মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী : ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৮ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৪৭

মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী : সংগৃহীত ছবি মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী : সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোধা পুরুষ মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহ.-এর ইন্তিকালের ২৩ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে আজ। ১৯৯৬ সালের এই দিনে, ১৯ অক্টোবর, তিনি পরকালের ঠিকানায় পাড়ি জমান।

মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী একাধারে ছিলেন একজন ইসলামি চিন্তাবিদ, নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সাহসী সৈনিক, খতমে নবুওত আন্দোলন পরিষদ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক মহাসচিব, জামিয়া হুছাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মিরপুর ঢাকার মহাপরিচালক, মাসিক পয়গামে হক্ক ও সাপ্তাহিক জমিয়তের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং বহুগ্রন্থ প্রণেতা।

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানাধীন নিয়ামস্তির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৫ ঈসায়ীর ৫ই মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ মুদ্দাসসির, পিতামহের নাম আহমদ সারেং। তিনি মরহুম আলী মুন্সি সাহেবের বংশধর। জনাব আলী মুন্সি তদানীন্তন সময়ে সুপ্রচলিত ফার্সি ভাষায় সুদক্ষ ও একজন বিশিষ্ট আইনবিদ ছিলেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিরুদ্ধ আন্দোলনে তাঁর পূর্বপুরুষদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

গ্রামের মক্তব ও প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণের পর স্থানীয় রিয়াজুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। নাহু-সরফের শিক্ষা সমাপণ করে সন্দ্বীপ হরিশপুর বশিরিয়া আহমদিয়া সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হয়ে দাখিল, আলীম ও ফাজিল পাস করেন। ১৯৫৫ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে সেখানে দুই বছর পড়াশোনা করে চট্টগ্রাম ফিরে আরও এক বছর জিরী মাদরাসায় পড়াশোনা করেন।

১৯৫৮ সালে তিনি লাহোর জামিয়া আশরাফিয়ায় ভর্তি হন এবং তাফসির ও হাদিস শাস্ত্রে উচ্চতর সনদ লাভ করেন। অতঃপর শায়খুত তাফসির হযরত মাওলনা আহমদ আলী লাহোরী রহ.-এর তাফসিরের দরসে ভর্তি হন এবং ১৯৬০-৬১ সালে তাফসিরের উপর বিশেষ সনদ লাভ করেন।

১৯৬১ সালে মোমেনশাহী জেলার ঐতিহ্যবাহী সোহাগী মাদরাসা থেকে আল্লামা কাসেমী তাঁর শিক্ষকতা-জীবনের শুরু। এখানে তিনি এক বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। অতঃপর চলে আসেন জামিয়া আশরাফুল উলূম বড়কাটারা মাদরাসায়। এখানে তিনি শীর্ষতম মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দু’বছর এখানে হাদিস, তাফসির ইত্যাদি শিক্ষাদানের পর ফরিদাবাদ ইমদাদুল উলূম মাদরাসায় নিয়োগ পান। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ঢাকা সাভারের রাজফুলবাড়িয়ায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে মাদরাসার মুহতামিম হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর সেখান থেকে অব্যাহতি নেন।

১৯৬৮ সালে যাত্রাবাড়ী জামেয়া মাদানিয়া প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তীতে তিনি এখানে মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বছর অত্যন্ত সুচারুরূপে অবৈনতিক দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৭০ সালে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মিরপুরস্থ জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী মাদরাসাটিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করে দিলে হযরত কাসেমী রহ. গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে চলে যান। অতঃপর চট্টগ্রামের শোকলবহর এলাকায় একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেও তিনি কয়েক বছর মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় দামপাড়া বাইতুল আজিজ জামে মসজিদ-এর ইমাম ও খতিব হিসেবেও দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।

১৯৭৫ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের পরামর্শে তিনি পুনরায় ঢাকা চলে আসেন এবং জামিয়া হুসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ-এর প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে আল্লামা কাসেমী রহ. জীর্ণ-শীর্ণ এ মাদরাসাটিকে সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম ও সাধনা চালিয়ে যান। তাঁরই সীমাহীন ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দিন-রাতের মেহনতে হাটি হাটি পা পা করে মাদরাসাটি কৃতিত্বের সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। বর্তমানে তাঁর ছেলে মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া উক্ত প্রতিষ্ঠানের মুহতামিমের দায়িত্বে আছেন।

ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর যথাক্রমে সেক্রেটারি জেনারেল, সহ-সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দেশ-জাতি এবং দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। ইসনা আশারিয়া-শিয়া সহ সকল প্রকার বাতিলের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামী জীবন ছিল উৎসর্গিত। দ্বীপভূমি সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী এই কৃতি সন্তানই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন। খতমে নবুওত আন্দোলন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও আকিদায়ে খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ আল্লামা কাসেমীহ রহ. খতমে নবুওওতের ডাক দিয়ে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করেছিলেন। জেল, জুলুম আর হুলিয়া ছিল যার নিত্য সাথী। দেশ ও ধর্ম বিদ্বেষী এনজিওর বিরুদ্ধেও তিনি আজীবন আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করে গেছেন।

তাঁর দল জমিয়তের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। কারণ ৩ বার জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত হন। অতঃপর সহ-সভাপতি ও নির্বাহী সভাপতিও ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১৬ই মার্চ ঢাকা নবাব বাড়ীর আহছান মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (পূর্বপাকের) কমিটি গঠিত হলে হযরত মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রহ. সভাপতি এবং তিনি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মত সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে জমিয়তের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে সভাপতি খলীফায়ে মাদানী শায়খে কৌড়িয়া এবং তিনি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।

১৯৮০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা লালকুঠি হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে শায়খুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা হাফেজ সৈয়দ আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া ও আমীরে শরীয়ত সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.-কে পৃষ্ঠপোষক এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক (খেলাফত মজলিসের সাবেক আমির)-কে সভাপতি ও মরহুম কাসেমী রহ.-কে মহাসচিব নির্বাচিত করা হয়। তাছাড়া আরও দু’বার, ১৯৮১ ও ১৯৮৮ সালেও মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে সম্মিলিত ত্রাণ কমিটির সহসভাপতি হিসেবে ব্যাপক কাজ করেন এবং হাফেজ্জী হুজুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়কারী, ’৯১-এর চট্টগ্রামে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে। দেশের প্রতিটি ইসলামী আন্দোলন এবং দুর্যোগ মুহূর্তে তাঁকে প্রথম সারিতে দেখা গেছে। তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হলো প্রিয় নবী, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চির দুশমন ও ইংরেজদের দোসর মির্জা গোলামসহ কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম করে দেশব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টি করে গেছেন। শিয়া কাফের, কাদিয়ানী ধর্মমত, পাকিস্তানে খ্রিস্টান মিশনারী উৎপাত, ইসলাম বনাম কমিউনিজম, ধর্ম নিরপেক্ষতাসহ আরও বেশ কয়েকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ রচনা করেন।

তিনি ছিলেন একাধারে একজন হক্কানি আলেম, শায়খুল হাদীস, আদর্শ শিক্ষক, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, কলমসৈনিক, মিষ্টভাষী বক্তা, লেখক-অনুবাদক, একজন আদর্শ খতিব ও ইমাম। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নির্ভীক মুখপাত্র কাসেমী রহ. স্বীয় দল জমিয়তকে নিয়ে বিভিন্ন বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মোকাবিলা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। জেল-জুলুম সহ্য করে ও অবিরাম সংগ্রাম করে কয়েক বার কারাবন্দীও হয়েছেন তিনি!

তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমীর সাথে আমার পরিচয়ের পরিধি প্রায় তিন যুগের। লাহোর থেকে তিনি শুধু হাদিসের সনদ নিয়ে আসেননি। শায়খুত তফসির মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর নিকট থেকে একাধারে পবিত্র কোরআনের অত্যাধুনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) ঘরানার চিন্তা-চেতনা নিয়ে ও দেশে ফিরেছিলেন, ফলে দেশে ফিরেই তিনি যখন অনুরূপ চিন্তা-চেতনার সঙ্গী-সাথীর অনুসন্ধান করেন তখন কোন এক অদৃশ্য আকর্ষণে যেন আমরা একাত্ম হয়ে গেলাম!’

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. আরও বলেন, ‘১৯৬২ সালের ১ বৈশাখ ঢাকার পূর্বাঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্করী টর্নেডো হয়েছিল সেই টর্নেডো বিধ্বস্ত জনপদগুলোতে আমরা গিয়েছিলাম কিছু চিড়া-গুড় নিয়ে। দলনেতা ছিলাম আমি ( মাওলানা খান), কাসেমী সাহেব সহকারী। দলে ছিলাম ছয় জন। প্রত্যেকেরই মাথায় একটি চিড়ার বস্তা, কাঁধে ঝুলানো গুড় ভর্তি থলে। পায়ে হাঁটা গ্রামের পথে এই বোঝা বয়ে আমরা সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ঘুরেছিলাম। ফেরার পথে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে পা চলছিল না। কাসেমী সাহেব তখন দলের সবাইকে এই বলে উৎসাহিত করেছিলেন যে, যাওয়ার সময় তো প্রত্যেকের মাথায় ছিল এক মণ করে চিড়ার বস্তা এবং কাঁধে ছিল দশ সের করে গুড়। এখন তো খালি হাত পা!’

মহান এই ব্যক্তিত্ব ১৯৯৬ সালের ১৯ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: