হিসেবে তার প্রথম উপন্যাসের একটি অংশ প্রকাশ করেন। এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, ১৯৬৩ সালে, দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি প্রকাশ করেন। উপন্যাসটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে অমান্য করার জন্য আলবেনিয়ান সাহিত্য সমালোচকদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এভাবে উপন্যাসটি সেই সময়ের অন্যান্য আলবেনিয়ান লেখকের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। উপন্যাসটি নিয়ে তিনটি চলচ্চিত্র হয়েছে। ১৯৬৪ সালে তিনি লিখেছিলেন চল্টৎংব সবহফড়যবহ শল্টঃড় সধষব (এই পর্বতগুলো কী নিয়ে চিন্তা করছে?)।

তার পরবর্তী ছোট উপন্যাস, দ্য মনস্টার (চল্টৎনরহফল্টংযর) প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে আলবেনিয়া তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করে। কৃষক ও শ্রমিকদের পাশাপাশি জীবন সম্পর্কে জানার জন্য কাদারেকে অন্যান্য আলবেনিয়ান লেখকের সাথে গ্রামাঞ্চলে দুই বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়েছিল।

ডেড আর্মির জেনারেল ছিল আলবেনিয়ার বাইরে কাদেরের প্রথম বড় সাফল্য। ১৯৭০ সালে প্যারিসে প্রকাশক অ্যালবিন মিশেল দ্বারা প্রকাশিত ইসুফ ভ্রিওনির ফরাসি অনুবাদ, কাদারের আন্তর্জাতিক সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে। তার ১৯৯২ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দ্য পিরামিড’ একটি রাজনৈতিক রূপক যা মিসরের ২৬ শতকে খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাহিনী। ১৯৯৩ সালে উপন্যাসটি ফ্রান্সে প্রিক্স মেডিটাররানি এট্রাঞ্জারে পুরস্কারে ভূষিত হয়। কাদারের ২০০৮ উপন্যাস ‘দ্য ফল অব দ্য স্টোন সিটি’ কসোভোতে রেক্সহাই সুরোই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল এবং ২০১৩ সালে স্বাধীন বিদেশী কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। তার আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘দ্য ডলৎ’ ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যার ৭০-এর বেশি। উপন্যাস ৩০টির মতো। রয়েছে ২০টির মতো নাটক। এ ছাড়া ১০টি ছোটগল্প সঙ্কলন ও আরো কিছু ননফিকশন বই রয়েছে।

কাদারে ১৫ বার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন; কিন্তু পাননি। এ জন্য তার তেমন আক্ষেপ ছিল কি না জানা যায়নি। তবে সাহিত্যবোদ্ধারা আহত হয়েছেন। এখন তিনি এসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তবে ইন্টারন্যাশনাল বুকারসহ অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। ১৯৯২ সালে তিনি প্রিক্স মন্ডিয়াল সিনো দেল ডুকা পুরস্কার লাভ করেন; ১৯৯৮ সালে হারডার পুরস্কার; ২০০৫ সালে উদ্বোধনী ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৯ সালে প্রিন্স অব আস্তুরিয়াস অ্যাওয়ার্ড অব আর্টস এবং ২০১৫ সালে জেরুসালেম পুরস্কার, ২০১৯ সালে পার্ক কিয়ং-নি পুরস্কার এবং ২০২০ সালে সাহিত্যের জন্য নিউস্টাডট (ঘবঁংঃধফঃ) আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। নিউস্টাডট পুরস্কারের একজন বিচারক লিখেছেন : ‘কাদারে ফ্রাঞ্জ কাফকার উত্তরসূরি। কাফকার পর থেকে কেউই সর্বগ্রাসী ক্ষমতার নারকীয় প্রক্রিয়া এবং কাদেরের মতো সম্মোহনী গভীরতায় মানব আত্মার ওপর এর প্রভাবের মধ্যে পড়েনি।’

ইসমাইলের বাবা হালিত কাদারে ছিলেন একজন পোস্ট অফিসের কর্মচারী এবং মা হাতিক্সে ডোবি একজন গৃহবধূ। কাদেরে আলবেনিয়ান লেখিকা হেলেনা গুশিকে বিয়ে করেন এবং তাদের দু’টি মেয়ে। তাদের একজন বেসিয়ানা কাদারে জাতিসঙ্ঘের আলবেনিয়ান রাষ্ট্রদূত, কিউবায় রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বছরের পর বছর অসুস্থ থাকার পর, কাদারে ৮৮ বছর বয়সে ১ জুলাই ২০২৪ তিরানা হাসপাতালে মারা যান। তার উপন্যাসগুলো বিশ্বসাহিত্যের একটি বড় সম্পদ। তার কয়েকটি বই বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: