অভাগা নজরুল

মুনা নিউজডেস্ক | ২১ জুন ২০২৪ ০১:৩৭

ছবি: সংগৃহীত ছবি: সংগৃহীত

 

কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন প্রমীলা সেনগুপ্ত ইসলাম। নজরুলের প্রথম বিবাহ একজন মুসলিম মেয়ের সঙ্গে হয়। কিন্তু ঐ বিয়ে একদিনও টেকেনি। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কিছু একটা বিষয় নিয়ে তাঁর বিরোধ বাধে। নজরুল এতটাই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে বিয়ের দিনই সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর তাঁর সঙ্গে প্রমীলা দেবীর বিয়ে হয়। তাদের প্রথম সন্তান জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায়। তিনি প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর তার উদ্দেশ্যে গান লিখেছিলেন ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়’। এরপর তাঁদের পরপর চারটি সন্তান হয়। প্রথম দুই সন্তান মারা যায়।

দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
নজরুল ও প্রমীলার বিবাহিত জীবন ছিল দুঃখে দারিদ্র্যে ভরা। নজরুল নিজের প্রতিভাবলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও তা রাখার মতো বিষয়বুদ্ধি তাঁর ছিল না। খানিকটা ভোলাভালা ধরনের ছিলেন তিনি। সম্ভবত তার কারণ হলো, নজরুল নিজে কোনো পারিবারিক জীবন পাননি। তিনি ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর ষষ্ঠ সন্তান। শিশুকাল থেকেই তিনি বাড়ির বাইরে, কখনো অনাথ আশ্রমে কখনো চায়ের দোকানের কর্মী, এভাবেই কেটেছে তাঁর ছোটবেলাটা। তিনি যখন গানে অভিনয়ে কাব্যে সাহিত্যে খ্যাতির মধ্যগগনে ছিলেন তখন তাঁর বন্ধুবান্ধবের বৃত্তটিও ছিল বিশাল।


কিন্তু নজরুল যখন অসুস্থ হলেন (১৯৪১) ও মূক হয়ে গেলেন তখন তাঁর পাশে সেবা করার জন্য ছিলেন কেবল তাঁর স্ত্রী প্রমীলা দেবী। যেসব বন্ধুবান্ধব সব সময় তাকে ঘিরে থাকত, একসঙ্গে গানবাজনার আসর বসাত, চা পান চলত—তারা সবাই তাঁর দুর্দিনে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলেন। এমনকি তাঁর আত্মীয়স্বজনও তাঁর চিকিত্সার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি। এইভাবে প্রায় দশ বছর কেটে গেল।

ভারতের স্বাধীনতার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর উদ্যোগে ‘নজরুল চিকিত্সা কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় ও অর্থ সংগ্রহ করে তাঁকে চিকিত্সার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর যাবতীয় উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নজরুলের অবস্থার কোনো উন্নতি হয় না। লন্ডন ও ভিয়েনার বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা তাঁকে পরীক্ষা করে বলেন নজরুল দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। এই রোগ সারার কোনো সম্ভাবনাই নেই।


নজরুল তাঁর বাড়িতে ফিরে আসেন। এর মধ্যে প্রমীলা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিয়ের পরপর উপর্যুপরি সন্তান প্রসবের ধকল, দুটি সন্তানের মৃত্যুশোক এবং সর্বোপরি দরিদ্রতা তাঁর স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছিল। তিনি অসুস্থ হয়ে একেবারেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দেহ-মনের ওপর এতটা চাপ তাঁর শরীর নিতে পারেনি।

তিনি অসুস্থ হওয়ার পর নজরুলকে সেবা করার আর কেউই রইল না। তাঁর দুই সন্তান—সব্যসাচী আবৃত্তি করতেন আর অনিরুদ্ধ গিটার বাজাতেন। নজরুলের বইয়ের বিক্রি বাবদ বেশ মোটা অঙ্কের টাকা তাদের হাতে আসত। কিন্তু শুধু বই বিক্রির টাকায় তারা বেশ সচ্ছলভাবে চলত, তা কিন্তু নয়। যখন একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হলো তখন জানা গেল পাকিস্তান সরকার নজরুলের খাওয়াপরা ও চিকিত্সা বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা দিত। একাত্তরে নজরুলের ছেলেরা সেই টাকা নিতে অস্বীকার করেন।

ছেলেরা মাঝে মাঝে দর্শনার্থীদের নিয়ে এসে বাবাকে উত্যক্ত করত। একবার একজন অটোগ্রাফ শিকারিকে বাবার কাছে নিয়ে এসে কাজী সব্যসাচী বললেন, ‘বাবা একটা সই করে দাও।’

নজরুল ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকালেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না তাকে কী করতে বলা হচ্ছে। সব্যসাচী বললেন, ‘কী হলো সই করো।’

তাতেও কোনো কাজ হলো না। সব্যসাচী তাঁর হাতে জোর করে কাগজ-কলম গুঁজে দিয়ে চিত্কার করে বললেন, ‘বাবা সই বাবা সই করো।’

নজরুল কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ কলম নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে লিখলেন।

কাগজ হাতে নিয়ে অটোগ্রাফ শিকারি হতভম্ব। আঁকাবাঁকা অক্ষরে এইভাবে লেখা আছে—

প্রমীলা

দে

বী

লা

এর থেকে বোঝা যায় স্ত্রীর জন্য তাঁর মনে কত বড় জায়গা ছিল। নিজের নাম ভুলে গেছেন কিন্তু স্ত্রীর নাম ভোলেননি। প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর পর (১৯৬২) তাঁকে অত্যন্ত অস্থির দেখা গিয়েছিল। তিনি কথা বলতে পারতেন না। প্রমীলা দেবীর বিছানায় শোয়ার জায়গাটিতে তিনি বারবার হাত দিয়ে চাপড়াতেন ও কাঁদতেন।

স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে নজরুলকে নিয়ে আসা হলো। তাঁকে একটি বড় দোতলা বাড়িতে বেশ আরামেই রাখা হলো। নজরুলের আগমন নিয়ে সারা বাংলাদেশে বিশাল উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল। তাঁকে যেন শোপিসের মতো প্রতিদিন প্রদর্শন করা হতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারলেন—এই নজরুল তো সেই নজরুল নয়। এ তো মূক জড় একজন বৃদ্ধ। এরপর নজরুলকে নিয়ে মাতামাতি বন্ধ হতেই তাকে অন্য একটি ছোট বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, নজরুল নাকি সেই দোতলা বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননি। সিঁড়ির রেলিং আঁঁকড়ে ধরে আপত্তি জানিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি ১৯৭৬ সালে মারা যান মাত্র ৭৭ বছর বয়সে।

নজরুল চেয়েছিলেন (মানসিকভাবে সুস্থ অবস্থায়) তাঁর ও তাঁর স্ত্রীকে যেন মৃত্যুর পর পাশাপাশি একই জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর স্ত্রীর সমাধি চুরুলিয়ায় এবং তাঁর সমাধি ঢাকায়।

লেখকঃ রাজিক হাসান



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: