সোহরাব রোস্তম - মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৩ আগস্ট ২০২৩ ১৮:১৩

সোহরাব রোস্তম - মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী : সংগৃহীত ছবি সোহরাব রোস্তম - মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী : সংগৃহীত ছবি

গল্প - সোহরাব রোস্তম 
লেখক - মহাকবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী
অনুবাদক - মমতাজউদদীন আহমেদ

পর্ব-২

 

মহাবীর রোস্তম ইরানের ভরসা। যুদ্ধক্ষেত্র নিয়েই তাঁর দিনরাত্রি কেটে যায়। এদিকে সোহরাব দিনে দিনে আপন মহিমা ও শৌর্য নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগল। যেমন তার বিশাল দুটি বাহু, তেমনি উদার প্রশস্ত বক্ষ একবার দেখলে বারবার দেখতে হয়। হবেই না কেন? রোস্তমের পুত্র আর এক অতুলনীয় বীর হয়ে পৃথিবীতে আসছে। জাল যার পিতামহ, শাম যার পিতামহ এবং স্বয়ং রোস্তম যার পিতা, সেই পুত্র সোহরাব কি আবার সামান্য বীর হবে! সেও দুরন্ত অশ্বের কেশর ধরে টান মারে, এক থাবায় বাঘের মুখকে চুরমার করে। তলোয়ার, বর্শা ও গদাযুদ্ধে সোহরাব সামেনগানের বীর বলে পরিচিত হলো।

একদিন কিশোর সোহরাব এসে মাকে বলল, মা আমার সমবয়সীরা সকলেই বাবার কথা বলে। আমি বাবার কথা কিছুই বলতে পারি না। তাহলে কি আমার বাবা যুদ্ধক্ষেত্রে অকালে প্রাণত্যাগ করেছেন?

তহমিনা ছেলেকে সান্তবনা দিয়ে বলল- না সোহরাব, তোমর বাবা জীবিত আছেন। তিনি ইরানের মহাবীর রোস্তম এই দেখো তোমার বাহুতে বাঁধা রয়েছে তোমার বাবার দেয়া তাবিজ। এই তাবিজে তাঁর নাম লেখা আছে।

সোবহার বাবার কথা শুনে, বাবার বীরত্বের মহিমা জানতে পেরে মাকে বলল- মা, আমি বাবার কাছে যাব বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলব, পিতা, আমি তোমার স্নেহের পুত্র সোহরাব।

মা তহমিনা ছেলের মুখে আদরের চুম্বন দিয়ে বলল, তুই চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকব। সোহরাব, তোকে কাছে পেলে তোর বাবা কোনোদিন তোকে আমার কাছে ফেরত পাঠাবে না।

তহমিনার অশ্রুসজল চোখ দুটি মুছিয়ে স্নেহময় কন্ঠে সোহরাব বলল, কিন্তু বাবাকে না দেখলে আমার জীবন যে অপূর্ণ থেকে যাবে মা।

ইরানে আর তুরানে আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাজা কায়কাউসের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য ইরানের চিরশত্রুরা আবার তাদের পরাজয়ের শোধ নেয়ার জন্য সাজ সাজ রব তুলেছে। মাজেন্দ্রান জয়ের পর পার্শ্ববর্তী সব দেশই ইরানের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। কেবল হামাউনের রাজা অধীনতা স্বীকার করলেন না।


রাজা কায়কাউস হামাউন আক্রমণ করলেন। হামাউনের রাজা মাত্র কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে এক পাহাড়ি কেল্লায় পলায়ন করলেন। হামাউনের রূপসী কন্যা রুদাবার রূপে মুগ্ধ হয়ে রাজা কায়কাউস তাকে বিবাহ করলেন।

কিন্তু হামাউন মনে মনে এ বিবাহ স্বীকার না করলেও বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। রাজা হামাউন সুযোগ বুঝে কন্যা ও জামাতাকে পাহাড়ি দুর্গে আমন্ত্রণ জানাল। রাজা কায়কাউস শ্বশুরের আমন্ত্রণ পেয়ে সরল মনেই পাহাড়ি কেল্লায় গেলেন। তাঁর আদর আপ্যায়নের কম হলো না। কিন্তু কায়কাউস বুঝতে পারলেন তিনি শ্বশুরের দুর্গে বন্দি হয়েছেন। এ খবর বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ল। ইরানের শত্রুরা এবার কঠিন আঘাত হানার জন্য প্রস্ত্তত হলো। সবার আগে সৈন্যসামন্ত নিয়ে ছুটে এল তুরানের রাজকুমার আফরাসিয়াব।

সামেনগান তুরান রাজ্যেরই একটি নগর। সামেনগানের বীর সোহরাবও এ যুদ্ধে একজন সেনাপতি হয়ে তুরানের পক্ষে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এল।

মা তহমিনার বুক আর একবার কেঁপে উঠল। সে ছুটে এসে সোহরাবের পথ রোধ করে বলল, সোহরাব তুই এ যুদ্ধে যাসনে। এ ভয়ংকর যুদ্ধ, না জানি কী এক দুঃসহ ঘটনা ঘটাবে।

সোহরাব মাকে বলল, আমি তো যুদ্ধ করতে যাচ্ছিনে মা, আমি যাচ্ছি বাবার সঙ্গে দেখা করতে। বাবার সঙ্গে দেখা করে আমি নিজে তাঁর মাথায় ইরান তুরানের মিলিত মুকুট পরিয়ে দেব।

দ্রুতগতি অশ্বে চড়ে কিশোর সোহরাব বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা করার জন্য ছুটে চলে গেল। তহমিনা সেদিনের মতো আজও ঝরোকায় চোখ রেখে ছেলের যাওয়া দেখল। যতক্ষণ ঐ লাল ঘোড়াটি দেখা যাচ্ছিল, ঘোড়ার পিঠে স্নেহের সোহরাবকে দেখল মা। তারপর অশ্রুতে ঝাপসা হলো তার চোখ। তহমিনা শয্যায় পড়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদল। আজও কী দেবতারা তার কান্না শুনতে পেল? তহমিনা কেঁদে কেঁদে দেবতার উদ্দেশে বলল- আমার সোহরাবকে অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করো, হে অগ্নিদেবতা।

তুরান যখন ইরান আক্রমণ করে তখন মহাবীর রোস্তম ছিলেন জাবুলিস্তানে। রাজা কায়কাউস দূত মারফত মহাবীরকে অনুরোধ করে পাঠালেন ইরানের এ দুর্দিনে ছুটে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে।

যুদ্ধের দামামা শুনে প্রকৃত বীর কি ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে? যুদ্ধের আহবান শুনে প্রিয় রখ্‌শ ছুটিয়ে মহাবীর রোস্তম এলেন ইরানে। ইরান-ভরসা রোস্তম এ যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।

ইরান ও তুরান দুই প্রতিপক্ষ বাহিনীর যুদ্ধশিবির পড়েছে একই মাঠের দুই দিকে। তুরানি শিবিরের দিকে এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কিশোর সোহরাব দেখছে ইরানের শিবির আর ভাবছে কোন ছাউনির মধ্যে তার বীর পিতা রয়েছেন। কেমন করে নির্জনে নিরালায় পিতার সঙ্গে তার দেখা হবে।

সোহরাব মনে মনে এক বুদ্ধি ঠিক করল। সে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নির্জনে তার পিতার সঙ্গে মিলিত হবে।

তুরানের দূত গেল ইরানের শিবিরে। তুরান-বীর কিশোর সোহরাব, দ্বন্দ্বযুদ্ধ আহবান করেছেন প্রবীণ রোস্তমের বিরুদ্ধে। দূতের মুখে এ আহবান শুনে রোস্তম মৃদু হাসলেন। বালকের সাহস তো কম নয়! কে এই দুর্দম বালক? রোস্তম নিজের পরিচয় গোপন রেখে এ আহবানে সাড়া দিলেন নিতান্তই কৌতূহল বশে।

দুই শিবির থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এলেন রোস্তম আর সোহরাব। নির্জন গিরিপথে পিতা পুত্রের দেখা হলো।পুত্র দেখল পিতাকে আর পিতা দেখল পুত্রকে। কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। রোস্তম বালক সোহরাবকে বললেন, ওহে বালক তোমার মায়ের চিত্তে কী ভয় নেই? কোন সাহসে তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করেছেন? জীবনের মায়া থাকে তো এখনই পলায়ন করো।

সোহরাব বলল, আপনি কী সেই মহাবীর রোস্তম? বালকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লজ্জা পেয়ে বললেন, না। রোস্তম এখন জাবুলিস্তানে। আমি রোস্তমের একজন ভৃত্য মাত্র।

সোহরাবের মন হতাশায় আচ্ছন্ন হলো। তবু যুদ্ধ শুরু হলো। বর্শা ভাঙল, তলোয়ার খানখান হলো। দুই বীরের শরীর রক্তাক্ত হলো। দিবসের শেষ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ল। সোহরাবের গদার আঘাতে রোস্তম কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছেন। সেদিনের মতো যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে সোহরাব বলল-আজ সন্ধি করলাম, কাল আমাদের হারজিতের পরীক্ষা হবে।

দুই বীর তাঁবুতে ফিরে গেলেন। রোস্তম ভাবেন, কে এই বালক? তার বাহুতে এত শক্তি কোথা থেকে এল? আর সোহরাব ভাবে-কীজন্য এলাম যুদ্ধ করতে যদি আমার বাবা জাবুলিস্তানেই থেকে গেল?

পরের দিন আবার সেই নির্জন স্থানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব পুনরায় জিজ্ঞেস করল, অনুগ্রহ করে বলুন আপনি কী সত্যি মহাবীর রোস্তম নন? যদি রোস্তম হন তাহলে আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করব না।

রোস্তম তখন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সোহরাবকে উত্তেজিত করছেন: ওহে মুষিকপ্রবর, রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করা দুগ্ধপোষ্য বালকের কাজ নয়। আগে আমাকে পরাজিত করো, তাহলেই রোস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ করার আস্পর্ধা করো।

সোহরাব এবার উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রোস্তমকে প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল। রোস্তম সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলেন সোহরাব তার বুকের ওপর বসে অস্ত্রের আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। রোস্তম কৌশল করে বললেন, এ তোমার কোন বীরত্বের রীতি? শত্রুকে পরপর দুবার পরাজিত না করলে তাকে প্রাণে বধ করা যায় না। ইরানের এই যুদ্ধরীতিকে তুমি অস্বীকার করতে চাও?

সোহরাব রোস্তমকে ছেড়ে দিল। সেদিনের মতো সন্ধি, আবার আগামীকাল যুদ্ধ।

তৃতীয় দিন আবার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সোহরাব দেখছে রোস্তমকে। একবার নয়, দুবার নয়, বারবার সে দেখছে রোস্তমের দিকে। রোস্তমের আজ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি সামান্য এক বালকের হাতে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে রাজি নন। প্রচন্ড যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আনমনা সোহরাবকে আজ রোস্তম ধরাশায়ী করে ফেললেন।

সোহরাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রথম সুযোগে রোস্তম তীক্ষ্মধার তলোয়ার বের করে সোহরাবের বুকে ঢুকিয়ে দিলেন। সোহরাবের তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কোথায় গেল ইরানের যুদ্ধের নিয়ম, কোথায় গেল মহাবীর রোস্তমের বীরত্ব। সোহরাব যন্ত্রণায় এবং ক্ষোভে ক্রন্দন করে বলল, শোনো ইরানি কাপুরুষ। তুমি অন্যায় যুদ্ধে প্রথম পরাজয়ে আমাকে প্রাণে বধ করলে। কিন্তু এ সংবাদ যখন আমার বাবা জানতে পারবেন তখন তুমি সাগরের অতলেই থাকো, কিংবা আকাশে নক্ষত্রের মধ্যে পলায়ন করো তিনি তোমাকে ক্ষমা করবেন না।

রোস্তম বলল, কে তোমার বাবা?

সোহরাবের বুক থেকে তখন রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে। ক্লান্ত অবসন্ন সোহরাব বলল, মহাবীর রোস্তম আমার বাবা, আর সামেনগানের অধিপতির কন্যা তহমিনা আমার মা।

সহস্র বজ্রপাতের মতো মহাবীর রোস্তমের কানে সোহরাবের শেষ কথাগুলো শেলবিদ্ধ হলো। রোস্তম আর্তনাদ করে বলল, মিথ্যা কথা, ওরে বালক মিথ্যা কথা! আমার কোনো পুত্রসন্তান নেই। তহমিনা আমাকে সংবাদ দিয়েছে, আমার কন্যাসন্তান হয়েছে।

সোহরাব শেষবারের মতো চক্ষু মেলে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে তার হাত তুলে দেখাল, সেখানে একটি তাবিজ বাঁধা আছে। সোহরাব বলল, বাবা আমার আর কোনো দুঃখ নেই। সোহরাবের চোখ বন্ধ হয়ে গেল।

সোহরাবের নিস্পন্দ দেহ পিতার বক্ষে আশ্রয় লাভ করল।

তখন নির্জন গিরিপথে কোনো প্রাণী ছিল না, আকাশের সূর্য এসে সোহরাবের মুখে পড়েনি, কোনো বিদায় রাগিণী বেজে উঠে সেই বিদায় দৃশ্যকে বিহবল করেনি। তবু রোস্তমের বুকফাটা হাহাকার ফিরে আয় মানিক। প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে এসে বারবার বলছিল, নেই সোহরাব নেই।

দিবসের শেষ সূর্য যখন পর্বতের ওপারে ঢলে পড়ল, তখনও হতভাগ্য মহাবীর রোস্তম ছেলের প্রাণহীন দেহ বক্ষে ধারণ করে বার বার বলছে: আয় সোহরাব ফিরে আয়।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: