ফিনান্সিয়াল টাইমসের ডকুমেন্টারি

হাসিনার শাসনামলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট হয়েছে

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:০২

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সরকারি সম্পদের অপব্যবহার নিয়ে নতুন আলোচনার ঝড় উঠেছে।

ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক নতুন ডকুমেন্টারি “বাংলাদেশ’স মিসিং বিলিয়নস, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট”-এ বলা হয়েছে, হাসিনার শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এখন সেই অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও কাজটি সহজ নয়।

ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে হাসিনার সরকার সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা প্রস্তাব আনে। এতে আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়দের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশব্যাপী তীব্র বিক্ষোভ। সরকারী দমন ও সহিংসতা শুরু হয়, যেখানে পুলিশ ব্যারিকেড বসায়, গুলি চালায়, স্নাইপার শট এবং হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপ করে। ৫ আগস্ট পরিস্থিতির তীব্রতার পর শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হয়। জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, এই আন্দোলনে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়।

ডকুমেন্টারিতে আরও বলা হয়েছে, হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ ছিল। এসব অর্থের বড় অংশ যুক্তরাজ্যে গিয়েছে। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পরিবারও বিতর্কে জড়িত। টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ছিলেন, তদন্তের মুখে পড়ে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩৫০ সম্পত্তি ব্রিটিশ অপরাধ দমন সংস্থা জব্দ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার অনুমান করছে, হাসিনার শাসনামলে প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

হাসিনার ঘনিষ্ঠরা সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর সহায়তায় বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে। ব্যাংক পরিচালককে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং ব্যাংক থেকে নিজেদের স্বার্থে হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ দেয়া হয়। এসব অর্থের বড় অংশ বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লুটপাট।

ডকুমেন্টারিতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পরিবারের কথিত বিদেশি সম্পদ ও অফশোর অ্যাকাউন্টের বিশ্লেষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। লুট হওয়া অর্থ মূলত অতিরিক্ত বা কম ইনভয়েস দেখানো, হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল এবং যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে।

হাসিনার পতনের পর ক্ষমতার শূন্যতা পূরণের জন্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে। সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছে এবং লুট হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যেই ২৯০ বিলিয়ন টাকা ঢেলে ব্যাংক ব্যবস্থাকে সচল রাখার চেষ্টা করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লুট হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে “বছরের পর বছর” সময় লাগবে।

ডকুমেন্টারিতে দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি কিভাবে ২০২৪ সালে জনঅসন্তোষের জন্ম দিয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে এই অসন্তোষ তীব্র ছিল। এতে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান পুঁজি পাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার চাপ বাড়ছে। নীতি-নিয়ন্ত্রণকারীরা বলছেন, আগে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে হবে। আগামী নির্বাচন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা যদিও উঁচু, কিন্তু মৌলিক সংস্কার না হলে দেশ আবারও ক্ষমতার একচেটিয়া দখলে ফিরতে পারে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: