মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ আবুল ফজল

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:০৭

আবুল ফজল : সংগৃহীত ছবি আবুল ফজল : সংগৃহীত ছবি


পূর্ববঙ্গে একাধারে সমাজ ব্যবস্থা, মুক্তির দিশা, রাষ্ট্র সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তাশীল, সচেতন, প্রজ্ঞাবান যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তাদের মধ্যে স্বমহিমায় উজ্জ্বল আবুল ফজল। বাংলাদেশের সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি হয়ে উঠেছেন মহীরুহের মতো। তার সাহিত্যে ও লেখায় বারবার দেখা মেলে একাধারে সমাজ সচেতনতা, চিন্তাশীলতা ও গভীর মননশীল মনোভাবের।

তিনি জন্মেছিলেন রক্ষণশীল এক পরিবারে। তার বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের এক জামে মসজিদের ইমাম। বাবা চাইতেন ছেলেও তার মতো ধর্ম নিয়ে ভাবুক, বেড়ে উঠুক ধর্মীয় পরিচয়েই। তাই গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পরই ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর জন্য চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে এনেছিলেন বাবা। কিন্তু আবুল ফজল ছিলেন ব্যতিক্রম। বাল্যবয়সেই তিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তার খোঁজে।

বাবার অর্থনৈতিক অনটনের কারণে এক সময় আবুল ফজলকে অন্যের বাড়িতে জায়গির থাকতে হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়ে ভেবেছিলেন, 'মুসলমান সাহিত্যিকদের পক্ষেও এমন লেখা সম্ভব!' এমন সময়েই বের হয়েছিল নজরুলের 'অগ্নিবীণা' ও 'ব্যথার দান'।

দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে চট্টগ্রামের এক বইয়ের দোকানের মাধ্যমে কলকাতা থেকে নজরুলের বই ২টি আনিয়েছিলেন আবুল ফজল। যখন এই খবর ছড়িয়ে পড়ল তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই বিস্ময়ে হতবাক। কারণ ওই সময় কোনো মাদ্রাসাশিক্ষার্থী যে সুদূর কলকাতা থেকে এমন বই আনাতে পারে তা ছিল রীতিমতো অকল্পনীয় বিষয়।

সরকারি মাদ্রাসায় মাধ্যমিক পাশের পরে নিজ আগ্রহেই ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। লেখালেখিতে ছিল তার ভীষণ আগ্রহ। তাই অনেকটা ঝোঁকের বসে একটি লেখা লিখে পাঠিয়ে দিলেন সওগাত পত্রিকায়। সওগাতের একটি সংখ্যায় প্রকাশিতও হয়েছিল সেই লেখা।

গ্রামের স্কুলের এক শিক্ষক আবুল ফজলের বাবাকে গিয়ে একদিন বললেন, 'আপনার ছেলে তো দারুণ লিখে।' কথাটি শুনে আনন্দিত হওয়ার বদলে বিরক্ত হলেন তার বাবা। এর কিছুদিন পরে আবুল ফজল যখন বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামে দেখা করতে গেলেন বাবার প্রথম প্রশ্নই ছিল 'তুমি নাকি বাংলা পত্রিকায় লেখা ধরেছ? এসব কি করছ?'

আবুল ফজল তখনই প্রথম জানলেন সওগাতে তার লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু বাবার প্রশ্ন শুনে দমে গিয়ে তিনি অস্বীকার করলেন।

প্রতিউত্তরে তার বাবা বললেন, 'হাইস্কুলের শিক্ষক তো আমাকে বলেছেন উনি তোমার লেখা পড়েছেন। আবুল ফজল নামে ওটা ছাপা হয়েছে।'

আবুল ফজল বুদ্ধি করে বললেন, 'আমার নামের আগে তো মোহাম্মদ আছে। মোহাম্মদ আবুল ফজল। আর ওই লেখকের নাম তো আবুল ফজল!' শুনে আশ্বস্ত হলেন বাবা।

আবুল ফজলের বাবা চাইতেন ছেলে বাংলার বদলে উর্দু বা ফার্সি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করুক। কিন্তু মাতৃভাষাপ্রেমী আবুল ফজলকে দমানোর সাধ্য কার! বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় তিনি যেসব সৃষ্টি রেখে গেছেন, তা এক অনন্য উদাহরণ। লিখেছেন রাঙা প্রভাত, চৌচিরের মতো উপন্যাস। লিখেছেন মাটির পৃথিবী, মৃতের আত্মহত্যার মতো গল্পগ্রন্থ। সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্রের মতো অবিস্মরণীয় সব প্রবন্ধ সংকলন। মুক্তবুদ্ধির বিকাশে রেখেছেন উজ্জ্বল অবদান।

আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরই আবুল ফজলকে পড়াশোনা ইতি টানার পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। তখন সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছিলেন তিনি। পরে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই যুক্ত হয়েছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়েছিল 'শিখা পত্রিকা'।

শিখার স্লোগান ছিল, 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'। ওই সময়ের অন্যান্য সাময়িকপত্র থেকে শিখা ছিল ভিন্ন। বাঙালি মুসলিম সমাজে নতুন যুগের হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিল শিখা। শিখা প্রকাশিত হয়েছিল ৫ বছর। সবশেষ বছরে এর সম্পাদক ছিলেন আবুল ফজল।

আবুল ফজল জানতেন নারীর মুক্তি মানেই দেশের মুক্তি। নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে শিখা পত্রিকার শেষ সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, 'মেয়েদের শিক্ষা, অবরোধ প্রথার উচ্ছেদ ইত্যাদি সম্বন্ধে বাঙালি-মুসলমান সমাজে বহুদিন হইতে আলোচনা চলিতেছে। কিন্তু আমাদের সমাজনেতারা শুধু বাক্যের ব্যবসাদারিতেই সমস্ত শক্তি ব্যয় করিয়া নিজেরা ফতুর হইতেছেন এবং সমাজকেও বিড়ম্বিত করিতেছেন।…আজ এই ঢাকা সাহিত্য সমাজের সভায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁহাদের স্ব স্ব পরিবারের মহিলাদের এই সভায় যদি লইয়া আসিতেন, তাহা হইলে এই আন্দোলন আজ একদিনে অন্তত আরো দশ বৎসর আগাইয়া যাইতে পারিত এবং সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের সঙ্গে তাঁহাদের যে নাড়ির যোগ রহিয়াছে, তাহাও প্রমাণিত হইয়া যাইত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ আমরা তাহার উল্টা দেখিতেছি।'

কর্মজীবনে আবুল ফজল শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজে। তিনি যখন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত তখন দেশজুড়ে বইছিল ভাষা আন্দোলনের হাওয়া। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রামে আবুল ফজলের ভূমিকাও ছিল অগ্রগণ্য।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার বিখ্যাত উক্তি 'একুশ মানে মাথা নত না করা' তো চিরকালই প্রেরণা জুগিয়েছে বাঙালিকে। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল তখন তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন আবুল ফজল। বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথকে মুছে দেওয়ার মতো সামর্থ্য পাকিস্তান কেন, সমগ্র ভূমণ্ডলেরও নেই।'

১৯৫৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আবুল ফজল। এরপরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অনন্য শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসেন। সচেষ্ট হয়েছিলেন শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে। ১৯৭৪ সালে দেশব্যাপী খারাপ ফল করেছিল শিক্ষার্থীরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি শিক্ষকদের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তখন আবুল ফজল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে দেশের ৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩টির উপাচার্যই তাতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল আবুল ফজল। প্রকাশ্যেই তিনি সমালোচনা করেছেন সরকারের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের। যার ফলে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ তাকে উপাধি দিয়েছিল 'জাতির বিবেক'। বাকশালের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত না মানলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন আবুল ফজল।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আবুল ফজল নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশের মানুষকে বাঙালি পরিচয় দেওয়ার হিম্মত কে জুগিয়েছে? শেখ মুজিব ছাড়া এর কি দ্বিতীয় কোনো জবাব আছে? শেখ মুজিবকে হত্যা করা মানে এক অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের হিম্মত আর সংগ্রামের প্রতীক।'

পূর্ববঙ্গ এবং বাংলাদেশের বুদ্ধিতাত্ত্বিক সমাজ, চিন্তা ও মননশীল ধারার অনন্য পুরোধা ছিলেন আবুল ফজল। আবুল ফজল প্রকৃত অর্থেই ছিলেন স্বদেশপ্রেমী, চিন্তাশীল ও গভীর সমাজমনস্ক মহীরুহ। তার লেখায় যেমন উঠে এসেছে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব, তেমনি তার বক্তব্যে উঠে এসেছিল অনুসন্ধিৎসু ভাবনা। যার প্রমাণ মেলে মাত্র ২৬ বছর বয়সে লেখা একটি প্রবন্ধে।

১৯২৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেন সম্পাদিত 'শিখা'র তৃতীয় সংখ্যায় 'তরুণ আন্দোলনের গতি' শীর্ষক প্রবন্ধে আবুল ফজল লিখেছিলেন, 'অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে সত্যের পথে টানিয়া লইয়া যায়। বিশ্বাস করিয়া মানুষের সুখ আছে জানি, কিন্তু সত্যের অনুসন্ধানে বা সত্যকে আবিষ্কার করিয়া মানুষের যে সুখ, আত্মপ্রসাদ —তাহার তুলনা নাই। সন্দেহই জ্ঞানের গোঁড়া —এইতো বড় বড় দার্শনিকের কথা। সন্দেহ হইতে মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগে। এই অনুসন্ধিৎসাই মানুষকে জ্ঞানের পথে চালিত করে। আজ মুসলমান ছেলের মনে জীবনের বড় কিছু সম্বন্ধে সন্দেহ জাগিতে পারে না। সন্দেহ জাগিলে তাহার গলা টিপিয়া ধরা হয়।'

৪ দশক আগে ১৯৮৩ সালের ৪মে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তচিন্তা ও চিন্তাশীলতার পথিকৃৎ আবুল ফজল। 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: