বাংলা ইসলামি গান ও জাতীয় কবির অবদান

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৩০

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

রমজানের পবিত্রতা ধোয়া পুণ্যময় রজনী অতিবাহিত হয়ে আকাশে যখন জোছনার মেলায় একফালি চাঁদ ওঠে, নবজীবনের ডাক দিয়ে কোমল আলোয় আলোকিত করে তখন মুসলিম ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ তুলে নূরু— আমাদের নজরুল ইসলাম। দুখু মিয়ার সুখসঞ্চারী সুর সঙ্গীতের মোহনায় চির ভাস্বর হয়ে ওঠে গোটা বাঙালি জনপদ। মহানন্দ আর খুশীর বার্তায় গেয়ে ওঠে বাংলাদেশ—

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্‌ আসমানি তাগিদ।

সুরের ঝংকার, শব্দের অলংকার আর চিত্তমাতানো ভাব-অনুভবে পরিপূর্ণ এ গান একদিকে যেমন ঈদের অনুভূতি হৃদয়ে অঙ্কিত করে প্রতিবার, অন্যদিকে যুগ যুগান্তরের পালাবদলে এ হয়ে ওঠে বাঙালি মুসলিম সমাজের ঈদ উৎসবে জাতীয় সংগীতের অহংকার। এর মাধ্যমেই মূলত কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের হৃদয়াসনে শক্ত করে সমাসীন হয়েছেন মুসলিম জাতির উন্নতশীর কবি হিসেবে।

কী নেই তাতে? ধর্মীয় উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ যেমন আছে, তেমনই আছে মৌলিক প্রতিটি অনুশাসনের প্রতি আবেগ-অনুরাগ। জাগরণের সুর যেমন ঝংকৃত হয়েছে তেমনই অলংকৃত হয়েছে মনের আকুতিগুলো চমৎকার সব শব্দগুঞ্জনে। সংগীতের আবহে প্রচলিত সমাজের রুদ্ধদ্বার ভেঙে তাওহিদের প্রতি সে এক উপমেয় সদয় আহ্বান—

ঢাল হৃদয়ের তোর তশ্‌তরিতে শির্‌নি তৌহিদের।
তোর দাওয়াত কবুল করবে হজরত হয় মনে উম্মীদ।

আর্ত মানবতার জয়গান, বঞ্চিত গরিব দুঃখীর অধিকার আদায়ে সব সময়ের মত এখানেও কবি সরব। গেয়ে ওঠলেন জাদুমাখা সুরে কুরআনি নির্দেশ—

তোর সোনা–দানা বালাখানা সব রাহেলিল্লাহ্‌।
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ্‌।

সবিশেষ ভাঙা গড়ার এক কঠিন সমীকরণে চলতে থাকা মুসলিম সমাজকে দিয়েছেন ঐক্যের ফর্মূলা। মুসলিম সভ্যতার চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে হেঁকেছেন প্রেম মমতার উদাত্ত আহ্বান—

আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে।
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত ও দুশমন হাত মিলাও হাতে।
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।

মজার ব্যাপার হলো, কালজয়ী এ সংগীত রচনার মাধ্যমেই কাজী সাহেব ইতিহাসের খেরোখাতায় নতুন একটি পাতার সূচনা করে দিয়েছিলেন— সেটা তিনি জানতেনও। সগর্বে বলেও বেড়াতেন সেকথা। কিন্তু বিহাইন্ড দ্যা হিস্ট্রি বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম সভ্যতার ওপর ধেয়ে আসা এক বিরাট সাংস্কৃতিক অপবাদের শক্ত প্রাচীর তিনি অলক্ষে ভেঙে চূর্ণ করে দিয়েছিলেন— এটা জানতেন কিনা জানি না। হয়ত এ বিষয়েও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। কারণ, ইতিহাস ও জাতীয় সংস্কৃতির বিষয়ে কাজী সাহেব ছিলেন ভীষণ তৎপর ও সচেতন মানুষ।

বাংলা ভাষার ইতিহাসকে অন্যান্য ভাষার মতই ভাষাবিজ্ঞানীগণ তিনটা ভাগে ভাগ করেন। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও অধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগের বাংলা সাহিত্য, এর ধারণা, তত্ত্ব ও স্বরূপ সম্পর্কে কারোরই তেমন ধারণা নাই। গবেষকগণ বহু কষ্টে একথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। এই চর্যাপদ ছিলো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধন গীতি। ১৯২৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর স্বরচিত ‘Buddhist mystic songs’ গ্রন্থে চর্যাপদের গানগুলো নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের দুর্লভ যে নিদর্শন পাওয়া গেল ; তা কল্পিত হোক আর বাস্তবিক সে কিন্তু গীতি সাহিত্য। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। প্রায় প্রতিটি ভাষার আদিরূপ হলো পদ্য সাহিত্য বা গীতি সাহিত্য। কেননা পদ্য, কাব্য ও গীতিকথা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ বিষয়। আর গদ্য সাহিত্য লৌকিক সাহিত্য। সুতরাং বাংলা ভাষার বয়স যতদিন বাংলা গানের বয়সও ততদিন!

ইসলামের বয়স যতদিন ইসলামি গানের বয়সও ততদিন। আরবি যেহেতু ইসলাম ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা এবং এর প্রাচীন সাহিত্যের গতিও যেহেতু কাব্য ও পদ্য নির্ভর তাই পেছনের তথ্যটি আরও শক্তিশালী হয়। সাহাবি হাসসান বিন সাবিত রা. ছিলেন ইসলামি কবিদের অন্যতম। নবির প্রশংসায় তিনি এত চমৎকার গান গেয়েছেন যে, তাঁর নাম পড়ে গেছে ‘শায়িরুর রাসুল’।

তবে সম্ভবত সুরারোপ করে ইসলামি গান বা গজলের সূচনা হয়েছে রাসুল সা.-এর মদিনায় হিজরতের দিন। সেদিন মদিনার ফুটন্ত গোলাপ মায়াবী শিশুগুলোর কোমল কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এক কালজয়ী নাশিদ—

ত্বলাআল বাদরু আলাইনা, মিন সানিয়্যাতিল ওদাঈ,
ওয়াজাবাশ শুকরু আলাইনা, মা দাআ লিল্লাহি দাঈ!

এরপর থেকে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষায় রচিত হয়েছে ইসলামি গান, গীতি ও সংগীত। যাকে আরবিতে বলা হয় গজল। আরবে উদ্ভুত গজল ফারসি ভাষায় মূলত বিকশিত হয়। পরবর্তীকালে উর্দু ভাষায় এর ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। সম্ভবত গজলের জন্য উর্দুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাষা আর হয় না। প্রাথমিক দিকে ইমাম গাযালি, মওলানা জালালুদ্দিন রুমি, হাফিজ সিরাজি, ফাখরুদ্দিন আত্তার, হাকিম শানাঈ প্রমুখ গজল লিখে বেশ নাম করেন। পরবর্তীতে আমির খসরু, মীর তাকি মীর, ইব্রাহিম জক, মির্জা গালিব, দাগ দেলবি এবং আধুনিক কালে আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ফিরাক গোরখপুরি গজল লেখক হিশেবে নাম করেন। তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় ক্রমান্বয়ে গজল একটি অভিজাত শাস্ত্রে পরিণত হয়।

আল্লাহর সাথে ভালোবাসার অনুপম প্রকাশ, রাসুল-আম্বিয়াগণের স্তুতি, দ্বীন ইসলামের প্রতি গভীর ভাবাবেগ ও আধ্যাত্মবাদের নিগূঢ় রহস্যকথা আবেগঘন সাহিত্যের সংস্পর্শে তারা লিপিবদ্ধ করেন। এ সকল সাহিত্য ভাণ্ডার আজও পর্যন্ত প্রতিটি ভাষার সমৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধি, বাংলা ইসলামি গান ও গজলের সাথেও রয়েছে ফারসি উর্দু ও আরবি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব।

বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা—বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির সূচনা হয় মূলত মধ্য যুগ থেকেই। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের মধ্য দিয়ে (১২০৪, মতান্তরে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনার পাশাপাশি এ অঞ্চলের বাসিন্দারা পরিচিত হলো এক নতুন ধর্ম ও নতুন সংস্কৃতির সাথে—ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি সংস্কৃতি।

এই ইসলাম ধর্ম, এই ইসলামি সংস্কৃতি জনপদের জীবনযাত্রা ও লোকাচারে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, দুশো বছরের মধ্যে তা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক নতুন স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছে। মুসলিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসময় বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে জনগণের ভাষা, রাষ্ট্রের ভাষা। মূলত তখন থেকেই ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপজীব্য করে রচিত হয় বাংলা গানের এক শক্তিশালী ধারা ‘ইসলামি গান।’

সপ্তম শতকে দূর আরব দেশে যে ধর্মের নবযাত্রা সূচিত হয়েছিলো, সেই ধর্মের উপাদান, আচার-বিশ্বাসকে ধারণ করে বাংলা ভাষায় রচিত বহু ইসলামি গান ও গীতি বাংলা গানের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগিরের কথা না বললেই নয়। তাঁর রচিত ‘ইউসুফ-জোলেখা’ তদানীন্তন মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক উৎসবের অন্যতম সঙ্গী ছিল। দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লি-মজনু’-এর কথাও বলা যায়। এসকল গল্পকাহিনি গ্রামে গ্রামে পালা আকারে গীত হতো কিংবা পুঁথি পাঠের আসর জমাতো। তখনকার যুগে এগুলোই ইসলামি গান হিসেবে পরিচিত ছিলো।

আসলে মধ্য যুগটি ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যৌবনকাল। এ সময়টি বাংলা ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধির স্বর্ণযুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। যেহেতু মুসলিম শাসকগণ ছিলেন পরম উদার তাই তারা হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগণকে ভাষা চর্চায় সমান পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে তখন হিন্দু ধর্মীয় নানারকম শ্যামা সংগীত, সাধন গীতি ও ভোজন গীতি ইসলামি গানগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে সমান গতিতে এগিয়ে যায়। মধ্য যুগের পুরোটি সময়জুড়ে সাতশো বছরের ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ের পর এদেশ, এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর শকুনের নখর পাতে ব্রিটিশ শাসন।

ব্রিটিশরা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই মুসলিমদেরকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে। হিন্দু সম্প্রদায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হয়ে ওঠে ইংরেজদের তলচাটা ফেলো। মুসলিমরা যেহেতু প্রচণ্ড বিদ্রোহী ও অনমনীয় ছিল, ফলে তাদের জীবনে নেমে এসেছিল ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অমানবিক আগ্রাসনের অনির্বচনীয় যন্ত্রণা। এ সময় ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু বাবু ও মোড়লদের হাতে বাংলা ভাষায় আনা হয় আমূল পরিবর্তন— যাকে আমরা বলছি Modern Era of Bengali Language বা বাংলা ভাষার আধুনিক যুগ।

বাংলা ভাষার আধুনিক কালের সূচনা থেকেই মুসলিমরা ছিল ভীষণ এলোমেলো ও অস্থির। নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে তারা ছিল ব্যতিব্যস্ত; সাহিত্য চর্চার নতুন ধারায় নিজেদের মেলে ধরার ছিল না ফুরসত, পক্ষান্তরে ছিল রাজনৈতিক বাধা। ফলে এ সময় কালজয়ী কোনো ধর্মীয় গীতি বা ইসলামি বাংলা গজলের তেমন কোনো আবিষ্কার চোখে পড়েনি। অথচ বাংলা গান উত্তরোত্তর পেছনকে ছাড়িয়ে আধুনিক সুর তাল রাগ ও লয়ে নিত্য নতুন ছন্দে যৌবনের মৌবনে অনায়াসে অবগাহন করছিল। সেসময় বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় একেবারেই যে, ইসলামি গান লিখেননি তা বলার ধৃষ্টতা নেই। এসময় তাদের লিখিত গান ও গজল নানান উৎসবে গীত হলেও, জনমুখে প্রচারিত হলেও বোদ্ধা মহলে ছিল না এর বিশেষ কোনো কদর বা কাটতি। সাহিত্য মানেও উন্নীত বলে ধৃত হতো না। তখন মুসলিমগণ নিজেদের আমোদিত করতে এবং সুর মূর্ছনায় হৃদয় অভ্যন্তরে দ্বীন আল্লাহ ও রাসুলের ভাবাবেগ সঞ্চারিত করতে উর্দু গজল ও কাওয়ালি শুনতেন। এ দিয়েই তারা মেটাতেন আধ্যাত্ম সাধনার তৃষ্ণা। এ কারণেই, সে সময় বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে উর্দু গজল ও কাওয়ালির রেকর্ড বিক্রয় হতো সর্বত্র এবং বিপুল পরিমাণে। সুতরাং বাংলা গানের বিপরীতে বাংলা ইসলামি গান ও গজলের আধুনিকায়ন হয়ে উঠেছিল একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। ইসলামি সাহিত্য জগতের প্রতি যেন এ এক অদৃশ্য যুদ্ধ।

এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে মহীরূহ হয়ে আবির্ভূত হলেন আমাদের নূরু—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্বীয় প্রতিভার উজ্জ্বল কীর্তি স্থাপন করেছেন। বাংলা কাব্যে নিজস্বতা তৈরি করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে দেশ জাতি ও ধর্মকে বুকে জড়িয়ে কলমের ডগায় বইয়ে দিয়েছেন কাব্যের হাউজে কাউসার। সমসাময়িক সকলকে দলে মথে দুর্নিবার ছুটে চলেছেন মানবতার মুক্তির জয়গানে। সুর তুলেছেন উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধনে। বিদ্রোহী কবিতা আর ভাঙার গান লিখে তিনি বাংলা কাব্যের জগতে অত্যুচ্চ আসনে তখন সমাসীন। একাধারে তিনি রচে গেছেন, বলে গেছেন, গেয়ে গেছেন।

আসলে কবি নজরুল ইসলাম ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ায় বাল্যবেলায়ই মকতব থেকে পেয়েছিলেন ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য। বাবার মৃত্যুর পর মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়ে জীবনযুদ্ধের সূত্রপাত করেন। তখন মকতবের শিক্ষকতা করার সুবাদে এবং পরবর্তীতে বিদগ্ধ আলেম মনীষীগণের সাহচর্য লাভ করে তিনি ধর্মীয় শিক্ষার অনেকটাই অর্জন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের তাগিদে কিংবা কবি প্রকৃতির কারণেই তিনি ছিলেন সর্বদাই অস্থির। তাই কৈশোর থেকেই তিনি বিভিন্ন থিয়েটার ও লেটো দলের সাথেও সময় কাটাতে শুরু করেছিলেন। সে সময় যেমন তিনি সাহিত্যের নানান রসে আকৃষ্ট হয়েছেন তেমনই নানান মতের সাথেও হয়েছেন ঘনিষ্ঠ। হিন্দু বাবুদের আড্ডায় তাঁর জীবনের কিয়দাংশ যাপিত হওয়ার ফলে হিন্দু শাক্ত সম্প্রদায়ের সাথেও হয়ে উঠেছিলেন তিনি বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। এভাবেই মূলত কাজী নজরুল হয়ে ওঠেন একজন Multi National Poet বা বহুজাতিক কবি।

তাঁর এই বৈশিষ্ট্য সমগ্র সাহিত্যে বিরাজমান। সুতরাং ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতি যেমন তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু তেমনই হিন্দু ও হিন্দু সংস্কৃতিও তার সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে প্রতিভাত হয়ে উঠল। অন্যান্য ধর্মও বাদ পড়েনি তার সাহিত্যরস আস্বাদনে। কারণ তিনি ছিলেন নিতান্ত সহজ সরল, সবকিছুর আগে মানুষকে বিবেচনা করতেন। তাছাড়া যেহেতু কবি নজরুলের সাহিত্যের পরতে পরতে হিন্দুয়ানি প্রভাব প্রবল ছিল ; তিনি প্রচুর শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতি লিখে ভীষণ যশ-রস পেয়েছিলেন ফলে মুসলিম সমাজে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চরম ধীকৃত ও অবাঞ্ছিত। তাঁর ওপর অযাচিতভাবে এঁটে গেল ‘কাফের’ ও ‘হিন্দুয়ানি কবি’র টোটকা।

সুতরাং চ্যালেঞ্জটা ছিল দ্বিমুখী। বাংলা আধুনিক গানের বিপরীতে সাহিত্যসমৃদ্ধ বাংলা ইসলামি গানের আধুনিকায়নকে সমাদৃত করা এবং কবির ওপর এঁটে যাওয়া ‘কাফের’ টোটকা সরিয়ে মুসলিম সমাজের হৃদয়-গভীরে নিজের আসন ফিরে পাওয়া। উভয় চ্যালেঞ্জকেই একহাত নিলেন কাজী সাহেব। মোকাবিলা করলেন তাঁর সুনিপুণ শিল্প কুশলতায়। বাংলা ইসলামি গানে আনলেন বিপ্লব। রচনা করে গেলেন একের পর এক বিস্ময়!

কাজী সাহেব তখন এক গ্রামোফোন কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত লোক-সংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ একদিন অনুরোধের সুরে বললেন— ‘কাজীদা, একটা কথা মনে হয়, এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায়, এদের গান শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরেন বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’

প্রস্তাবটি তাঁর ভালোই লাগলো। তবে তিনি বললেন— ‘আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারি না।’ এই ভগবতী ভট্টাচার্য ছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ। আব্বাস উদ্দীন ভগবতী বাবুকে কথাটা পাড়তেই তিনি সোজা ‘না’ করে দিলেন। এ ধরণের রেকর্ড বের করে তিনি লোকসান করতে চান না!

আব্বাস উদ্দীন ভগবতী বাবুর পেছনে লেগেই রইলেন। অবশেষে একদিন ভগবতী বাবুকে বললেন—‘একটা এক্সপেরিমন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী?’ তিনি হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা করা যাবে।’

আব্বাস উদ্দীন নজরুল ইসলামকে ভগবতী বাবুর সম্মতির কথা জানাতেই নজরুল খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন ইসলামি গান লিখতে। নজরুল রচিত সেদিনের গানটি হলো বাংলা ইসলামি গানের সেই কালজয়ী সংগীত যা বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের অপরিহার্য সঙ্গী এবং যার জনপ্রিয়তা আজ অবধি বিন্দুমাত্র কমেনি—

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্‌ আসমানি তাগিদ।

এই গান রচনার পরদিনই নজরুল আরেকটি গান রচনা করে দেন—

ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।
বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।

১৯৩১ সালের নভেম্বরে রচিত ও সুরারোপিত হলেও গজল দুটি পরের বছর রমজান মাসে ধারণ করা হয়। ঈদের আগে আগেই বাজারজাত করা হয়। বাজারে এসেই গান দুটি বাজিমাত করে বসল। রেকর্ডটি পেল তুমুল জনপ্রিয়তা। তরুণ আবাল বৃদ্ধ বনিতা যুবা—সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘এলো খুশির ঈদ’ গানটি।

কাজী সাহেব শুরু থেকেই তাঁর ইসলামি গানের রেকর্ড নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলেন। অন্যান্য গানের মতো ইসলামি গানও সাফল্যের বৈতরণি পার হওয়ায় তাঁর চোখেমুখে সে কী আনন্দ! ওদিকে ভগবতী বাবুও খুশি। প্রকাশনার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়ে গেছে। যে ভগবতী বাবু ইসলামি গানের রেকর্ডের কথা শুনতেই চোখ-মুখ পাকিয়ে না করে দিয়েছিলেন, এবার তিনিই অনুরোধ করছেন এরকম আরো কয়েকটি ইসলামি গান রচনার জন্য! ব্যস, এভাবেই শুরু হলো নজরুলের ইসলামি গান রচনার অভিযাত্রা। একে একে রচে গেলেন প্রায় ২৮০টি ইসলামি সংগীত; প্রকৃত সংখ্যা যদিও আরো বেশি হবে। তবে যে কয়টি গান পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই বলা যায়, বাংলা ইসলামি গান রচনায় তিনি সর্বাধিক রচয়িতা হিসেবে আজতক অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদি তাঁর গানের সুর-মান নিয়ে বলা হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনিই একমাত্র। প্রায় ৮০ ভাগ গানের সুর সংযোজন করেছেন নজরুল নিজেই। ৪৬টি গান অন্যদের দ্বারা সুরারোপিত। এভাবেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ইতিহাসের খেরোখাতায় সূচিত করলেন একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়; বাংলা ইসলামি সংগীত। যার একমাত্র রূপকার আমাদের দুখু মিয়া, আমাদের নূরু!

প্রকৃতপক্ষে নজরুলের গানের ভেতরে আছে উন্নত উপমা, চিত্রকল্প ও দর্শন । সেই সাথে সুরে সুরে আছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খেয়াল, ঠুংরি ও টপ্পার সংমিশ্রণ। নজরুলের আগে বাংলায় যেহেতু কেউ গজল গান লেখেননি, তিনিই প্রথমে বাংলা গানে গজল আমদানি করেছিলেন। তাছাড়া তিনি গজলের মাধ্যমে তুলে ধরতেন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের আকুতি যা ছুঁয়ে যেত সকলের হৃদয়। এই যেমন—

দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে।
বেহুঁশ হয়ে চলেছি যেন কেঁদে কেঁদে কাবার পথে।
হায় গো খোদা, কেন মোরে
পাঠাইলে কাঙ্গাল করে,
যেতে নারি প্রিয় নবীর মাজার শরিফ জিয়ারতে।

একজন হতদরিদ্র বাঙালির অর্থাভাবে হজব্রত পালন করতে না পারার বেদনা কতটা মমতাসুরে গীত হয়েছে— এমন হৃদয়গ্রাহী কথা ও সুর ঝংকৃত হয়েছে নজরুলের প্রতিটি কাব্যে, প্রতিটি গজলে। ফলে বাংলার আনাচে-কানাচে তাঁর গজল গান ছড়িয়ে পড়েছিল সুরের মূর্ছনায়। তাঁর গজলে যেহেতু ইরানি কাব্যসুষমার লালিত্য ও ভারতীয় সঙ্গীতের অপূর্ব সুর একীভূত হয়ে এক অমায়িক শিল্প-সৌন্দর্য চিত্রিত হয়েছে তাই দেশজুড়ে তাঁর গানের অভাবনীয় কাটতি দেখে হিন্দু গীতিকারগণ লোভাতুর হয়ে উঠলেন। রেকর্ড রিলিজ হওয়া মাত্রই এর হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বেশ রমরমা ব্যবসা করতে লাগলো। দিন দিন চাহিদা এতই বেড়ে গেলো যে, গ্রামোফোন কোম্পানির অনুরোধে হিন্দু গায়ক-গায়িকাদেরকেই নাম বদলে মুসলমান সেজে ইসলামি গানের রেকর্ড বের করতে হলো। কারণ, আব্বাস উদ্দীন এবং আরো কয়েকজন সংগীতশিল্পী ছাড়া মুসলমান শিল্পী বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। মুসলিম গীতিকারদের অপ্রতুলতা এবং নজরুলের ইসলামি গজলের উচ্চাঙ্গ রাগ হিন্দু গীতিকারদের প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় ধীরেন দাস হলেন ‘গণি মিঞা’, ঊষারাণী হলেন ‘রওশন আরা বেগম’, সীতা দেবী হলেন ‘দুলি বিবি’, হরিমতী দেবী হলেন ‘সকিনা বেগম’, চিত্ত রায় নাম ধারণ করলেন ‘দেলওয়ার হোসেন’। গিরীণ চক্রবর্ত্তী তো কয়েকবার নাম পাল্টালেন কয়েকটি রেকর্ডের জন্য। একবার ‘সোনা মিয়া’ নামে, একবার ‘সুজন মাঝি’ নামে, আর একবার ‘গোলাম হায়দার’ নামে!

নজরুল ইসলাম রচিত ইসলামি সংগীতের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, ভাব ও সুরের সমন্বয়। আগেও বলা হয়েছে— নজরুলের গানের ভেতরে আছে উন্নত উপমা, চিত্রকল্প ও দর্শন । সেই সাথে সুরে সুরে আছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের খেয়াল, ঠুংরি ও টপ্পার সংমিশ্রণ। পাশাপাশি দাদরা, কাহারবা, ঠুমরি কিংবা পল্লীর লোকসংগীতের ঢঙেও তিনি অনেক ইসলামি গান রচনা করেছেন। এসবই তার একক বৈশিষ্ট্য। তবে কিছু কিছু গানে তিনি বিদেশি সুরও অনুকরণ করেছেন। তাঁর একটি বিখ্যাত নাতে রাসুল সা. সম্পর্কে বলা যাক—

ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়,
আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়।

তুরস্কের বিখ্যাত ‘কাটিবিম ইশকাদার’ গানটির সুর অনুকরণ করেছেন কবি নজরুল। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়—তুর্কী সাহিত্যের এ জনপ্রিয় গানটি প্রায় পাঁচশ বছরের মতো পুরানো। একটি আরবি গানেও এই সুর চয়িত হয়েছে। খুব সম্ভবত, নজরুল এই আরবি সংস্করণ থেকেই দ্যোতিত হয়ে এই সুরে বাংলায় গান রচনা করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো— বাংলা শব্দ অলঙ্কারের পাশাপাশি আরবি, ফার্সি শব্দের সংযোজন, যা তাঁর গানের বাণীর ব্যঞ্জনাকে সমৃদ্ধতর করে গভীর হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। তাছাড়া ইসলামি পরিভাষাগুলো যেহেতু আরবি ভাষার এবং বাঙালি মুসলিম সমাজে তা আরবি নামেই পরিচিত, ফলে তিনি শব্দচয়নে ও ব্যবহারে এমন এক জাদুময়তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন যা উত্তরোত্তর বিস্মিত করে তোলে।

আবার সুর বৈচিত্র্যের পাশাপাশি নজরুলের ইসলামি সংগীতের সবচেয়ে বড় বিশিষ্টতা হলো বিষয় বৈচিত্র্য। ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনুষঙ্গগুলোর প্রায় সব বিষয়েই নজরুল ইসলামি গান লিখেছেন। তাওহিদ, রিসালাত, হামদ-নাত, আজান, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, শবে মিরাজ, শবে বরাত, শবে কদর, রমজান, ঈদ, মহররম, ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, জাগরণী গান, ইসলামের সাম্যের শিক্ষা, অমর ব্যক্তিত্ব, মুসলিম নারীর মর্যাদা, চেতনা জাগরুক কী এমন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি সংগীত রচনা করেননি!

বিষয়ভিত্তিক কিছু গজলের উপমা দেওয়া যেতেই পারে—প্রথমেই আসি নাত-এ-রাসুল নিয়ে। এ বিষয়ে নজরুল তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কেননা, বাংলা ভাষায় নজরুল কর্তৃক বিরচিত ইসলামি নাতগুলো ‘নাত-এ-রাসূল’ এর যে বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে, সেই অনুযায়ী অনেক উচ্চমানের। সুর ভাব ও ভাষার গভীরতা—সর্বদিক দিয়েই। নিচের গানটির কথাই ধরা যাক—

হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়,
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায় —
সে যে আমার কমলিওয়ালা — কমলিওয়ালা।
নবিপ্রেমে সিক্ত কবি আরও লিখেন—
বক্ষে আমার কাবার ছবি,
চক্ষে মোহাম্মদ রাসূল।

এতেও ক্ষান্ত রয়নি তাঁর নবিপ্রেমের ভাবাবেগ। সুর ধরেছেনে—

মোহাম্মদের নাম জপেছিলি,
বুলবুলি তুই আগে
তাই কিরে তোর কণ্ঠের ও গান,
এত মধুর লাগে।

নবিজিকে নিয়ে লেখা নজরুল ইসলামের আরও কয়েকটি বিখ্যাত সংগীত— ‘মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।’ ‘তৌহিদেররই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।’ ‘তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হযরত।’ ‘এ কোন মধুর শারাব দিলে আল-আরাবী সাকি।’ ‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে।’ ‘ইয়া মুহাম্মদ বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও’ ইত্যাদি প্রায় একশটির মত নাত-এ-রাসুল লিখেছেন তিনি।

কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছেন অসংখ্য হামদ-এ-বারি তাআলাও। তাঁরচেয়ে আবেগঘন করে হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গ হামদ-এ-বারি তাআলা এ যাবত কেউ লিখতে পারেননি। তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্মরণে বলেন—

এই সুন্দর ফুল,
সুন্দর ফল,
মিঠা নদীর পানি,
খোদা তোমার মেহেরবানি।

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাঁর সৌন্দর্যও বর্ণনা করেছেন সুললিত সুর মোহনায়। তিনি লিখেন—

হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর
তোমার মনোহর রূপের ছায়া,
রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়
রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।’

আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের যে সূত্রটি পবিত্র কুরআনে চিহ্নিত হয়েছে কবি নজরুল গানে গানে তা চিত্রিত করেছেন। আল্লাহ বলেন—ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত তাবিয়ূনি ইয়ুহবিবকুমুল্লাহ—’যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমারই অনুসরণ করো, আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’ নজরুল সে কথাই গজলে গেয়ে বলেন—

আল্লাহকে যে পাইতে চায়,
হযরতকে ভালবেসে,
আরশ কুরসী লৌহ কালাম—
না চাইতেই পেয়েছে সে।
রাসূল নামের রশি ধরে,
যেতে হবে খোদার ঘরে
নদী তরঙ্গে যে মিশেছে ভাই,
দরিয়াতে সে আপনি মেশে।
হযরতকে ভালবেসে।

আগেই বলা হয়েছে—বাল্যবেলা থেকেই ইসলামি জ্ঞান ও সভ্যতার শিক্ষা তিনি গভীরভাবে অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর সে শিক্ষার ছাপ পাওয়া যায় তাঁর রচিত গজল গানে। তিনি যে পাক কুরআন ও সুন্নাহ তথা আল্লাহর কালাম ও নবির হাদিসভিত্তিক ইসলামের আদর্শকে তাঁর গানে মূল উপজীব্য করেছেন তা তার ইসলামি গানের বাণীর দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়। কবি প্রফুল্ল ও শান্তচিত্তে গেয়ে বলেন—

যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী,
সেদিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাজি।
সেদিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে,
পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফ্সি ডেকে
আমি তোমায় দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি।
যে রূপে হোক বারেক যদি দেখে তোমায় কেহ
দোজখ কি আর ছুঁতে পারে পবিত্র তার দেহ
সে হোক না কেন হাজার পাপী হোক না বেনামাজি।
ইয়া আল্লাহ তোমার দয়া কত তাই দেখাবে বলে
রোজ হাশরে দেখা দেবে বিচার করার ছলে।
প্রেমিক বিনে কে বুঝিবে তোমার এ কারসাজি।

এ যেন পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ‘লা খাউফুন আলাইহিম ওয়ালা হুম ইয়াহযানুন’ এর মর্মবাণী সুরের মূর্ছনায় ধ্বনিত হয়েছে। যার অর্থ মুমিন বিশ্বাসীর কোনো ভয় নেই, লয় নেই। কবি তাই হাশরের মাঠের ভয়াবহ দিনে সন্ত্রস্ত না হয়ে বরং আল্লাহর দর্শন লাভের প্রত্যাশায় প্রীত। অন্য এক গজলে তিনি লিখেন—

আল্লাহ আমার প্রভু
আমার নাহি নাহি ভয়,
আমার নবী মোহাম্মদ,
তাহার তারিফ জগৎময়।
মুসলিম জাগরণে নজরুলের গজল যেন এক জীয়নকাঠি

নজরুলের সময়টায় যেহেতু মুসলিমরা এক দুঃস্বপ্নের কালোরাত অতিক্রম করছিল। কঠিন ক্রান্তিলগ্নে তারা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আলস্য আর গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল ; অথচ পেছনে তাকালে মুসলমানদের অবদান আর বিপুল সৃষ্টিশীলতা বৈ কিছুই গোচরীভূত হয় না, সুতরাং নজরুল চান মুসলমানদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে। মুসলমানের হৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার করতে এবং নবজাগরণ ঘটাতে। তাই তিনি লিখে চললেন দৃপ্তভাষ্য চেতনা উদ্দীপিত গজল গান—

হাতে হাত দিয়ে আগে চল হাতে নাই থাক হাতিয়ার,
জমায়েত হও আপনি আসিবে শক্তি জুলফিকার।
আন আলীর শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অশান্ত ভেঙে কর একাকার।

এ রকম আর একটি গানে তিনি লিখেছেন—

ধর্মের পথে শহীদ যাহারা,
আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা,
বিশ্ব করেছি জ্ঞাতি।

এভাবেই আমাদের দুখু মিয়া তাঁর ইসলামি গানে মুসলিম জাগরণের কথা, সমাজ সচেতনতা, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, সংগ্রাম ও শান্তির বারতা দিয়ে একদিকে যেমন ইসলামি গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ তেমনই তাঁর হৃদয় নিঃসৃত ভক্তিমূলক গান দিয়ে ইসলামের সব দিক তুলে ধরেছেন আপামর জনতার হৃদয়ের চৌকাঠে। তাৎপর্যপূর্ণ রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি প্রভৃতিও উঠে আসায় মুসলিম স্কলারগণের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নেন পোখত করে। কেনই বা নয়; তিনি যা করেছেন রীতিমত বিস্ময়! কবি নিজের ওপর প্রবল আত্মবিশ্বাসে তাই বলে গিয়েছেন—‘কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কী দিয়েছি জানি না। আমার আবেগে এসেছিল তাই আমি সহজভাবে বলেছি। আমি যা অনুভব করেছি তাই বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে দান আমার কতটুকু জানা নেই, তবে এইটুকু মনে আছে, সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি!’

ইসলামের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভক্তি-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতিফলন থেকেই তিনি এ অসাধ্য সাধন করেছেন। একাই জয় করেছেন এক বিশাল রাজ্য। তাই দেখা যায়, তিনি যখন আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার ব্যাকুল আশায় নিমগ্ন তখন কী মিনতিভরা কামনা ঝরছে তার কাব্যসুরে—

মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই,
যেন কবর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।

কবির এমন ভাবাবেগ ও ধর্মীয় অনুরাগ মুসলিমদের জন্য নতুন করে চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত করেছে। তিনি যখন তাঁর বিরচিত সাহিত্যের জোয়ারে সকল পঙ্কিলতাকে বৃষ্টিজলে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন তখন মুসলিম মনীষীদের গভীর নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। নজরুলের সুরে গান জপে জেগে উঠেছে মুসলিম তমদ্দুন ও তাহজিব। মৃত জনপদে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এভাবেই নজরুল জয়ী হলেন বাংলা গানের ওপর। বিশ্ব দরবারে উঁচু করে তুলে ধরলেন বাংলা ইসলামি গানের বিজয় মুকুট। ফলে একদিন যারা তাঁকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন তারাই আবার তার ইসলামি গান শুনে চোখের পানি সম্বরণ করতে পারেননি।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: