পূর্ববঙ্গের মুক্তচিন্তার প্রবাদপুরুষ কাজী মোতাহার হোসেন

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০৬

কাজী মোতাহার হোসেন : সংগৃহীত ছবি কাজী মোতাহার হোসেন : সংগৃহীত ছবি


পূর্ববঙ্গের পরিসংখ্যানের প্রবাদপুরুষ কাজী মোতাহার হোসেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে দাবার চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। এছাড়াও, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক, পূর্ববঙ্গের মুক্ত চিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। কিন্তু, সব ছাপিয়ে তিনি একজন প্রবাদপ্রতীম মানুষ।

১৯৫০ সালের ঘটনা। কয়েকজন সাহিত্যিক মিলে ঠিক করলেন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন। তারা সবাই চাইলেন কাজী মোতাহার হোসেনকে সভাপতি করতে। সরদার জয়েনউদ্দীনসহ কয়েকজন গেলেন তার কাছে। সংগঠনের সভাপতি হতে রাজি হলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

সেই সংগঠনে কোনো একটা পদে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ। বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে সেদিন বিকেল পাঁচটায় সভা হবে। সবাই এসেছেন পাঁচটায়, কিন্তু দেখা নেই আলাউদ্দিন আল আজাদের। সবার মধ্যেই বেশ বিরক্তির ভাব। আলাউদ্দিন আল আজাদের দেখা মিলল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। এদিকে কাজী মোতাহার হোসেন ভীষণ বিরক্ত তার ওপর। তবুও তিনি বিরক্তির ভাব লুকিয়ে রাখলেন। গলা নামিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, 'কী আজাদ, আজ এত বিলম্ব যে?'

আলাউদ্দিন আল আজাদ হেসে বললেন, 'কেন স্যার, ঠিকই তো আছে। আমি তো ঠিক ছটায়ই এসেছি। সভা তো এখনই শুরু হওয়ার কথা।'

এ কথা শুনে কাজী মোতাহার হোসেন বললেন, তাহলে একটা গল্প শোনাই সবাইকে। কাজী মোতাহার হোসেন যে গল্পটা বললেন গল্পটা ঠিক এরকম, 'এক জ্যোতিষী একজনের হাতের রেখা দেখে বলেছিল, আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কাশীতে আপনার মৃত্যু হবে। অতএব পাপের কোনো হিসাব হবে না, সোজা স্বর্গলাভ। এ রকম জেনে সেই ভদ্রলোক একাধারে পাপ করে যেতে থাকল। একদিন খুনের দায়ে তার ফাঁসির আদেশ হলো। জজ সাহেব তার শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন। হতবিহবল আসামি জ্যোতিষীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন শেষবারের মতো। জ্যোতিষীকে আনা হলো। লোকটি তাকে দেখেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বললেন, এই কী তবে আমার কাশীতে মৃত্যু? আজ যে আমি ফাঁসিতে যাচ্ছি!'

জ্যোতিষী হেসে জবাব দিলেন, 'সব ঠিক আছে বাবা। কেবল 'ক' এর মাথাটা একটু ফাঁক হয়ে গেছে।' বলেই কাজী মোতাহার হোসেন আলাউদ্দিন আল আজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমারও সব ঠিকই আছে, কেবল ৫ এর মাথাটা!'

কাজী মোতাহার হোসেন একজন অসামান্য যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গের প্রথম মুক্তচিন্তার পত্রিকা 'শিখা'তে লেখা থাকতো 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।' সেই পত্রিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় সম্পাদক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

কাজী মোতাহার হোসেন জন্মেছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালির লক্ষ্মীপুর গ্রামে তার নানার বাড়িতে ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই। তার বাবা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ তখন ছিলেন ফরিদপুরের সেটেলমেন্টের আমিন। তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল অবশ্য ফরিদপুরের গোয়ালন্দ মহকুমার পাংশার বাগমারা গ্রামে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কাজী মোতাহার হোসেনের শৈশব কেটেছিল বাগমারায়।

কাজী মোতাহার হোসেনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাত্র ছয় বছর বয়সে ১৯০৩ সালে। ১৯০৯ সালে প্রাথমিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কুষ্টিয়া মুসলিম স্কুলে। সেখান থেকে ১৯১৫ সালে ম্যাট্রিকের বোর্ড পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। কিন্তু, তাকে রাজশাহীতে চলে আসতে হয়েছিল।

১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজ। ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে সব পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। পেয়েছিলেন মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তিও। এর দু'বছর পরে ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাশ করেন।

প্রসঙ্গত, সে বছর কেউ প্রথম শ্রেণি পাননি। তার শেষ বর্ষের পরীক্ষার কয়েক মাস আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন তিনি ঢাকা কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। ছাত্রাবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকরি শুরু হয়েছিল তার। ১৯২৩ সালে সহকারী প্রভাষক হিসেবে পরিসংখ্যান বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাকে।

পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা সত্ত্বেও কাজী মোতাহার হোসেনের গণিত ও পরিসংখ্যানে দারুণ আগ্রহ ছিল। তাই ভর্তি হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যানের ডিপ্লোমাতে। ওখান থেকে ১৯৩৮ সালে ডিপ্লোমা পাশ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ ডিগ্রিও নিয়েছিলেন।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। সালটা ১৯৪৮। সে বছর কাজী মোতাহার হোসেনের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিষয়ে এম এ কোর্স চালু হয়। পরের বছর পরিসংখ্যান বিভাগ আত্মপ্রকাশ করে। তখন নতুন এক বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। পরিসংখ্যান বিভাগে যোগ দিলেও ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত গণিত বিভাগেও ক্লাস নিতেন তিনি।

সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে 'Design of Experiments' বিষয়ে পিএইচডি করেন। ডক্টরাল থিসিসে তিনি 'Hussain's Chain Rule' নামক একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন। চাকরি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে তিন বছরের জন্য সুপার নিউমারারি প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল পরিসংখ্যান বিভাগে।

১৯৬৪ সালে তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট। সেখানে তিনিই ছিলেন প্রথম পরিচালক। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

কাজী মোতাহার হোসেনের সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়েছিল শৈশবে। যদিও তার প্রথম লেখা প্রবন্ধ 'গ্যালিলিও' প্রকাশিত হয়েছিল 'সওগাত' পত্রিকায়। ঢাকা কলেজে পড়া অবস্থায় ১৯১৯ সালে কলেজের সাময়িকী থেকে প্রকাশিত হয়েছিলো 'সুন্দর' প্রবন্ধ। কাজী মোতাহার হোসেনের মুক্তচিন্তার সূত্রপাত হয় শিখা গোষ্ঠী থেকে।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজে কয়েকজন প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি গড়ে তোলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ছিল শিখা। শিখা পত্রিকার মুখবাণী ছিল 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।'

শিখা পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেন। পরের দুই সংখ্যা তথা দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। সমকালের অন্যান্য সাময়িকপত্র থেকে শিখা ভিন্ন ধরনের ছিল। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সারা বছরের কর্মকাণ্ডের পরিচয় বহন করত এটি। শিখা বাঙালি মুসলিম সমাজে নতুন যুগের হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিল। যার আদর্শ ছিল উনিশ শতকের নবজাগরণ, ইউরোপের নবজাগরণ, কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের বুকে জন্ম নেওয়া নবজাগরণ।

এর আগের বছর ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত দাবা প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যাপারে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে কাজী মোতাহার হোসেনের। নজরুলের প্রিয় মোতিহার তথা কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল অবশ্য আরও পাঁচ বছর আগে। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। স্মৃতিকথায় কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছিলেন, 'যতদূর মনে পড়ে নজরুলকে প্রথম দেখেছিলাম ১৯২০/২১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রিটের একটা মেসের দোতলায়।'

তবে দুই কাজীর মধ্যে বেশি ঘনিষ্ঠতা ও গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে নজরুল ঢাকায় এলে। কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছিলেন, '১৯২৭ সনের আগে নজরুলের সঙ্গে আমার যেসব দেখাশোনা হয়েছিল তা অনেকটা দূর থেকে কোনো বিখ্যাত লোকের সঙ্গে গুণগ্রাহী লোকের মতো।'

কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমেই বর্ধমান হাউস ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে পরিচয় গড়ে উঠেছিল নজরুলের। সেই ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে বিভোর ছিলেন নজরুল। ১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন নজরুল। ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের তখনকার নিবাস বর্ধমান হাউসে।

কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একদিকে যেমন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। ঠিক তেমনি সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত গড়ে তোলার জন্য তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্ব। সর্বস্তরে শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা অবর্ণনীয়।

তিনি তার প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে।'

তার বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধাদি সবই ছিল প্রেরণার। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর আয়োজনে আয়োজিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে সভাপতি করা হয়েছিল কাজী মোতাহার হোসেনকে। যে কাগমারী সম্মেলন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজ রচিত হয়েছিল।

কিংবা, ১৯৬১ সালে সরকারের চাপের মুখেও ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী পালন করা হয়েছিল সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের বিরোধিতার মুখে সে আয়োজন করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। এর আগে, নিজের মেয়ে সনজীদা খাতুনকে তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপরে স্নাতকোত্তর করতে পাঠান। তার তিন মেয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

১৯৬১ সালের কথাই বলি। এই ঘটনায় কাজী মোতাহার হোসেনের দাবা প্রেম যে কতোখানি সতাও একই সঙ্গে উঠে আসবে। সেবার রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হবে সিলেটে। সেখানে গিয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জিসি দেব ও কাজী মোতাহার হোসেন। সেই সফরে তরুণ সালেহ চৌধুরী কাজী মোতাহার হোসেনের দাবা প্রেম জেনে দেখভালের দায়িত্ব পেলেন। সিলেটে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল রশিদ মঞ্জিলে। বাসায় পৌঁছে সালেহ চৌধুরীকে ডেকে কাজী মোতাহার হোসেন বললেন, 'শুনেছি, সিলেটে ভালো দাবা খেলোয়াড় আছেন। এখনই কয়েকজন দাবা খেলোয়াড়কে নিয়ে আসেন।'

সালেহ চৌধুরী বেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আজিজুর রহমান, ফণী বাবু ও আবদুল করিম চৌধুরীকে নিয়ে এলেন। এদিকে তাদের সবাই জানেন কাজী মোতাহার হোসেন অসম্ভব ভালো দাবা খেলেন। সবার জানা ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক চ্যাম্পিয়ন তিনি। তাই কেউই আগ্রহ দেখালেন না। ভণিতা করতে লাগলেন। এদিকে কাজী মোতাহার হোসেনের পীড়াপীড়ি শুরু হলো। শেষমেশ বাকি চারজন সিদ্ধান্ত নিলেন চারজনে মিলেই কাজী মোতাহার হোসেনের বিপক্ষে খেলবেন। কাজী মেতাহার হোসেন কিছুটা কানে কম শুনতেন। তারা ভেবেছিলেন নিজেরা শলা পরামর্শ করে আলোচনা করবেন। সেই খেলায় কাজী মোতাহার হোসেন চারজনের যৌথ কূটচালে হেরে গেলেন। খেলায় হেরে বাকিরা খুব খুশি। কিন্তু, তাদের সব ঠিকই শুনেছেন কাজী মোতাহার হোসেন। বাকিদের জয়ের আনন্দ দেখে তিনি মৃদু হেসে বললেন, 'বুড়ো তো হারল, সবাই খুশি তো? ভেবেছেন, বুড়ো কানে শোনে না, কিছুই বুঝবে না! তবে বুড়োর চোখ তো আছে, ঠোঁট নড়া তো দেখতে পায়।' বাকিরা ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। পরবর্তীতে যে খেলাগুলো হলো সবগুলোতে জিতলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার যখন রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ ও রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল তখন কাজী মোতাহার হোসেন তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন সম্মুখ সারিতে থেকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো মোট তিন জনকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেই তিনজনের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

কাজী মোতাহার হোসেন বিশ্বাস করতেন চিন্তার প্রসরতাকে। বিশ্বাস করতেন লেখকের সাধনা, একাগ্রতা ও ভাবনার প্রখরতাকে। যেমনটি পাওয়া যায় তার প্রবন্ধে। 'লেখক হওয়ার পথে' প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছিলেন, 'মনের কথা স্বপনেরই মতো অস্পষ্ট, অ-কায়া; মনের ভিতর উঁকি মারে। খেলা করে, আর মিলিয়ে যায়। ঠিক মনের কথাটা তার আবেগ, ব্যাকুলতা ও গভীরতা নিয়ে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। ভাব অসীম, আর ভাষা সসীম। ভাবের এত বিভিন্ন স্তর আছে, মনের এত অসংখ্য সাময়িক অবস্থা আছে যে ভাষার একটা কথা কখনও মনের কথার ঠিক প্রতিবিম্ব হতে পারে না। তবে এরূপ প্রতিকূল অবস্থার ভিতর একটা সান্ত্বনার কথা এই যে, পাঠক ভাষাকে নিজের মনের রঙে রঞ্জিত করেই গ্রহণ করে। তাতে ভাষার দৈন্যর অনেকখানি পুষিয়ে যায়।'

আজীবন গভীর বিষাদেও আনন্দকে সঙ্গী করা এই মানুষটির অন্তিম যাত্রাও হয়েছিলো আনন্দমুখর ঈদের দিনে।

আজ প্রবাদপ্রতিম পরিসংখ্যানবিদ, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেনের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তার প্রতি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: