মহাকবি আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট নাম। মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের নাম নিলে যার নামটি সর্বাগ্রে আসে তিনিই বাঙালি জাতিসত্ত্বার কবি আলাওল। তাঁর পূর্ণনাম সৈয়দ আলাওল (১৬০৭-১৬৮০)। পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সুবিখ্যাত। যদিও ‘পদ্মাবতী’ কোনো মৌলিক রচনা নয়। তবুও বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের বিচারে মধ্যযুগে পদ্মাবতী এক অনন্য উপাখ্যান। যা আলাওলকে মহাকবি উপাধিতে ভূষিত করে। পদ্মাবতী” হলো এক সিংহলী রাজকন্যা পদ্মাবতীর উপাখ্যান বা কাহিনি।
পদ্মাবতী রচনার কারণেই মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে বিশেষত মুসলমান কবিদের মধ্যে আলাওলকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়। আলাওল আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি। তিনি একাধারে আরবি, ফার্সি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার যথেষ্ট পান্ডিত্য ছিল। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, আধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্রীয় ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শীতার কারণে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সাধারণ এবং বিরল প্রতিভা।
কবি সৈয়দ আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ সালে তৎকালীন মাদারীপুর জেলার ফতেয়াবাদে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে মাদারীপুরের জালালপুরে অবস্থিত। তার পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ এ কুতুবের অমাত্য। তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি এবং সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের মতে, কবির জন্ম-ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে এবং মৃত্যু বৃদ্ধ বয়সে ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে। জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আলাওল ও তার পিতা পর্তুগিজ জলদুস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন ও তার পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতঃপর তিনি জলদস্যুদের হাতে পড়েন এবং ক্রীতদাস হিসাবে আরাকানে নীত হন। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আরাকানে।
তিনি আরাকান রাজ সাদ উমাদার এর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলে একসময় তিনি হয়ে পড়েন রাজসভার কবি। তাকে কাব্যচর্চায় বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন আরাকান রাজার একজন প্রধান কর্মচারী যার কোরেশি মাগন ঠাকুর।
আলাওলের প্রধান কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতী। এই কাব্য ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ-এর অনুবাদ। আলাওল কর্তৃক পদ্মাবতী লেখার পেছনের প্রেক্ষিত হল- দেখতে দেখতে আলাওলের কবি প্রতিভার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। সকলেই জানলো আলাওল শুধু গানের ওস্তাদই নন কবিও বটে। তাঁর যেমন সুর, তাল, লয় জ্ঞান আছে তেমনি আছে শুদ্ধ ছন্দ ও মাত্রা জ্ঞান। আলাওলের ভেতর যে সত্যিকারের একজন কবি লুকিয়ে আছে তা মাগন ঠাকুর আগেই টের পেয়েছিলেন। তাঁর লেখা সঙ্গীতের পদগুলো পড়ার পর মাগন ঠাকুর আরো মুগ্ধ হলেন।
তখন ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন রাজদরবারে বেশকিছু জ্ঞানী-গুণী বেষ্টিত হয়ে মাগন ঠাকুর বসেছিলেন। আলাওলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নানা বিষয়ে তাঁরা আলাপ করছিলেন। কেউ গান শোনাচ্ছিলেন, কেউ গল্প করছিলেন আবার কেউবা গভীর জ্ঞানের কথা বলছিলেন। মাগন ঠাকুর সবার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন এবং নানা জনকে নানা উপহারাদি দিচ্ছিলেন উৎসাহ দেওয়ার জন্য। এক এক কথার সূত্র ধরে নানা কথার জন্ম হয়। কথার ডালপালা ছড়িয়ে যায়। এভাবেই তাঁদের মধ্যে কেউ একজন পদ্মাবতীর কথা তুললেন। পদ্মাবতীর কাহিনি নিয়ে ‘পদুমাবৎ’ হিন্দি ভাষায় লেখা অপূর্ব এক কাব্য। হিন্দি ভাষায় লেখা পদুমাবৎ রচনা করেছেন মালিক শেখ মোহাম্মদ জায়সী। জায়সী খাঁটি মুসলিম হলেও তিনি যোগশাস্ত্র হিন্দু পুরান ইত্যাদিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনিই প্রথম ফারসী হরফে হিন্দি ভাষা লিখতে শুরু করেছিলেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘পদুমাবৎ’ রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।
কাব্যটির কথা উঠতেই মাগন ঠাকুরের মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি ভাবলেন এমন একটি কাব্য যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। কারণ সাহিত্যমানের দিক দিয়ে পদুমাবৎ অতুলনীয়। এটি বাংলায় লেখা হলে নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। মাগন ঠাকুরের মনে হলো এই কাজটি একমাত্র আলাওলকে দিয়েই সম্ভব। আলাওলের সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে মাগন ঠাকুরের উচ্চ ধারণা ছিল। সেদিন সকলের সামনেই মাগন ঠাকুর আলাওলকে ডেকে বললেন, আজ আপনাকে একটা মহান কাজের দায়িত্ব দেব। পদ্মাবতীর অপূর্ব কাহনীটি হিন্দুস্তানী ভাষায় লেখা। আরাকানের অনেক লোকই তা বোঝে না। বাংলা ছন্দে যদি আপনি এটি নতুন করে রচনা করেন তবে সকলে সেই কাহিনি পড়ে প্রভূত আনন্দ পাবে। আপনি কবি, অশেষ জ্ঞানী মানুষ। মালিক মোহাম্মদ জায়সী তাঁর পদুমাবৎ কাব্যে পদ্মাবতীর যে রূপ বর্ণনা করেছেন বাংলা ভাষায় তা আপনি ছাড়া কেউ পারবে না। আপনার প্রতি সেই বিশ্বাস আমার আছে।
আলাওল মাগন ঠাকুরের কথা শুনে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন। কারণ ইতঃপূর্বে তিনি কিছু পদ রচনা করলেও এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। এদিকে মাগন ঠাকুর আলাওলের আশ্রয়দাতা। তাঁর অনুরোধ আলাওলের কাছে আদেশেরই সমান। আলাওল বললেন, পদুমাবৎ কাব্যটি আমি কয়েক বার পড়েছি। অসাধারণ এই কাব্যটি কাহিনি কাব্য হলেও এর মাঝে রয়েছে অনেক আধ্যাত্মিক বিষয়। আমারও অনেকবার মনে হয়েছে এটি বাংলা ভাষায় রচিত হওয়া প্রয়োজন। আমার গ্রন্থ রচনার অভিজ্ঞতা নেই। দু-একটি পদ রচনা করেছি মাত্র। আপনি আমাকে উপযুক্ত মনে করেছেন ভেবে সম্মানিত বোধ করছি। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। আপনার যশ-কীর্তির কথা বর্ণনা করার সাধ আমার অনেকদিনের। আজ সুযোগ এসেছে। এই কাজ আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অসম্ভব বটে তবু আমি আমার সমস্ত মেধা দিয়ে কাজটি করবো শুধু আপনার গুণে আর পদ্মাবতীর কাহিনীর আকর্ষণে। আপনি এবং আপনার সভাসদ আমাকে দোয়া করবেন। মাগন ঠাকুর বললেন, আপনি আল্লাহ তায়ালা’র নাম নিয়ে কাজ শুরু করে দিন। ইনশাআল্লাহ আপনি সফল হবেন।
মাগন ঠাকুর এর প্রত্যক্ষ উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং তদারকিতে আলাওল কাজ শুরু করে দেন। এ কাব্য লিখতে তাঁর প্রায় তিন বছর সময় লাগে। ১৬২৫ সালে শুরু করে ১৬২৭ সালে শেষ করেন। অত:পর তিনি আরাকানপতির আত্মীয় সৈয়দ মুসার উৎসাহে সয়ফল মুলুক ও বদিউজ্জামাল নামক পারস্য গ্রন্থ অনুবাদ করেন। মধ্যযুগের আরেক কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী শেষ করেন আলাওল। এছাড়া তার উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে : তোহ্ফা, দারাসেকেন্দারনামা প্রভৃতি। কবি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের একটি অন্তরা উল্লেখ না করে পারছি না। এই যেমন: প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস/ ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ/
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর/ মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর। ------- সবার আরাধ্য প্রেমের নিমিত্তে কবির কী অসাধারণ কাব্যকথা! প্রেম নিয়ে লেখা এই চারটি চরণ পাঠে প্রেমের অন্তহীন মহিমা এবং মাহাত্ম্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।
মহাকবি আলাওল তার বিখ্যাত সপ্ত পয়কর কাব্যে রাসুল বন্দনার প্রসঙ্গে লিখেছেন:
আদ্যেতি নিরুপ ছিল প্রভূর নির্বাকার।/চেতন স্বরুপ যদি হইল প্রচার।।/অতি ঘোরতর তমঃআকার বর্জিত।/
মহা জ্যোতিমংয় হৈল আল্লার-ঈঙ্গিত।।/জ্যোতি সমুদ্রে আদ্যি নুর মহাম্মদ।/ জগৎ বিজয়ী হৈতে পাইল সম্পদ।।/সপ্ত স্বর্গ উদ্যানের আদ্য নব ফুল।
বৃদ্ধি বাক্যে শিরোমণি ভূবনে অতুল।।/সেই পুস্প হৈতে আদ্যে আদম উজ্জল।/ সকল কদর্মপূর্ণ সে-ই নির্মল।
কবি আলাওল দৌলত কাজির অসমাপ্ত কাব্য সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী” গ্রন্থে মোহাম্মদের ‘সিফত’ বয়ান করেছেন এভাবে: আহাদ আছিল এক/ মিম হন্তে পরতেক/ যে মিমেত জগৎ মোহন--- মধ্যযুগের একজন কবির শব্দচয়ন, ভাবনার বিস্তার এবং বাক্যগঠন আজও সচেতন পাঠকমহলে সমাদৃত। আজও আমরা মহাকবি আলাওল এর কবিতা পড়ি। পড়তে পড়তে মধ্যযুগে চলে যাই। মধ্যযুগের কবিদের চিন্তা-চেতনা, মন-মানস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার পাশাপাশি নিজেকে সমৃদ্ধ করি।
বাংলাদেশে মহাকবি আলাওলের নামে একটি সাহিত্য পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে।
প্রতি বছর বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বিভিন্ন কবি এবং সাহিত্যিককে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুরুষ শিক্ষার্থীদের ডরমিটরি ও ছাত্রাবাস তাঁর নামে আলাওল হল হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। তবে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস, এতোটুকুর মধ্যেই আলাওল চর্চা থেমে যাওয়া উচিত নয়। আমরা যারা আজ কবিতার সাথে সংশ্লিষ্ট আছি কিংবা সাহিত্যের অন্য যে কোনো শাখার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ এবং সমৃদ্ধির জন্য কাজ করছি--- তাদের সবার মনে রাখা উচিত মহাকবি আলাওল আমাদেরকে পথের দিশা দিয়েছেন। তাই তাঁকে নিয়ে আরও অনেক গবেষণা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: