আফগানিস্তানের শিল্প-সাহিত্য

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:২৩

গ্রাফিক্স গ্রাফিক্স

যদি কেউ জানতে চান, আফগান কারা বা তাদের শিল্প সাহিত্যের অবস্থা কি? তাহলে তাকে প্রাচীন সব বই-পুস্তক ফেলে দিয়ে, দেখতে হবে মুখে মুখে রচিত তাদের প্রাচীন সাহিত্যের ভাণ্ডারের দিকে। কী অসাধারণ সব রচনা রয়েছে সেখানে! কী কাব্যে? কী গদ্যে? পাশতুন কবিতা মানেই তো হৃদয় বিদারক সত্যভাষণ এবং সত্যের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নিটোল বন্দনার গীতি। এই বিষয়ে ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত শের জামান-তেইযির বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য ফিল্ড পাঠ করলেই সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়।

এমনকি সাম্প্রতিককালের তালেবান শাসকগোষ্ঠীও তাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছেন। তারা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর সব কবিতা রচনা করেছেন। এই আধুনিক যুগে এসে আফগান সাহিত্যে, বিশ্বসাহিত্যে জায়গা করে নেয়ার মতো অতি উন্নতমানের প্রচুর পরিমাণে কবিতা, ছোট গল্প এবং উপন্যাস রচিত হয়েছে।

আফগান সাহিত্যের ইতিহাসকে জানতে হলে, একটু পেছন ফিরে না তাকালে ঠিক হবে না। কেননা, প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৮ হাজার বছর আগের আফগান সাহিত্যের ইতিহাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এরপর, শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে। পৃথিবী এগিয়ে গেছে বহুদূর। এই দেশের ধন-সম্পদের লোভে, বিভিন্ন জাতির পদচারণায় ঘটেছে আফগানিস্তানে। ধনসম্পদ হস্তগত করার জন্য, নানান ধরনের সুবিধা আদায়ের নিমিত্তে, সেই সব ভিন্ন ভাষার ভিন্ন জাতির লোকেরা, স্থানীয় আফগানদের ভাষা শিখে, তাদের সাথে সাথে মিলে মিশে এক হয়ে যায়। মুখরিত হয়ে ওঠে এই দেশ। ফলে লেনদেন হয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃৃতির। এই সব নানান জাতির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে এখানকার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃৃতি এমনকি সাধারণ জনগণের জীবনমান পাল্টে যায়।

সেই সময়ে আফগানিস্তানে চীন, ইরান এবং ভারতীয়দের পদচারণা ঘটে বেশি। তাই তাদের সাহিত্যে ইরান, চীন বিশেষ করে ভারতীয় সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় বেশি করে। আফগান সাহিত্যের সত্যিকার অর্থে দারুণভাবে উন্মেষ ঘটে দশম থেকে ১২শ’ শতক পর্যন্ত, যথাক্রমে গজনভি এবং ঘুরি বংশের সম্রাটদের হাত ধরে, পারসি ভাষার মাধ্যমে।

আফগানিস্তানের একটি সমৃদ্ধ সাহিত্যের ঘরানা রয়েছে, তার সাথে রয়েছে বিশাল মাপের লোক সাহিত্য এবং ঐতিহ্যবাহী নানান ঘরানার সামাজিক প্রথাগত গীতি কবিতা। সেই মেডিয়াভেল আমল থেকেই আফগানিস্তানে সাহিত্য রচিত হতো- দারি, পাশতু, আরবি এবং টার্কিক ভাষায়। তবে সামারিদ, গজনভি, তিমুরিদ এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যেরও; যেসব জগৎ বিখ্যাত সম্রাটরা এই ভূখণ্ডে পা রেখেছিলেন, তাদের প্রিয় ভাষা ছিল পারসি। ভাষার প্রিয়তার কারণে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন পারসি সাহিত্যের দারুণ ভক্ত। ফলে সেই সময় আফগানিস্তানে পারসি ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি হতে থাকে।

কালের আবর্তনে এই সম্রাটদের শাসনকাল হয়ে উঠেছিল আফগান সাহিত্যের এক সোনালি সময়। সম্রাটরা নিজেরা পারসি সাহিত্যের সেরা লেখকদের লেখা পাঠ করতেন এবং চলমান লেখক কবি যেমন: রুমি, যামি, রুদাকি, ফেরদৌসী এবং খাজা আবদুল্লাহ আনসারির মতো বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকর্ম পাঠের জন্য উৎসাহিত করতেন।

১৬শ’ থেকে ১৮শ’ শতকের দিকে, যখন সারা বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের প্রচলন শুরু হলো তখন শিল্প সাহিত্যেও, এই উপনিবেশ জীবনমানের নানাবিধ বিষয়গুলো উঠে আসতে থাকল সারা বিশ্বের সাহিত্যেই। সেই আঘাত গিয়ে পড়ল আফগান সাহিত্যেও। ফলে বেশ শক্ত ঘরানার উপরে দাঁড়ানো আফগান সাহিত্যের মান ধীরে ধীরে কমতে থাকল। উপনিবেশগুলোয় ঘাঁটি গাড়ল আফগান সাহিত্যের বদলে অন্যান্য সাহিত্য। সেগুলোকে পরবর্তীকালে আফগান কবি শিল্পীদের রচনা বলে অভিহিত করা হয়।

ওই শতকগুলোতে এই অবিভক্ত আফগান জাতির কবি, লেখকরা সৃষ্টি করল প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান কিছু রচনা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আফগানিস্তানের সাধারণ জনপদের বিভক্তির সাথে সাথে, তা বিলুপ্ত প্রায় হতে চলল। আফগান জাতির এই বিভক্তি আসে মুঘল সাম্রাজ্য এবং সাফাদি রাজ বংশের মাধ্যমে। এই সময়ে বেশ ক’জন প্রসিদ্ধ কবি যেমন খুশল খাত্তাক; সেই সময়কার প্রসিদ্ধ সাহিত্য চর্চার স্থান খাত্তাকে পালিয়ে যায়। ১৭ শতকের দিকে সবচেয়ে বেশি আফগান কবি এবং যোদ্ধা হিন্দুকুশ পর্Ÿতমালায় বসবাস করতেন। ১৯ শতকের পরবর্তী সময়ে; পাখতুন, যারা অবিভক্ত আফগানিস্তানে থেকে গিয়েছিল, তারা উর্দু ভাষার অত্যন্ত উঁচু মানের সঙ্গীত ঘরানা, গজল রচনার কাজে হাত দেন এবং তারা প্রভূত সফলতা অর্জন করেন।

মজার ব্যাপর হচ্ছেÑ টার্কি, উর্দু, আফগান এবং পাশতু ভাষায় রচিত সব সাহিত্য কর্ম, ঐতিহ্যের কারণে সময়ের আবর্তনে তা পারসি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে এক বিশেষ জায়গা দখল কোরে নেয়। মোট কথা, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আফগান সাহিত্যের জন্ম হয় সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। তারপর তা এক সময় লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়।

২০ শতকের শুরুতেই আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, হয়ে ওঠে শিল্প, সাহিত্য চর্চার প্রধান কেন্দ্র। সেই সময়ে মাহমুদ তাযযি নামক একজন একাধারে সমাজ সংস্কারক, কবি ও সম্পাদকের হাত ধরে কাবুলে প্রথম প্রকাশিত হয় সিরাজ আল আখবার নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা। ১৯১১ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তিনি আফগান সাহিত্যে এক আধুনিক আবেশ এনে দিয়েছিলেন।

গত কয়েক দশকে আফগানিস্তানের সাহিত্যে বেশ ক’জন খ্যাতনামা কবি লেখক জন্ম নেন। তাদের মধ্যে খালিলুল্লাহ খালিলি এবং সায়িদ বুহানিদ্দিন মারুহ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারা দেশের মাটি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও নিজেদের পরিচিতি তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। আফগান সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য, কবি খালিলুল্লাহ খালিলিকে রীতিমতো আফগান সাহিত্যের আধুনিককালের নবজাগরণের কবি বলা হয়।

অন্য দিকে কবি ও সম্পাদক মাহমুদ তাযযি, পাশতু ভাষাকে জাতীয় ভাষায় রূপ দানের জন্য, তার নিজের পত্রিকা সেরাজ আল আখবার’এ পাশতু ভাষায় খবর, শিল্প সাহিত্যের নানা বিষয় ছাপতে শুরু করলেন। এক সময়ে সেরাজ আল আখবার হয়ে উঠলো আফগানিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি পরিবর্তনের আধুনিককালের শিক্ষিত জনগণের মনের মতো এক শক্তিশালী হাতিয়ার। সমাজ, শিল্প, সাহিত্য সব কিছুর এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলো সেরাজ আল আখবার। স্বাধীন আফগানিস্তানে বলতে গেলে তিনিই প্রথম কবি ও লেখক; যার গ্রন্থ প্রথম মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়।

আফগান কাব্য সাহিত্যে ইংরেজি এবং টারকি সাহিত্যের বেশ একটা শক্ত প্রভাব রয়েছে, যা সমালোচকদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তোলে! প্রশ্ন হয়, কিভাবে সম্ভব এই প্রভাব বিস্তারের? তবে একটি বিষয় অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে, আফগান কবিরা সব সময়, কবিতায় সুফিবাদ এবং দেহতত্ত্বের বিষয়টি বেশ সুনিপুণভাবে তুলে আনতে সামর্থ্য হয়েছেন যা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল।

পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত সাহিত্যের ইতিহাসের ন্যায়, আফগান সাহিত্যেরও কবিতাই হচ্ছে সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য ঘরানা। সে হোক মুখে মুখে রচিত কিংবা লিখিত সাহিত্য। এই বং কবিতার এই জন্ম চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। মহৎ কবি রুমি জন্মে ছিলেন আফগানিস্তানে। আধুনিক যুগে এসে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু নারী কবি আফগান সাহিত্যের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে, বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত ছড়ার ঢঙে, দুই বা ততধিক যুগল সারিতে, ছন্দোবদ্ধ কবিতা রচনার ঘরানাতেই রয়ে গেছেন। যে কবিতার রচনা পদ্ধতি অনুসারে একে ল্যানদেই বলে অভিহিত করা হয়। যে কবিতা জোড়া জোড়া সারিতে সহজ শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে, অন্তমিলের জাদুকরী এক ক্যারিশমা দেখিয়ে রচনা করা হয়।

আফগান প্রবাদ বিশ্বসাহিত্যের দরবারে অত্যন্ত দামি সাহিত্যের এক মহান মর্যাদা লাভ করেছে। এসব প্রবাদ, দেশের স্বনামখ্যাত কবিরা, তাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনা, অর্জিত অভিজ্ঞতা, সুফি দর্শন, সৃষ্টিত্ব এবং সত্য ভাষণের সাহসের ওপর ভর করে তারা রচনা করেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে আফগান প্রবাদ প্রবচনগুলো সরকারিভাবে স্বীকৃত দু’টি অফিসিয়াল ভাষায় প্রকাশিত হতে থাকে। তবে অস্বীকৃত আঞ্চলিক বা বিদেশী ভাষাতেও প্রবাদ প্রবচন রচিত হতো। কিন্তু সেগুলো আফগান সমাজে, সাহিত্যে, শিল্প কর্মে স্থান পেতো না। কেননা, সেগুলোর ভেতরে ভিনদেশী কবি লেখকদের নানা রকম ভিন্নধর্মী বিষয় থাকত; যা আফগান সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্যের সাথে কোনো ধরনের মিল থাকত না। সাধারণ জনগণের কাছেও তার কোনো গ্রহণ যোগ্যতা ছিল না। 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: