মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ:)-এর অমর কীর্তি

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৪ জানুয়ারী ২০২৪ ২১:০৪

মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ:) : সংগৃহীত ছবি মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রহ:) : সংগৃহীত ছবি

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন এক কিংবদন্তি। ইসলামি সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইলমে ফিকহ, সিরাত শাস্ত্র ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সাংবাদিকতার এক উপমাহীন ব্যক্তিত্ব। তার মতো উদার ইসলামি চিন্তক, রাজনৈতিক ও সাংবাদিকের উদাহরণ তিনি নিজেই। নিকট অতীতে তার মতো বহুমুখী প্রতিভাধারী ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাওয়া খুবই দুরূহ।

গোটা মুসলিম সমাজ আজ বহুধাবিভক্ত। রাজনীতি, সমাজনীতি, মাসলাক ও মাশরাব, পীর-মুরিদি, তরিকতের সিলসিলা, সালাফি, মাদানি, দেওবন্দি, আজহারি, কথিত ওয়াহহাবি, সুন্নি ইত্যাদি নিয়ে এই বিভক্তি। এসবের ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিম মিল্লাত নিয়ে চিন্তা করতেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। নির্দিষ্ট মত ও পথের অনুসারী হয়েও মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক হয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। তার দর্শন ছিল ইসলামের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে মতপার্থক্য থাকবেই। তবে মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা এক ও অভিন্ন। বৈপরীত্যের মধ্যেও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য থাকা বাঞ্ছনীয়। এই চিন্তা নিয়ে তিনি মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্যের বৃহত্তর প্লাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। কোনো সময় তাকে দেখা গেছে ইত্তিহাদুল উম্মাহ গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, কোনো সময় ইসলামি সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ইসলামি ঐক্যজোটে অংশগ্রহণ আবার কখনও ওলামা মাশায়েখ পরিষদ নামে ঐক্য প্রক্রিয়ায় রয়েছে তার অবদান। এসব সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় পদেও তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। সর্বশেষ জাতীয় রাজনীতিতে ২০ দলীয় ঐক্যজোটের শীর্ষনেতা হিসেবে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সাহিত্য ও সাংবাদিকতার এক প্রবাদপ্রতীম মানুষ ছিলেন মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। মাসিক মদিনার সৃষ্টি ছিল তার অমর কীর্তি। সাধারণ শিক্ষিত থেকে নিয়ে মসজিদ ও মাদ্রাসার গ-িতে যারা রয়েছেন সবার কাছে ছিল তা সমাদৃত। মন্ত্রমুগ্ধকর অজিফার মতো ছিল তাদের কাছে মাসিক মদিনা। এক সংখ্যা পাঠ করে অপেক্ষায় থাকতেন পরবর্তী সংখ্যা কবে পাওয়া যাবে। মাসিক মদিনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল শুরু ও শেষের অংশ।

শুরুতে ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার অত্যন্ত সুচিন্তিত সম্পাদকীয়, আর শেষে ছিল পাঠকদের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে যুগজিজ্ঞাসার সুতীক্ষ সমাধান। অত্যন্ত জটিল বিষয়গুলোকে সাবলীল ভাষায় তিনি সমাধান দিতেন। তার উত্তরদান ছিল অনেকটা ‘ইলহামি’ এবং ‘ইলমে লাদুনি’নির্ভর। একের পর গ্রন্থের ফিরিস্তি থাকত না সমাধানের নিচে বরাত হিসেবে।

লিল্লাহিয়াত বলতে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধান। মাওলানা খানের যাবতীয় কর্মকা- ছিল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি বিধানের লক্ষ্যে। মাসিক মদিনার কোনো নিবন্ধে তার অসাবধানতাবশত কোনো ভুল কিছু ছাপা হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে এর সংশোধনী দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। নিবন্ধকার যেই হোক, সম্পাদক হিসেবে দায় তার ওপর বর্তায়। এর সংশোধনী দেওয়াও তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

সম্ভবত ১৯৮৬ সালের কথা। তখন আমি দাওরায়ে হাদিসে অধ্যয়নরত। এক লেখক ‘গান-বাজনার স্বরূপ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। (আমার কাছে কপিটি সংরক্ষিত নেই, শিরোনামে হেরফের হতে পারে)। এই লেখার কিছু অংশ আপত্তিকর ছিল। কোরআন ও সুন্নাহের আলোকে হয়নি বলে আমি মনে করি। তাৎক্ষণিক আমি এর বিরুদ্ধে দলিল-প্রমাণসহ একটি লেখা তৈরি করে সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দিই। পরবর্তী সময়ে সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় তিনি আমার প্রতিবাদী লেখাটি প্রকাশ করেন। এভাবে পাঠক প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরও বহু লেখার সংশোধনী দিয়েছিলেন। হঠকারিতামূলক মনোভাব ছিল না মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের।

মাসিক, সাপ্তাহিক বা দৈনিক পত্র-পত্রিকাগুলো প্রকাশের পেছনে অঘোষিত কিছু উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। গোপনে সেই সংস্থা, রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করে যায়। মাসিক মদিনা প্রতিষ্ঠায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের এমন কোনো লক্ষ্য ছিল না। তিনি রাজনীতি করেছেন। এককালে হাফেজ্জি হুজুরের রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম ছিলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি ছিলেন। তবুও রাজনৈতিক কাজে মাসিক মদিনাকে ব্যবহার করেননি। তার সম্পাদিত পত্রিকা দিয়ে ইসলামের মধ্যে কোনো গ্রুপও সৃষ্টি করে যাননি। ইসলাম কোনো দল, উপদল তৈরি করা অনুমোদন করেনি। এরশাদ হয়েছেÑ ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।’ (আলে ইমরান : ১০৩)।

মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের সমাজে ছিল ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। শিক্ষিত সমাজে ছিল তার বহু ভক্ত-অনুরক্ত। ওলামায়ে কেরামের ছিলেন তিনি মধ্যমণি। চাইলে তিনি একটি উপদল সৃষ্টি করে যেতে পারতেন। কিন্তু না, বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহই ছিল তার দল।

একরোখা মনোভাবের মানুষ ছিলেন না মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। যেখানেই মণিমুক্তা পেয়েছেন সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করেছেন। তিনি কোন ঘরানার মানুষ, সেটি তার কাছে বিবেচ্য ছিল না। মাওলানা আকরম খাঁর সাংবাদিকতা, যাফার আহমদ উসমানীর হাদিস চর্চা, সদর সাহেব হুজুরের উদারতা, হাফেজ্জি হুজুরের তওবার রাজনীতি, মাওলানা আবদুর রহিমের সাহিত্য সাধনা এবং আরও নাম না নেওয়া অনেক বিদগ্ধজন থেকে আহরণ করেছেন চিন্তা-চেতনা। এজন্য মাওলানা খানের মধ্যে ফুটে উঠেছিল বৈচিত্র্যময় প্রতিভা। যেই অঙ্গনে তিনি যেতেন, মনে হতো তিনি এই অঙ্গনেরই মানুষ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ছিল মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রিয় বিষয়। ১৯৬০ সালে ‘সিরাত মজলিস’ এর মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনের সূচনা করেন। পরবর্তী সময়ে এটি ‘জাতীয় সিরাত কমিটি’তে রূপান্তরিত হয়। নবী জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তিনি চর্চা করতেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) তার আত্মজীবনী ‘জীবনের খেলাঘরে’ গ্রন্থে মাসিক মদিনার প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন : ‘দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে প্রিয় নবীজি (সা.) এর পবিত্র সিরাত সম্পর্কিত যে কোনো মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়, তা কুড়িয়ে এনে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের খেদমতে হাজির করাই মাসিক মদিনার সর্বাপেক্ষা বড় সাধনা।’ তাই মহানবী (সা.) এর সিরাতবিষয়ক যেকোনো গবেষণায় তিনি আগ্রহ দেখাতেন, এর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। রবিউল আউয়াল মাস উপলক্ষে তার তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর ‘সিরাত স্মারক’ প্রকাশিত হতো। মহানবী (সা.) এর ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ছবি সংবলিত অ্যালবাম এদেশে সম্ভবত তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন। তার মালিকানাধীন মদিনা পাবলিকেশনন্সে সিরাতবিষয়ক গ্রন্থের সমাহার রয়েছে সর্বাধিক। বিভিন্ন যুগের মনীষীদের সিরাতবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ অতি আগ্রহ সহকারে তিনি অনুবাদ করে গেছেন।

অনূদিত বইয়ের বাংলা নামকরণে তিনি গভীর পা-িত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল হাবীব’ গ্রন্থের অনূদিত নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘হৃদয়তীর্থ মদিনার পথে’। এছাড়া রওজা শরিফের ইতিকথা, আল্লামা আবদুর রহমান জামীর ‘শাওয়াহিদুন নবুওয়াত’, ইমাম সুয়ূতীর ‘খাসায়িসুল কুবরা’ ইমাম গাজ্জালির ‘আল মুরশিদুল আমীন’, ‘উসওয়ায়ে রাসুলে আকরাম (সা.)’ ‘স্বপ্নযোগে রাসুলুল্লাহ (সা.)’সহ বিশ্ববিখ্যাত সিরাত গ্রন্থগুলোর অনেকগুলোই তিনি অনুবাদ করে বাংলা ভাষাভাষী নবী প্রেমিকদের আশা-আকাক্সক্ষা অনেকাংশে পূর্ণ করে গেছেন।

উর্দু ভাষায় রচিত মাআরিফুল কোরআন মুফতি শফি (রহ.) এর একটি অনবদ্য তফসির গ্রন্থ। আট খ-ের এই সুবিশাল তাফসির গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদ করেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তার এই অনুবাদটি এতই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, এদেশে মাআরিফুল কোরআন নাম নিলে মানুষের হৃদয়ে মুহিউদ্দীন খানের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন তার এই অনুবাদকর্মটি প্রকাশ করে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিরাট চাহিদা পূরণ করেছে। এর মাধ্যমে সরকারি এই সংস্থাটি গণমানুষের ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। মদিনা তায়্যিবায় অবস্থিত খাদিমুল হারামাইন শরিফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক সংক্ষিপ্ত রূপে তার অনূদিত মাআরিফুল কোরআন (এক খ-ে) প্রকাশ করে, বিনামূল্যে তা বিতরণ করেছে। এর মুদ্রণ, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই ও সেটাপ-গেটাপ ছিল অসাধারণ। এতে কোটি কোটি বাংলাভাষী মুসলিম সমাজ এই তফসির গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের! নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে বিতর্কের কারণে এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আল কোরআনের স্বাদ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেÑ লক্ষ-কোটি মুসলিম সমাজ। যেসব বোদ্ধা এর অহেতুক ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে প্রকল্পটি বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছেন, তারা সংশোধিত ও পরিমার্জিত আকারে তা প্রকাশ করার পরামর্শ দিতে পারতেন।

আজকাল অনেকেই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে লেখালেখি করছেন। হয়েছেন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখক, গবেষক, অনুবাদক, সম্পাদক, কলামিস্ট কিংবা সাংবাদিক। এদের অনেকেরই প্রেরণার বাতিঘর ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। লেখক জীবনের শুরুতে কেউ কেউ চাকরি করেছেন তার প্রতিষ্ঠানে। কেউ আবার কিছু লিখে তাকে দেখাতে ছুটেছেন মদিনার কার্যালয়ে। অনেকে লেখালেখি সম্পর্কে পরামর্শ নিয়ে ধন্য হয়েছেন তার কাছ থেকে। দোয়া ও অভিমত দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন বহু কলমসৈনিককে। তার দুয়ার খোলা ছিল সবার জন্য। হাসিমুখে গ্রহণ করতেন লেখক জগতের সবাইকে। যে কারও লেখা দেখতেন গভীর মনোযোগে। পরামর্শ দিতেন দিল মন উজাড় করে। আমি নিজেও বহুবার ছুটে গিয়েছি তার বাংলা বাজার ও পল্টনের কার্যালয়ে। আদর স্নেহ দিয়ে সিক্ত করেছেন অধমকে।

একসময় বাংলা ভাষার প্রতি ছিল ওলামায়ে কেরামের অনীহা। আরবি ও উর্দুকে মনে করা হতো ইসলামের ভাষা। তিনিও তার মতো আরও কিছু দিকপালের উৎসাহে মাতৃভাষা বাংলা আজ ওলামায়ে কেরামের কাছেও প্রিয় ভাষা। আরবি ও উর্দু কিতাবের পঠন-পাঠনে ও ওলামায়ে কেরাম সাগ্রহে গ্রহণ করছেন বাংলা ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে। উল্লেখ্য, কোনো ভাষায়ই আল্লাহর কাছে অপ্রিয় ভাষা নয়। ভাষার বৈচিত্র্য আল্লাহর দান। এতে রয়েছে আল্লাহর মহিমা ও কুদরতের নিদর্শন।

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষায় বেড়ে ওঠা এক মানুষ ছিলেন মরহুম মুহিউদ্দিন খান। ‘জীবনের খেলাঘরে’ তার নিজের স্মৃতিচারণমূলক একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ। উদীয়মান সবার তা থেকে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। পরিণত জীবনে আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রতিষ্ঠাও দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে উচ্চ মর্যাদা দান করুন।


সূত্র : মুসলিম বাংলা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: