
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, সংস্থাটির পূর্বানুমোদন ছাড়া দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অ্যাডহক কিংবা দৈনিক মজুরিভিত্তিক জনবল নিয়োগের সুযোগ নেই। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হলেও ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড বা সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিতে হয়। এর পর ইউজিসির অনুমোদন সাপেক্ষে অন্তত দুটি জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়। তবে এসব নির্দেশনা অমান্য করেই সম্প্রতি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দীর্ঘদিন ধরেই নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিগত সরকারের সময়কার মতো যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ ও পরে স্থায়ীকরণের অভিযোগ উঠছে এখনো।
গত ২৭ জানুয়ারি বিভিন্ন পদে নয়জনকে অস্থায়ী নিয়োগ দেয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের মধ্যে সহকারী অধ্যাপক পদে দুজন, প্রভাষক পদে একজন, সহকারী রেজিস্ট্রার পদে চারজন, সেকশন অফিসার পদে একজন এবং সহকারী পরিচালক পদে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৭ জানুয়ারি উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে ড. মো. ইকবাল হোসেনকে, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে ড. মো. সগিরুল ইসলাম মজুমদারকে, কমিউনিটি হেলথ অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের প্রভাষক পদে ডা. মো. মহিবুল্লাহকে; সহকারী রেজিস্ট্রার পদে আবু তাহের, সুইন আহমেদ, মো. মাহমুদ-আল-জামান, লোকমান হোসেন (মিঠু); সেকশন অফিসার পদে এসএম মেহেদী হাসান এবং সহকারী পরিচালক পদে মাহমুদ হোসাইনকে চুক্তিভিত্তিক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়োগের আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির রিজেন্ট বোর্ড ও ইউজিসির কোনো ধরনের অনুমোদন নেয়া হয়নি। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়নি।
শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ড. মো. সগিরুল ইসলাম মজুমদার উপাচার্যের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন বলে অভিযোগ করে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি উপাচার্য তার আত্মীয় হন। এ পরিচয়েই তিনি চাকরি পেয়েছেন।’
তবে এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করছেন ড. মো. সগিরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমি এর আগে বাংলাদেশ পাট গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত ছিলাম। আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার। কিন্তু সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলের রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় আওয়ামী লীগের সময়ে আমি শিক্ষকতায় যোগদান করতে পারিনি। এ কারণে সরকার পতনের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যোগাযোগ রাখছিলাম এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে শিক্ষক সংকট থাকায় কর্তৃপক্ষ আমাকে খণ্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছে।’
এ বিষয়ে পবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি উপ-উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এর পর যোগাযোগের চেষ্টা করেও উপ-উপাচার্য ড. এসএম হেমায়েত জাহানের মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. ইকতিয়ার উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, শিক্ষক সংকট থাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তাদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগের পর ইউজিসিকে জানানো হয়েছে এবং অনুমোদন নেয়ার বিষয়ে কাজ চলছে। পরে পোস্ট পেলে সার্কুলারের মাধ্যমে তাদের নিয়ে নেয়া হবে।’
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সম্প্রতি পিএ টু ভিসি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ওই পদে শতাধিক প্রার্থী আবেদনও করেছেন। তবে এ নিয়োগের নির্ধারিত প্রক্রিয়া পুরোপুরি সম্পন্ন না করেই গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পদটিতে সাকিব হোসেন নামের একজনকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। সাকিব হোসেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন।
এছাড়া সম্প্রতি অবসরপূর্ব ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া রেজিস্ট্রারকেও ছুটি স্থগিত করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম ১ ফেব্রুয়ারি পিআরএলে যান। অভিযোগ রয়েছে, তাকেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিনের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. মো. মামুন অর রশিদ বলেন, ‘রেজিস্ট্রারের ক্ষেত্রে যেভাবে নিয়োগ হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটি যথাযথভাবে হয়নি। আর পিএ টু ভিসি পদে কীভাবে নিয়োগ হয়েছে সে বিষয়ে আমরা অবগত নই।’
ইউজিসির নির্দেশনায় অ্যাডহক নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রয়েছে। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গোবিপ্রবি) রিজেন্ট বোর্ডও আলাদাভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও গত ১৩ নভেম্বর সেকশন অফিসার হিসেবে আবদুল্লাহ আল তোফায়েল আল আহমদ নামে একজনকে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করলে উপাচার্য বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে গোবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক হোসেন উদ্দিন শেখর বলেন, ‘তাকে চুক্তিভিত্তিক নয়, অস্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমরা পরে নিয়োগপত্র সংশোধন করেছি। আপাতত কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইউজিসির সঙ্গে কথা বলেই এ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা বলেছে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া যাবে। আর শিক্ষার্থীরা নিয়োগপ্রাপ্তের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছিল। আমরা তখন বলেছিলাম, এ বিষয়ে কেউ তথ্য-প্রমাণ দিতে পারলে আমরা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি অনুসন্ধান করব। কিন্তু পরে কেউ এ ধরনের তথ্য-প্রমাণ জমা না দেয়ায় আর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) সম্প্রতি সেখানকার সাবেক এক শিক্ষার্থী স্নাতকের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতেখারুল আলম মাসুদ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব অস্থায়ী ভিত্তিতে মোমেন খন্দকার নামের ওই সাবেক শিক্ষার্থীকে ছয় মাসের জন্য আইসিটি সেন্টারের সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
মোমেন খন্দকার ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৮ নভেম্বর যখন তাকে নিয়োগ দেয়া হয় তখন তার স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়নি। নিয়োগ পাওয়ার প্রায় এক মাস পর গত ১২ ডিসেম্বর তার চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি সিজিপিএ ৩ দশমিক ২ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি আমি একটু আগেই জানলাম। সে “অ্যাপিয়ার্ড” হিসেবে আবেদন করেছে কিনা, আমাকে একটু দেখতে হবে।’
‘অ্যাপিয়ার্ড’ দিয়ে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে যোগদান করা যাবে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘বিষয়টি আমি সম্পূর্ণ আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের এখতিয়ারে ছেড়ে দিয়েছিলাম। নিয়ম-কানুনের বিষয়ে আমি রেজিস্ট্রার ও আইসিটি সেন্টারের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলব। বিষয়টি আমি দেখছি।’
তবে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী, যে পদে চাকরি দেয়া হয়েছে, সে পদের জন্য ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি প্রয়োজন। "‘অ্যাপিয়ার্ড’ আসলে কোনো সার্টিফিকেট নয়; এটি ব্যবহার করে বিসিএস পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকলেও চাকরির ক্ষেত্রে কনফার্মেশন ছাড়া নিয়োগ দেয়ার সুযোগ নেই।’
এ ঘটনায় শুক্রবার উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাবির আইসিটি সেন্টারে সহকারী প্রোগ্রামার পদে একটি অ্যাডহক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন প্রণয়নের জন্য উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খানকে সভাপতি করে তিন সদস্যের একটি কমিটি হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান বলেন, ‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের একাডেমিক অভিজ্ঞতার দিকটি মাথায় রেখেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে নতুন উপাচার্যদের কাছ থেকে আমরা তা প্রত্যাশা করি না। এ উপাচার্যরাও যদি অনিয়ম করেন, তাহলে সেটি দুঃখজনক।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইউজিসির কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সুশাসন নিশ্চিত করা। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অনিয়মের অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: