বাংলা সাহিত্যে মাহে রমজান

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৫৭

প্রতীকী ছবি প্রতীকী ছবি

রমজান মাসের রোজা ইসলামের মৌলিক একটি ভিত্তি। রমজান ও রোজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও সমৃদ্ধ হয়েছে। রমজানের চাঁদ দেখা, রোজার নিয়তে ভোররাতে সাহরি খাওয়া, সূর্যাস্তের পরপরই ইফতার করা, তারাবিহ, ইতিকাফ, লাইলাতুল কদর, সদকাতুল ফিতর, ঈদুল ফিতর ইত্যাদি বাংলাদেশের জনমনে প্রসন্নতার সুরভি এনে দেয়।

এ কথা স্বীকার্য যে, বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশের এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার মৌলিক পাঠ সূচিত হয় বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মুসলিম কবিরা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কেও রচনা করেছেন কমবেশি। পরে রমজান ও রোজা বিষয়ে বেশ কিছু কাব্য ও গদ্য রচিত হয়।

ইসলামী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের কবি ফররুখ আহমদ তার শবে-কদর কবিতায় বলেছেন-

‘এখনো সে পুণ্য রাত্রি নামে পৃথিবীতে, কিন্তু প্রাণ/এক অন্ধকার ছেড়ে অন্য এক আঁধারে হারায়, ঊর্ধ্বের ইঙ্গিত আসে লক্ষ মুখে, অজস্র ধারায়; নর্দমার কীট শুধু পাপ-পঙ্কে খোঁজে পরিত্রাণ। ... আত্মার প্রশান্তি গ্রাস করে ছায়া উদ্ভ্রান্ত মতের;
সে আজ দেখাতে রাহা এ সংশয়ে,... শবেকদরের/(কত অপলক দৃষ্টি জাগে আজও যে পথ-সন্ধানে); জুলমাতের এলাকায় বলে দাও নিঃসঙ্গ খিজির।’

রমজানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, রমজান সব ভেদাভেদ ভুলিয়ে দেয়। সবাইকে কল্যাণকামী ও সহমর্মী করে তোলে। রমজান মুসলমানের ইবাদতের ভরা বসন্ত। মুমিন হৃদয়কে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে। এর আবির ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। রমজান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দেয় নতুনমাত্রা।

নতুনভাবে রাঙিয়ে নেয় ঈমানের রঙে তারই হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনা দেখি আমরা পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের তারাবি কবিতার ছত্রে ছত্রে

‘নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,
মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।
চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,
ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।
তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,
চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লণ্ঠন-বাতি জ্বেলে।
ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।
মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।’

কবি শাহাদাৎ হোসেন রমজানকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছেন
‘তোমারে সালাম করি নিখিলের হে চির কল্যাণ
জান্নাতের পুণ্য অবদান!’

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘কেন জাগায়লি তোরা’ কবিতায় রমজানকে উপস্থাপন করেছেন বিপ্লবী অনুরণনে
‘‘মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’,
নামিবে তাহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।
এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ,
চিরকাল রোজা রাখিবে না আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ।”

মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ ‘ইসলামের মহাব্বত রোজা’ শীর্ষক প্রবন্ধে রোজার উদ্দেশ্য তুলে ধরেছেন এভাবে ‘...রোজার উদ্দেশ্য শুধু অনাহারে থাকা নয়। পরন্তু ‘দৈহিক ও মানসিক উভয়বিধ সংযম এবং সেই সংযমজনিত নিবৃত্তি ও প্রশান্তির স্নিগ্ধ পরিবেশে আল্লাহর দিকে মনের একাগ্রতা সাধনই ইসলামের নির্দেশিত রোজার মূল লক্ষ্য।’

রোজার মাহাত্ম্য তুলে ধরে ‘সিয়ামের তাৎপর্য’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন- ‘কাম প্রবৃত্তির অসংযত সন্তোষ বিধানের ফলে মানুষ পশুত্বের চরম স্তরে নেমে যায়। ক্রোধ মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করে। এ জন্য এগুলোর দাহনের জন্য এ দুনিয়ায় আল্লাহ সিয়ামের প্রবর্তন করেছেন। যাতে এ দাহনের ফলে মানুষ এ বিশ্বে তার প্রকৃত স্থান নির্দিষ্ট করতে পারে, সে যাতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’

রমজান তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। সার্থকতা অর্জন করতে হলে রোজাদারকে কী কী করা উচিত, সে সম্পর্কে ডক্টর আইয়ুব আলী বলেন, ‘সিয়ামের উদ্দেশ্যাবলি সার্থক করতে হলে সিয়াম পালনকারীকে প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও রিপুগুলোকে অন্যায় থেকে বিরত রাখতে হবে এবং ন্যায়ের অনুশীলন করতে হবে। সারা দিন হালাল দ্রব্য গ্রহণে বিরত থেকে ইফতারির সময় যদি অন্যায় ও অবৈধভাবে উপার্জিত খাদ্যাদির দ্বারা ইফতার করা হয়, তবে সওয়াবের পরিবর্তে আরো গুনাহর কাজ করা হলো তা সাধারণ জ্ঞানেও বোঝা যায়।’

কবি আজিজুর রহমান তার ‘রোজা’ কবিতায় রোজার গুরুত্বারোপ করে বলেছেন-
‘রোজা রেখে করো অনুভব/ক্ষুধার কেমন তাপ
দেহমনের সেই সাধনায়/পুড়িয়ে নে তোর পাপ।’...
কবি নূর মোহাম্মদ তার ‘রমজান’ কবিতায় লিখেছেন-
নতুন চাঁদের নূরের জোয়ার/রমজান মাসের শুরুতে
সেই জোয়ারে আসে আষাঢ়/ মুমিন মনের মোরুতে,
এমনি করে রমজান এসে/নূরের সুধা ভাসায়
শরীর মনে রোজার রসে/খোদার মায়া মাখায়।
কবি সাবির আহমদ চৌধুরী বলেন
‘একটি বছর পরে আবার/কুল মুসলিম বিশ্ব ধরায়
সিয়ামের মাস এলো রমজান/আব হায়াতের শান্তি সুধায়।
আত্ম অহং চিত্তদহন/বিনয় নম্র সংযমী মন।
কুল রোজাদার সব কে-খোদা/খাস রহমতের শিরনী বিলায়।’

ফজল-এ-খোদা রমজান নিয়ে অনেক কবিতা রচনা করেছেন। এক কবিতায় লিখেছেন-
‘আল্লাহ তোমার হাজার শোকর/দিলে মাহে রমজান
অধম নাদান বান্দার তরে/তুমি যে মেহেরবান।
রমজানের এই রহমতী মাস/মিটায় প্রাণের বেহেশতী আশ
খোদা আমরা তোমার দাসানুদাস/চাই যে শান্তি সত্য জ্ঞান।’
তিনি সাহরি নিয়ে ও বলেছেন-
‘জাগো জাগো রোজাদাররা জাগো/জাগো রে এবার
লও সেরে লও থাকতে সময়/সেহরি তোমার।’

সৈয়দ এমদাদ আলী লাইলাতুল কদর নামে দীর্ঘ কবিতায় বলেছেন
‘বর্ষে বর্ষে আসে সে রজনী/ল’য়ে তার স্মৃতির সম্ভার,
বহাইতে মোসলেম অন্তরে/অনাবিল পুণ্যের পাথার।’

রমজান সর্বাধিক বরকতময় মাস। এই মাসে বহু ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের এক মহাসমাবেশ ঘটেছে।

এই মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, এই মাসে দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এই মাসে মাগফিরাত লাভের অফুরন্ত সুযোগ আসে। এই সুযোগ লাভ থেকে আমরা যেন নিজেদের বঞ্চিত না করি। আমাদের সবার জীবনে মাহে রমজান মোবারক হোক।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: