ইবনে আরাবী : দিব্যজ্ঞান লাভ করা এক সুফি দার্শনিক

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:৫২

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

 

ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিকের নাম বলতে বললে কার নাম আপনার মাথায় প্রথমেই চলে আসবে? নিশ্চয়ই ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন কিংবা আল ফারাবির কথা ভাবছেন। একটি নাম, যা হয়তো শতকরা ৯০ জনের মাথায়ই আসবে না, তা হচ্ছে আল আরাবী। কারণ ইতিহাস তার দার্শনিক পরিচয় নির্ণয় করতে ভুল করেছে, তাকে আখ্যায়িত করেছে কেবলই একজন সুফি হিসেবে।

অথচ ধর্মকে বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা, কুরআনের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, হাদীসের দার্শনিক ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র, অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করে গেছেন তিনি। অবশ্য এটা ঠিক যে, সুফিবাদ নিয়েই তিনি বেশি কাজ করেছেন। যে কারণে তাকে ‘আল শেইখ আল আকবার’ বা সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তাই বলে তার দার্শনিক পরিচয়টা একেবারে ঢেকে ফেলা অবিচারই বটে।

মুহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন মুহাম্মদ ইবনে আলি আল আরাবি আল তাই আল হাতিমি তার পুরো নাম! নিজের প্রতিটি লেখার শেষেই লেখক পরিচয়ে এ নামটিই লিখেছেন। সংক্ষেপে ইবনে আল আরাবি নামে পরিচিত হন তিনি।

ইসলামিক স্পেনের মুরসিয়া শহরে, ১১৬৫ সালে এক ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পরিবার ছিল কর্ডোবার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। এর কারণ কেবল এই নয় যে তার বাবা আলি ইবনে আল আরাবী ছিলেন কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি। বরং, তার পরিবারের ছিল গৌরবের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, যার শুরু ইতিহাসখ্যাত হাতেম তাইয়ের সময় থেকে। হাতেম তাই এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম।

আল আরাবীর যখন ৮ বছর, মুরসিয়া তখন পার্শ্ববর্তী এক রাজার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি সপরিবারে চলে যান লিসবন শহরে। কিন্তু সেখানেও সবকিছু ঠিকঠাক বনিবনা না হওয়ায় সিভিল শহর হয় তার পরবর্তী ঠিকানা। এ শহরেই তিনি শিক্ষা দীক্ষায় পূর্ণতা লাভ করেন, তার ধ্যান-জ্ঞান বিকশিত হয়। সিভিল শহর ছিল মধ্যযুগের সুফিবাদ চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। এ শহরেই অনেক বিখ্যাত সুফির সাক্ষাৎ লাভ করেন আল আরাবী, সংস্পর্শে আসেন অনেক বিদুষী নারীর, যাদের প্রভাব তার পরবর্তী জীবনে গভীরভাবে লক্ষণীয়। এর মধ্যে যে নামটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে মার্চেন এর ইয়াসমিন। ইয়াসমিনের গুণমুগ্ধ আরাবীর মুখেই শোনা যাক তিনি কী ধারণা পোষণ করতেন এই নারীর ব্যাপারে।

“তার কাজকর্মে এবং যোগাযোগে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি তাকে নিয়ে গেছে শ্রেষ্ঠদের কাতারে!”- ইয়াসমিন সম্পর্কে আল আরাবী।

আবু জাফর নামক এক দরিদ্র কৃষক ছিলেন আল আরাবীর জীবনের প্রথম শিক্ষক, যিনি ঠিকমতো গুণতে জানতেন না, লিখতে পারতেন না! এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিবর্জিত শিক্ষকের নিকটি প্রাথমিকভাবে কুরআন পড়তে শেখেন তিনি। এরপর একে একে সিভিলের সব বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে আরবি ব্যাকরণ, কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র এবং ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। কৈশোরের পদার্পণ করেই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকালীন বিখ্যাত সুফিদের সাথে তার ভাব জমে ওঠে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ ছিলেন আরাবীর বাবার বন্ধু। সে সুবাদের রুশদের সংস্পর্শেও আসেন তিনি। ২০ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে সুফিবাদকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন তিনি।

ইবনে আরাবীর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি দৈববাণী পেয়ে সুফিবাদের দিকে ধাবিত হয়েছেন। ঘটনাটা ১১৮৪ খ্রিস্টাব্দের। সিভিলের কোনো এক সরকারি অনুষ্ঠানে শহরের সকল গণ্যমান্যদের সাথে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ইবনে আরাবীও। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে যখন মদ্যপান শুরু হয়, তখন আরাবীও সকলের সাথে তাল মেলাতে মদের গ্লাস হাতে নেন। কিন্তু গ্লাসে চুমুক দিতে উদ্যত হলেই তিনি শুনতে পান কোনো এক অদৃশ্য স্বর! “হে মুহাম্মদ, তোমাকে কী এজন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে?”

তিনি মদের গ্লাসে চুমুক না দিয়ে সেটি রেখে দিলেন এবং দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলেন। তার মন বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তিনি দেখা পেলেন এক মেষপালকের। মেষপালকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শহরের বাইরে চলে এলেন। কোনো এক নির্জন স্থানে এসে মেষপালককে অনুরোধ করলেন পোশাক বদলের জন্য। অতঃপর মেষপালকের ময়লা ছেঁড়া জামা গায়ে জড়িয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে একটি গুহায় প্রবেশ করলেন এবং সেখানে ধ্যানমগ্ন হয়ে ‘জিকরুল্লাহ’ বা আল্লাহর জিক্‌র শুরু করেন। তার এই ধ্যান ভাঙে ৪ দিন পর! সেদিন গুহা থেকে বের হয়ে তিনি বুঝতে পারেন নিজের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন চলে এসেছে। তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন!

“আমার একাকীত্ব যাপন শুরু হয় ফজরের সময়, যখন সূর্যকিরণ ধীরে ধীরে সব অন্ধকার দূর করে দিতে থাকে। তখন ‘গায়েবি’ (অদেখা/অদৃশ্য) জগতের রহস্যগুলো আমার কাছে একে একে জট খুলতে থাকে। ১৪ মাস আমি নির্জনে ধ্যান করেছি, সেগুলো দেখেছি আর লিখে রেখেছি।” – ইবনে আরাবী

এই ঘটনার পর আল আরাবীর জীবনধারা চিরতরে পাল্টে যায়। তিনি প্রায় ১৪ মাস একটানা নিভৃতচারীর মতো জীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি কেবলই একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, কথাবার্তা বলতেন। তিনি হচ্ছেন তার দীক্ষা গুরু শেখ ইউসুফ বিন ইউখালফ আল কুমি। টানা ১৪ মাসের নিভৃতযাপন শেষে তিনি নিজ বাসস্থানে ফিরে গেলেও সরকারি কাজে আর যোগ দেননি। যাবতীয় অর্থ সম্পদের মোহ ত্যাগ করে তিনি কেবল জিক্‌র আজগারে সময় ব্যয় করতেন।

দ্রুতই ইবনে আরাবীর আধ্যাত্মিক গুণের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো পুরো আন্দালুসিয়ায়। তার বাবার বন্ধু ইবনে রুশদও তার ব্যাপারে অবগত হন এবং তার সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ সাক্ষাৎ দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, রুশদের সাথে আরাবীর শৈশবে সাক্ষাৎ হয়েছিল, বয়সকালে আর হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, দুজন দুই মেরুর শ্রেষ্ঠ মানুষের সাক্ষাৎ ছিল এটি। রুশদ ছিলেন একজন আপাদমস্তক যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি সকল প্রকার জ্ঞানকে যুক্তির ছাঁচে ফেলে ঝালিয়ে নিতেন। আর আরাবী ছিলেন এখন দৃষ্টবাদী মানুষ, যিনি আধ্যাত্মিকতার পূজারী ছিলেন।

এই সাক্ষাৎ দুজনের জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইবনে রুশদ এই সাক্ষাতে আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন, দিব্যজ্ঞানের আগমন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তাছাড়া আরাবীর নিভৃতে জীবন যাপনের নানা দিক নিয়ে জানার কৌতুহল দেখান তিনি। আরাবীর সাথে এই সাক্ষাতের পরই আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পুনরায় চিন্তভাবনা শুরু করেছিলেন রুশদ। অন্যদিকে আরাবীও দর্শনের খুঁটিনাটি জানবার সুযোগ পান। যদিও আরাবী নিজেও একজন উৎকৃষ্ট দার্শনিক ছিলেন, তথাপি রুশদের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। আধ্যাত্মিকতার মাঝে বিচরণ করেই কীভাবে দার্শনিকতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়, সে অনুপ্রেরণা তিনি রুশদের কাছেই পেয়েছিলেন।

৪০ বছরের মধ্যেই জীবনের ভ্রমণ অংশটাও সম্পন্ন করেন ইবনে আরাবী। তিউনিস, ফেজ, মারাক্কেশ, বাগদাদ, সিরিয়া, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া সহ তৎকালীন পৃথিবীর মোটামুটি সকল গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করে ফেলেন তিনি। এরপর তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে ভ্রমণ করেন হজ্বব্রত পালনের জন্য। কিন্তু কাবাশরীফ তাওয়াফ করাকালীন তিনি আবারো একটি দৈব আদেশ পান। তাকে মক্কায় কিছুকাল থাকার জন্য বলা হয়। আদেশ মেনে তিনি মক্কায় ৪ বছর অবস্থান করেন এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে ‘মিশকাত আল আনওয়ার’ বা হাদিস সমগ্র, ‘রুহু আল কুদুস’ বা আন্দালুসিয়ার সুফিদের জীবনী, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অন্যদিকে মক্কায় থাকাকালীনই ইবনে আরাবী তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ রচনার কাজ শুরু করেন।

ক্রুসেডের সময় ইবনে আরাবী আনাতোলিয়ার (তুরস্ক) শাসক সুলতান কায় কাউসের নিকট চিঠি লিখে কঠোরহস্তে ক্রুসেডারদের দমনের অনুরোধ জানান। এর কিছুকাল পর তিনি নিজেই আনাতোলিয়া ভ্রমণ করেন কায় কাউসের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। সেখানে বেশ কয়েকবছর বসবাস করে দামস্কে স্থায়ী হবার পরিকল্পনা করেন। এখানে থাকাকালীনই বিগত ৩০ বছরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করেন ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’। এখানেই ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের ৪০ নভেম্বর পরলোকগমন করেন বিখ্যাত সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবী।

ইবনে আরাবী নিজের সকল কাজের তালিকা তৈরি করেছিলেন। তার সে তালিকা অনুযায়ী তার মোট লেখার সংখ্যা ২৫১টি, যেগুলোর মধ্যে কিছু অনুবাদকর্মও রয়েছে। যদিও ইতিহাসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি অনুযায়ী তার মোট কাজের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে যায়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ১৬টি বই অনুদিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। তবে, তার এত সংখ্যক লেখার কোনোটিইরই আদি কপি বা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না।

এক্ষেত্রে আবার বিতর্কও রয়েছে। কিছু পাণ্ডুলিপিকে অনেকে তার সময়ের বলে উল্লেখ করলেও, অধিকাংশের ধারণা সেগুলো পরবর্তী সময়ের হাতে লেখা প্রতিলিপি মাত্র। যেগুলো আমরা পাই, সেগুলো হয় অনুবাদ কিংবা ছাপা প্রতিলিপি। কেবল তার প্রগাঢ় জ্ঞান আর গভীর সুফি চিন্তা ধারার জন্য তাকে সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলা হতো না, বরং সুফিবাদকে তাত্ত্বিক করে তোলার পেছনে তার অবদানের জন্যই তিনি এরূপ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।

তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা 

  • আল ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ (দ্য মাক্কান ইলুমিনেশন): এটি ইবনে আরাবীর শ্রেষ্ঠ রচনা। ৩৭ খণ্ডের এই মহাগ্রন্থটি আধুনিককালে ৪ খণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মোট ৫৬০টি অধ্যায়ে রহস্যময় সুফি দর্শন থেকে শুরু করে অধিবিদ্যিক দর্শন, সবই আলোচনা করা হয়েছে।
  • ফুসাস আল হিকাম (দ্য রিংটোন অব উইজডম): উপরের ৫৬০ অধ্যায়ের মহা গ্রন্থটি পড়ার যদি সময় না থাকে, তাহলে আপনি এই গ্রন্থটি পড়তে পারেন। এটিকে অনেক সময় ইবনে আরাবীর জীবন ও দর্শনের সারসংক্ষেপ বলা হয়ে থাকে।
  • দিওয়ান: আল আরাবীর কবিতাসমগ্র।
  • রুহ আল কুদস (হোলি স্পিরিট ইন দ্য কাউন্সেলিং অব দ্য সোল): আন্দালুসিয়ায় থাকাকালীন নিজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লিখেছেন এই বইটি। বইটি তৎকালীন সুফিদের জীবনী নির্ভর।
  • মাসাহিদ আল আশরার (কটেমপ্লেশন অব দ্য হোলি): নিজের জীবনের মোট ৬টি দৈবঘটনা এবং আদেশ নিয়ে লিখেছেন এই বইটি।
  • মিশকাত আল আনওয়ার (হাদিস সংকলন): ১০১টি গুরুত্বপূর্ণ হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
  • তারজুমান আল আশওয়াক (দ্য ইন্টারপ্রেটার অব ডিজায়ারস): স্বপ্নের ব্যাখ্যা এবং ভাগ্য বিষয়ক আলোচনা।
  • আইয়াম আল শা’ন (দ্য বুক অব গড’স টাইম): সময়ের উৎপত্তি এবং প্রবাহ নিয়ে দার্শনিক আলোচনা।
  • উনকা মুঘরিব: সুফিবাদের সংজ্ঞা এবং বিস্তারিত।

ইবনে আরাবীর কিছু দর্শন যতটা সহজ ছিল, কিছু দর্শন ছিল ঠিক ততটাই দুর্বোধ্য। দর্শন এবং সুফিবাদের ক্ষেত্রে তার ভাষারীতি এবং বর্ণনার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তার শব্দচয়ন এবং বুনন ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। তার লেখা পড়তে সুবিধা করার জন্য তার অনুসারীর কেবল তার লেখার জন্য পৃথক একটি অভিধান তৈরি করেছিলেন! পবিত্র কুরআনে যেরূপ মানবজাতির প্রতি সার্বিক বিধানসমূহ অত্যন্ত গম্ভীর এবং ঝংকারপূর্ণ কবিতার আকারে এসেছে, ইবনে আরাবীর কবিতাগুলো কিছুটা তেমনই। সমগ্র কুরআন একটি অতি উৎকৃষ্ট সাহিত্য। আর এই সাহিত্যকে আদর্শ ধরেই নিজে সাহিত্য রচনা করেছেন আরাবী।

অন্যদিকে আল আরাবীর ফুতুহাত গ্রন্থটিকে এককথায় সুফিবাদের বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। সুফিবাদের তিনটি মূল স্তম্ভ যুক্তি, প্রথা এবং অন্তর্দৃষ্টিকে তিনি অনুপম দক্ষতায় ব্যাখ্যা করেছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থেই তিনি তার বিখ্যাত দর্শন ‘ওয়াহাদাত আল ওয়াজুদ’ বা ‘ইউনিটি অব বিং’ এর পরিচয় করান। এর সহজ বাংলা হতে পারে অস্তিত্ব বা সত্তার একত্ব। তার এই দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে তার অন্তর্নিহিত শক্তি আর সম্ভাবনার নাগাল পাইয়ে দেয়া। যিনি সঠিক পথে গিয়ে নিজের প্রকৃত ক্ষমতা উন্মোচন করতে পারবেন, তিনি ‘ইনসান আল কামিল’ বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবেন।

এককথায় ইউনিটি অব বিং এর মূলকথা হচ্ছে, “যেহেতু সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর উর্ধ্বে এবং সর্বোৎকৃষ্ট, তাই তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা নন কিংবা বিশ্বসংসার তার থেকে আলাদা নয়। বরং, সমগ্র মহাবিশ্ব তার মাঝেই নিমগ্ন আছে!” কিন্তু তার এই গভীর চিন্তা সমকালীন অনেকেই ধরতে পারেনি। ফলে তাকে ‘সর্বেশ্বরবাদী’ উপাধি দেয় অনেকে এই যুক্তিতে যে, তিনি সর্বত্র সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি বিরাজমান বলেছেন হেতু তিনি সবকিছুকেই সৃষ্টিকর্তা বিবেচনা করেন! অথচ তার এই দর্শনে অত্যন্ত চমৎকারভাবে মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার বাণী রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা যেমনি তার সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান, অন্য কথায় তার মাঝেই তার সৃষ্টি নিমজ্জিত হয়ে আছে, তেমনি একজন যথযথ পূর্ণাঙ্গ মানুষ তার কাজের মাঝেই বিরাজমান। অধ্যবসায় আর সাধনার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আর যিনি পূর্ণতা লাভ করেন, তিনি সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারেন।

ইবনে আরাবী শুধু সমকালীন সুফিদের শিক্ষক ছিলেন না, তিনি তার পরবর্তী সময়ের সকল সুফি সাধকের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণাদায়ী আদর্শ হয়ে আছেন। সুফিবাদ তার দ্বার যতটুকু প্রভাবিত হয়েছে তা অন্যান্যদের ক্ষেত্রে কল্পনার অতীত। কিন্তু তাই বলে তিনি একজন নিছক সুফি সাধক নন, তিনি একজন উৎকৃষ্ট দার্শনিকও বটে। ইসলামের গৌরবময় স্বর্ণযুগের মহান মনিষীদের দর্শন পড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তার দর্শন ছাড়া। শেষ করবো তার একটি উক্তি দিয়ে।

“অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতা সম্পর্কেও অজ্ঞ। কারণ সে তার অজ্ঞতায় প্রতিনিয়ত অবগাহন করে চলে! জ্ঞানী ব্যক্তিও তার জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানী নয়। কারণ সে প্রতিনিয়ত তার জ্ঞানের আলোয় অবগাহন করে চলে! আর যে ব্যক্তি আল্লাহর একক অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, একটি গাধাও তার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে বলে সে প্রমাণ করে!”

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: