ভাষা ও সাহিত্যজগত কাব্য ও ছন্দ নিয়েই তার যাত্রা শুরু করে। কবিতাই ছিল মানবজাতির সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম। আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চা শুরুর পূর্বেই মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়েছে ছন্দবদ্ধ বাক্য। অর্থাত মানবমনে সব যুগেই কাব্যসাহিত্য সমাদৃত ছিল। কবিগণ তাঁদের ছন্দবদ্ধ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন সম্প্রদায়, সমাজ, দেশ ও জাতির গৌরব গাথা। এ ময়দান ছিল প্রতিযোগিতামূলক। যিনি যত বেশি উন্নতমানের কবিতা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনিই তত বেশি হয়েছেন সমাদৃত।
মহানবী (সা.) যে সময় এ জগতে তাশরীফ আনেন তখন ছিল আরবি কাব্য-সাহিত্যের সোনালি যুগ। বিশ্ববিখ্যাত কবিরা প্রতিযোগিতার ময়দানে অবতীর্ণ হতো আরবের প্রখ্যাত ‘ওকাজ’ মেলায়। যার কবিতা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো তাকে ‘বছরের সেরা মানুষ’ উপাধিতে ভূষিত করা হতো। আর কবিতাকে কাপড়ের ওপর সোনালি রঙের কালি দিয়ে লিখে দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাবান স্থান বাইতুল্লাহর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। যাকে বলা হতো ‘মুয়াল্লাকাত’ বা ঝুলন্ত কবিতা।
বিশ্বসাহিত্যে আজও ‘সাবয়ে মুয়াল্লাকাত’ বা ‘ঝুলন্ত কবিতা সপ্তক’ সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের কাছে অবতীর্ণ আল-কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষা ও সাহিত্য আরবের সকল সাহিত্যকে স্লান করে দেয়। সবার ওপরে স্থান করে নেয় আল-কুরআন। প্রথম দিকে যেসব কবি ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁরা কুরআনি সাহিত্যের ভাবগাম্ভীর্য ও রচনাশৈলীতে ছিলেন বিভোর। কবিতা রচনা ও চর্চা করা ছিল তাঁদের কাছে গৌণ বিষয়। আল্লাহর নবী মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতের জিজ্ঞাসার জবাব নিয়ে এসেছেন। ইসলাম যে মানুষের বাহ্যক ও আত্মিক উভয় অঙ্গনের খোরাক দিতে সক্ষম তার উদাহরণ পেশ করলেন সবক্ষেত্রে। কাব্য-সাহিত্যেও এর উদাহরণ সত্যিই উজ্জ্বল। যে কা’ব বিন জুহাইর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার ক্ষুরধার কবিতায় রাসূলের কুৎসা রটনা করে রাসূলের পক্ষ থেকে মৃত্যুর পরওয়ানা পেয়েছিলেন তিনিই আবার ক্ষমার আধার মহানবীর চরণতলে এসে তাঁর প্রশংসায় পেশ করলেন কাসিদায়ে বোরদার মতো বিশ্বনন্দিত গীতিকবিতা।
তিনি গাইলেন :
ان الرسول لنور یستضأ به – مهند من سیوف الله مسلول
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল এমন নূর যাঁর আলোক প্রভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আল্লাহর তরবারিসমূহের মাঝে তিনি তীক্ষ্ণ ভারতীয় কোষমুক্ত তরবারি।’
তাঁর ছন্দ, সুর ও উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে আল্লাহর নবী তাঁকে উপহার দিলেন নিজের গায়ের বোরদা বা চাদর। রাসূলের পক্ষ থেকে এ সম্মান ছিল মূলত কাব্যসাহিত্যের প্রতিই সম্মান। সবার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠল- ইসলাম কাব্যসাহিত্যকে আড় চোখে দেখে না; বরং উতসাহ দেয়। এর পর রাসূলের সভাকবি হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে কবিতা আবৃত্তি করেছেন আর রাসূলে খোদা (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে শুনেছেন। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, আল্লাহর নবী তথা ইসলাম সদগুণে বিভূষিত কাব্য ও কাব্যসাধনাকে উপেক্ষা করে না; বরং তার লালন ও চর্চার উতসাহ দেয়। আর আল্লাহর নবীর কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করে সকল ভাষার মুসলমানই তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে সমুন্নত করেছেন তাওহীদী চেতনার ভিত্তিতে। ফারসিভাষী মুসলমানদের অবদান বিশ্বসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসার পূর্বে ফারসি কবিদের কণ্ঠ ও কলম ছিল অগ্নিপূজক, খোদাদ্রোহী রাজ-রাজড়াদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ইসলামে এসে তাদের কাব্যসাহিত্য রূপান্তরিত হলো উন্নত রুচিশীল প্রাণজুড়ানো সংগীতে। রচিত হলো শত সহস্র কবিতা, গজল, হামদ, নাত ও মানবতার জয়গান। ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে যাঁরাই উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন রাসূলপ্রেমে মাতোয়ারা। রাসূলে খোদার শান, মর্যাদা, জীবন চরিত ও সমাগ্রিক কাজকর্ম স্থান পেয়েছে তাঁদের সাহিত্যে। রাসূলের শানে রচিত তাঁদের কাব্যসমুদ্র থেকে আমরা কয়েক ফোঁটা সিঞ্চন করার প্রয়াস পাব আমাদের আলোচ্য নিবন্ধে। প্রথমেই বিশ্ব বরেণ্য কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হলো। কারণ, এ মহান কবির রচিত দু’টি চরণ উচ্চারিত হচ্ছে উপমহাদেশের মুসলমান জনগণের ঘরে ঘরে।
بلغ العلی بکماله – کشف الدجی بجماله
حسنت جمیع خساله – صلوا علیه و آله
‘মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,
রূপের ছটায় দূর করিলে আঁধার ছিল যত।
সকল গুণের সমাবেশে চরিত্র মহান,
তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।’
রাসূলে খোদার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, শান সম্পর্কে শেখ সাদী আরো বলেন :
کریم السجایا جمیل الشیم – نبی البرایا، شفیع الامم
امام رسل پیشوای سبیل – امین خدا مهیط جبرائیل
شفیع الوری خواجه بعث و نشر – امام الهدی صدر دیوان حشر
کلیمی که چرخ فلک طور اوست – همه نورها پرتر نور اوست
‘মহান স্বভাব চরিত্র মধুর
উম্মতের কাণ্ডারী নবী বিভুর,
রাসূলগণের নেতা, পথের দিশারী
খোদার বিশ্বস্ত জিবরাইলের মনযিল।
সৃষ্টলোকের সুপারিশকারী, পুনরুত্থান দিবসের সরদার
হেদায়াতের ইমাম, বিচার দিনের নেতা।
নভোম-ল যার তুর পাহাড় আল্লাহর সাথে করতে আলাপ,
সকল আলো তারই নূরের বিকিরিত আলোর ছটা।’
আল্লাহর নবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে শেখ সাদী বলেন :
تو اصل وجود آمدی از نخست – دگر هرچه موجود شد فرع تست
‘আপনি সৃষ্টির মূল উতস। অন্যসব সৃষ্টি আপনার শাখা প্রশাখা।’
তাঁর জন্ম প্রসঙ্গে বলেন :
چو صیتش در افواه دنیا فتاد – تزلزل در ایوان کسری فتاد
‘আগমন পরে যে কণ্ঠ ধ্বনিত হলো এ ধরায়
তাতেই কম্পিত কেসরার সিংহাসন।’
আল্লামা জালাল উদ্দীন রুমী (রহ.) ছিলেন ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে বিশ্ববিজয়ী সম্রাট। তাঁর মসনবীকে বলা হয় ফারসি ভাষার কুরআন। রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নাম মোবারক যে কত বরকতময় যে সম্পর্কে ইঞ্জিল কিতাবের প্রকৃত অনুসারীদের আচরণ উল্লেখ করে তিনি বলেন :
بود در انجیل نام مصطفی – ان سر پیغمبر ان بحر صفا
طائفه نصرانیان مهر ثواب – چون رسیدندی بدان نام خطاب
بوسه دادندی نام شریف – رو نهادندی بدان وصف لطیف
‘ইঞ্জিলে নাম যার ঘোষিত মুস্তাফা
নবীকুল শিরোমণি পবিত্রতার দরিয়া
সওয়াবের লাগি নাছারা একদল
খুঁজিত তার নাম তাঁর খেতাব
চুমু খেয়ে পড়িত নূয়ে-ভক্তিতে বেতাব।’
ایمن از شرامیران و وزیر – درپناه نام احمد مستجیر
نسل ایشان نیزهم بسیار شد – نام احمد ناصر آمد یار شد
نام احمد چون چنین یاری کند – تاکه نورش چون مددگاری کند
نام احمد چون حصاری شد حصین – تاچه باشد ذات ان روح الامین
‘আহমদ নামের গুণে তারা পেল মুক্তি,
রাজা আর উজিরের ক্ষীণ হল শক্তি,
বাড়িল বংশ সে নামের গুণে-
আহমদ নামই ধ্বনিত তাদের প্রতি বচনে।
আহমদ নাম যদি হয় এতই মদদগার
তার নূর যে কত মহান বলার সাধ্য আছে কার?
আহমদ নামই যদি হয় মজবুত কেল্লা
তার জাত ও মূল সত্তা রুহল আমীন
হেফাজতের কত বড়ই না সুদৃঢ় দুর্গ।’
ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল আরেফ দার্শনিক কবি ছিলেন হযরত ফরিদুদ্দীন আত্তার নিশাপুরী (রহ.) (মৃত্যু ৬২৭ হি.)। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ১৪টি কাব্যে রাসূলে আকরাম (সা.) সম্পর্কে এতো অধিক কবিতা তিনি রচনা করেছেন যেগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে স্বতন্ত্র গ্রন্থের প্রয়োজন। আমরা তাঁর সাগরসম বর্ণনার কয়েকটি চরণ দিয়েই আমাদের তৃষ্ণা মেটানোর প্রয়াস পাব। রাসূলের শানে তিনি বলেন :
چو گویم من؟ ثنای او خدا گفت – که نام اوست بانام خدا جفت
محمد ص صادق القولی امینی – جهان را رحمة للعالمین
محمد بهترین هر دو عالم – نظام دین و دنیا، فخر آدم
‘কি বলব আমি? তার প্রশংসায় আল্লাহই পঞ্চমুখ,
তার নাম তো আল্লাহর সাথেই মিলিত।
মুহাম্মাদ সত্যবাদী আল আমীন,
সমগ্র জগতের জন্যে তিনি রহমত
মুহাম্মাদ দু’জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব
দীন-দুনিয়ার ব্যবস্থাপক (শৃঙ্খলা রক্ষাকারী) আদমের গর্ব।’ (اسرار نامه)
আল্লাহর নবী হযরত আদম (আ.)-এর আগে নবী ছিলেন এবং সকল সৃষ্টি তাঁর নূর হতেই সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে কবি ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহ.) বলেন :
هنوز آدم میان آب و گل بود – که او شاه جهان جان و دل بود
در آدم بود نوری از وجودش – و گرنه کی ملک کردی سجودش
‘পানি মাটির মাঝে যখন আদম
তখনই তিনি ছিলেন অন্তরসমূহের শাহানশাহ।
আদম অস্তিত্বে ছিল তাঁরই নূরের প্রভা-
তাই ফেরেশতাকুল তাঁকে করেছে সিজদা।’ (আসরার নামা)
আরশ কুরছি এবং উভয় জাহান যে তাঁর নামেই উতসর্গিত এ প্রসঙ্গে আরেফ কবি আত্তার (রহ.) বলেন :
هر دو عالم بسته فتراک او – عرش و کرسی قبله کرده خاک او
هر دو گیتی از وجودش نام یافت – عرش نیز از نام او آرام یافت
انبیاء در وصف او حیران شدند – سرشناسان نیز سرگردان شدند
‘উভয় জগত তাঁরই রশ্মিতে আবদ্ধ,
আরশ কুরছি তাঁর পদধূলিকে করেছে কেবলা।
তার অস্তিত্ব থেকেই উভয় জাহান পেয়েছে নাম,
আরশও তার নামেই লাভ করেছে প্রশান্তি।
নবীগণ তার প্রশংসা করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন
বিশেষজ্ঞগণও প্রশংসায় খেই হারিয়েছেন।’ (মানতিকুত তাইর)
আধ্যাত্মিক জগতের নক্ষত্র হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ছিলেন ইরানের গিলানের অধিবাসী। তাঁর সম্পর্কে উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে বেশি কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমাদের এদেশে তাঁর কারামতই আলোচনা হয়ে থাকে। তিনি যে ফারসি কাব্যসাহিত্যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন তা অনেকেরই জানা নেই। তাঁর ‘কাসিদায়ে গাউছিয়া’য় ৮১টি ফারসি কবিতা স্থান পেয়েছে।
রাসূলে খোদা (সা.)-এর শানে তাঁর কবিতা সত্যই অনুপ্রেরণার উতস। রাসূলে আকরাম (সা.) যে সৃষ্টির সেরা মানব, তাঁকে কেন্দ্র করে যে সমগ্র জাহান সৃষ্টি, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
ای قصر رسالت تو معمور – منشور لطافت از تو مشهور
خدام ترا غلام گشته – کیخسرو و کیقباد و فغفور
در جمله کائنات گویند – صلوات تو تا دمیدن صور
معراج تو تابقاب قوسین – جبریل به ره ماند از دور
روشن ز وجود تست کونین – ای ظاهر و باطنت همه نور
ای سید انبیاء مرسل – وی سرور اولیاء منصور
گل از عرق تو یافته بوی – شد شهد در اندرون زنبور
‘হে মহান, রিসালতের প্রাসাদ তব চির আবাদ,
সৌহার্দ্ররে ঘোষণা তব চির অম্লান।
খসরু, কায়কোবাদ ও ফাগফুর যত
তোমার পায়ে হয়েছে অবনত।
এ বিশ্বলোক গাইবে তব গুণগান
যতদিন না ফুঁকবে শিংগায়।
কাবা কাউসাইন ছিল তব মেরাজ,
জিব্রাইল যার যোজন দূরে।
তব অস্তিত্বের আলোয় আলোকিত উভয় জাহান,
তব জাহের-বাতেন সবই নূর হে মহান।
হে নবীকুল সম্রাট রাসূলদের তাজ,
হে সদা বিজয়ী ওলীদের মুকুট,
তব ঘাম থেকে পেয়েছে ফুল খুশবু,
তব পরশে মৌমাছির মাঝে আসে মধু।’
ফারসি কাব্যসাহিত্যে ‘আশেকে রাসূল’ হিসাবে যিনি সমাধিক পরিচিত, যাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ও রাসূলপ্রেমের বিকাশ বিশ্ববাসীর মাঝে রাসূলপ্রেমের বহ্নিশিখা জ্বালিয়েছে তিনি হলেন মহাকবি হযরত নূরুদ্দিন আবদুর রহমান জামী (রহ.)। রাসূলের প্রেমে রচিত তাঁর বিশাল কাব্যসাহিত্য হতে কয়েকটি চরণ উল্লেখ করতে চাই।
এ বিশ্বলোক যে আল্লাহর রাসূলকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
خلقت عالم برای نوع بشر شد – خلقت نوع بشر برای محمد
گر نبود پرده صفات محمد – خلق بسوزد ز نور ذات محمد
‘মানুষের তরে সৃষ্টি জাহান,
মুহাম্মদের তরে মানুষ।
মুহাম্মদী গুণের পর্দা, সৃষ্টির রক্ষাকবচ,
নচেত তার প্রকৃত সত্তার নূরে সব হতো পুড়ে ছাই।’
রাসূল (সা.) যে সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তার প্রমাণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন :
جسمت نداشت سایه و الحق چنین سزد – زیرا که بود جوهر پاک زنور حق
‘তব বদনে ছিল না ছায়া, সত্যই তাইতো হওয়ার
কেননা, পবিত্র অস্তিত্বই তব আল্লাহর নূর।’
ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি নেজামী গাঞ্জভী (রহ.)। তাঁর কাব্যে রাসূলে খোদার যে প্রশংসা করেছেন সত্যিই তা বিস্ময়কর। তাঁর বিরচিত বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাখজানুল আসরার’ গ্রন্থের কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করা গেল। তিনি বলেন :
احمد مرسل که خرد خاک اوست – هر دو جهان بسته فتراک اوست
ای گویا بزبان فصیح – از الف آدم ومیم مسیح
همچو الف راست بعهد ورفا – اول و آخر شده بر انبیاء
‘আহমদ প্রেরিত রাসূল- প্রজ্ঞাই যার সত্তায় গাথা-
যারই বিন্দুতে বাধা উভয় জাহান,
আদম থেকে ঈসা মসীহ
সকলের সেরা বিশুদ্ধ ভাষী;
প্রতিশ্রুত আর অংগীকারে আলিফের প্রত্যয়ী
শুরুতেই নবী আর অন্ত্যেও তিনিই নবী।’
আরেফ কবি সানায়ী গজনভী ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা যেমন আল্লাহপ্রেমের মনমাতানো বাঁশরি, তেমনি রাসূলপ্রেমের দরিয়ার ঢেউ। কবি সানায়ী আল্লাহর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন :
کلاه و تخت کسری از تو نابود + سپاه و ملک قیصر از تو درهم
میان اولیاء صدری و بدری + میان انبیاء مهری و خاتم
‘তব পদাঘাতে পারস্য সম্রাটের তাজ ও সিংহাসন নিশ্চিহ্ন
রোমান কায়সরের অপরাজেয় বাহিনী ও রাজত্ব ভূলুণ্ঠিত।
ওলীদের মাঝে তুমি আত্মা ও পূর্ণ শশী
নবীদের মাঝে সীল মোহর তুমি, তুমিই পরিসমাপ্তি।’
বিংশ শতাব্দীর অমর কাব্যপ্রতিভা দার্শনিক কবি ইকবাল (রহ.) ছিলেন সমগ্র বিশ্ব বিশেষ করে উপমহাদেশ ও ইরান তুরানের সংগ্রামী আদর্শের মূর্ত প্রতীক। দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কবি তাঁর লেখনীতে আল্লাহর নবীর জীবনচরিত অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তুলে ধরেছেন। রাসূলে আকরাম (সা.) বিশ্বলোকের আলোকবর্তিকা। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন :
ای ظهور تو شباب زندگی – جلوه است تعبیر خواب زندگی
در جهان شمع حیات افروختی – بندگان راخواجگی اموختی
‘হে মহান, তব প্রকাশ জীবনের যৌবন-
তোমার প্রভা, জীবন স্বপ্নের তাবির,
বিশ্ব মাঝে জীবনের প্রদীপ জ্বালালে তুমি,
আল্লাহর বান্দাদের বিনয় মহত্ত্ব শেখালে তুমি।’
ফারসি কাব্যজগতে অপর খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হলেন কবি বাহার মালেকুশ্ শোয়ারা খোরাসানী। রাসূলপ্রেমে তিনি ছিলেন বিভোর। তাঁরই কণ্ঠে ধ্বনিতে হয়েছে মহানবীর প্রকৃত স্বরূপ। তিনি বলেন :
با مهر اوست جنت و با حب او نعیم
با قهر اوست دوزخ و با بغض او عذاب
‘তাঁর দয়ায় মিলবে জান্নাত, তাঁর প্রেমেই পাবে নেয়ামত রাশি রাশি।
তাঁর রাগ ও গোস্বায় নির্ঘাত জাহান্নাম, তাঁরই ঘৃণায় শাস্তি।’
با مهر او بود بگناه اند رون نوید – با قهر او بود بصواب اند رون عقاب
‘তাঁর সুদৃষ্টিতে অপরাধীও পাবে আশার আলো
তাঁর অসন্তুষ্টিতে ভালো কাজও হবে শাস্তির।’
অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক কবি রোকনুদ্দীন আওহেদী ছিলেন সে যুগের কাব্যজগতে এক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। যাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে রাসূলপ্রেমের এক বাস্তব চিত্র। রাসূলে খোদার প্রশংসায় তিনি যেসব কবিতা রচনা করেছেন তা অত্যন্ত ব্যাপক। দু’একটি চরণেই তাঁর রাসূলপ্রেমের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি বলেন :
بر سر او از نیکنامی تاج – همه شبهای او شب معراج
انکه مه بشکند بنیم انگشت – آفتابش جه باشد اندر مشت
‘তাঁর শিরে রয়েছে চিরদিন সুনামের তাজ
সকল যামিনী তাঁর শবে মেরাজ,
তিনিই তো সে ব্যক্তিত্ব যাঁর ইশরায় চাঁদ খানখান
সূর্য যাঁর মুঠোর মাঝে পায় নিজ প্রাণ।’
আল্লাহর হাবীবকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন :
علم نور نصرتت ز عالم نور – یزک لشکرت صبا ودبور
معجزت سنگرا زبان بخشد – بوی خلقت بمرده جان بخشد
‘তব ইল্মের বলে আলোকিত আলম,
সকাল সাঁঝের হাওয়া সেপাহী তব হরদম,
তোমার মু’জিযায় বলেছে কথা নিষ্প্রাণ পাথর
তোমার সৃষ্টির সুবাসে মৃত্যু পেয়েছে জীবন।’
রাসূলের প্রেমে পাগল দার্শনিক কবি খাকানী শিরওয়ানী (রহ.) ছিলেন ফারসি কাব্যজগতে এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাব্যে রয়েছে মানবমনের প্রশ্নের জবাব, চেতনার খোরাক আর এশকের ফোয়ারা। তিনি আল্লাহর নবীর উদ্দেশে বলেন :
ما اعظم شانک ای مظفّر؟ – ما اکرم وجهک ای مطهّر؟
ای عشر عطای توبه یکدم – صد ساله خراج هر دو عالم
ای خاک درت مسیح اکبر – جان درده صد هزار عازر
‘হে চির বিজয়ী, তব শান কতই না বড়,
হে মহাপবিত্র, তব অবয়ব কতই না মহান,
হে রাসূল, তব এক শ্বাসের দশমাংশের দাম,
দু’জাহানের শত বছরের খাজনার চেয়েও মূল্যবান।
হে মহান, তব দরজার ধূলিতে ঈসা মসীহ
আযেরের মত লাখ মৃতের দিয়েছে প্রাণ।’
ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে যেসব অমর কবি তাঁদের তেজস্বী লেখার মাধ্যমে মহানবীর শান, মর্যাদা ও জীবন চরিত তুলে ধরেছেন তাঁদের জীবন ছিল রাসূলের আদর্শে অনুপ্রাণিত। আমলের ময়দানে তাঁরা ছিলেন রাসূলের যোগ্য অনুসারী। তাঁদের কবিতা পড়ে আমরা যদি তাঁদের মতোই রাসূলের জীবনকে আমাদের জীবনের আদর্শ হিসাবে গড়ে তুলতে পারি তাহলেই সার্থক হবে আমাদের জীবন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: