বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে গতকাল সকালে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে বিক্রম মিশ্রি ঢাকায় আসেন। ঢাকায় প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠকের আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন তিনি।
বৈঠকের পর দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন দুই দেশের মধ্যে আস্থার ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে এই আলোচনাকে ‘আস্থার ঘাটতি পূরণের’ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি গঠনমূলক ও ইতিবাচক সম্পর্কের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে দিল্লির প্রত্যয়ের কথা জানান।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে এটাই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে, দিল্লিতে।
এরপর মধ্যাহ্নভোজ সেরে তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সবার শেষে তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন। রাতে তিনি দিল্লি ফিরে যান।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য পছন্দ নয়
বিক্রম মিশ্রির সফরের বিষয়ে সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থানের পর সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর বয়ানের বিষয়ে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ভারত সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের অভিযোগ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা জোর দিয়ে বলেছি যে বাংলাদেশে বসবাসরত সবাই স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করে আসছে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানিয়েছে।
আমাদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা, গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলেছি যে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক চায়।
বিক্রম মিশ্রি, পররাষ্ট্রসচিব, ভারত
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হচ্ছে না, সেটা ভারতকে জানানো হয়েছে, এমনটা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত।’
এ বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমার ধারণা, এ বিষয়ে একধরনের ভুল–বোঝাবুঝি ছিল, ঘাটতি ছিল। আমার প্রত্যাশা, আজকের বৈঠকের পর সেই ঘাটতি কমবে।’
ভারত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা তাঁর (বিক্রম মিশ্রি) যে উচ্চারণ এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই। সম্পর্কের বিষয়ে সদিচ্ছার প্রশ্নে যে ঐকমত্য হয়েছে, সেটার প্রতিফলন ঘটে কি না, তা সামনের দিনে দেখতে চাই।’
দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আস্থার যে ঘাটতি ছিল, তা মেটাতে এই বৈঠকে কোনো বার্তা ছিল কি না, জানতে চাইলে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আস্থার একটা ঘাটতি তো আছেই। সমস্যাটাকে যদি স্বীকার না করি, তাহলে তো সমাধানে যেতে পারব না। কাজেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে আস্থার একটা ঘাটতি ছিল বলেই আমাদের এই পথটা অতিক্রম করতে হয়েছে। আজকের যে বৈঠক, সেই ঘাটতি মেটানোর পথে এগিয়ে যাওয়ার একটা পদক্ষেপ। রাজনৈতিক বার্তা যদি বলেন, আমরা এই পথটা অনুসরণ করে পরবর্তী স্তরে আলাপ–আলোচনা আশা করব।’
এক প্রশ্নের উত্তরে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বলেছি, তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতে বসে যে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা আমাদের পছন্দ হচ্ছে না।...এটা তাঁকে (শেখ হাসিনাকে) যেন জানানো হয়। তাঁরা (বিক্রম মিশ্রি) বিষয়টিকে আমলে নিয়েছেন।’
বৈঠকে সীমান্তে হত্যার প্রসঙ্গটি আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি জীবন মূল্যবান। এ লক্ষ্যে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অনুরোধ করেছি।’
সীমান্ত হত্যার ব্যাপারে ভারতের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, ‘তাঁরা বলেছেন, সীমান্তে নানা ধরনের অপরাধ হয়। এর (সীমান্ত হত্যা) সঙ্গে এটার যোগ আছে। আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের অপরাধের সমর্থন করি না। একই সঙ্গে আমরা হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করি না।’
পররাষ্ট্রসচিব জানান, সম্প্রতি ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে নজিরবিহীন হামলা এবং কলকাতা মিশনের কাছে বিক্ষোভের ঘটনা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বলেছি, এই মিশনের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।’
ভিসা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রসচিব জানান, ‘প্রতিবছর পর্যটন এবং চিকিৎসা উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক ভারত সফর করেন। তাঁদের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার সেবা সহজীকরণের জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি।’
পররাষ্ট্রসচিব জানান, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ।
সরকারের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কের প্রত্যয়, সংখ্যালঘু ইস্যুতে উদ্বেগ ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বিকেলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেখা করেন। এরপর বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের সামনে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন। তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নেননি।
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক ও ইতিবাচকভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় বলে জানান বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেছেন, এ জন্য দুই দেশের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী দিল্লি।
বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা, গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলেছি যে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক চায়। আমরা সব সময়...অতীতেও দেখেছি এবং আমরা ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ককে একটি জনকেন্দ্রিক ও জনমুখী সম্পর্ক হিসেবে দেখব। যে সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকবে সব মানুষের কল্যাণ।’
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘পরস্পরের জন্য সহায়ক এই সহযোগিতা আমাদের উভয় দেশের জনগণের স্বার্থে অব্যাহত থাকবে না, এটা ভাবার কারণ নেই। আমি আজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য ভারতের আগ্রহের কথা তুলে ধরেছি। একই সময়ে, আমরা কিছু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি।’
বিক্রম মিশ্রি আরও বলেন, ‘আমি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত আমাদের উদ্বেগগুলো জানিয়েছি। আমরা সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক সম্পত্তির ওপর হামলার কিছু দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও আলোচনা করেছি।’
গতকালের একাধিক বৈঠকে উপস্থিত কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিক আস্থার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দিনের শুরুতে একধরনের আড়ষ্টতা ছিল। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা কেটে গিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। বিশেষ করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সম্পর্ককে ভবিষ্যতের নিরিখে দেখার ওপর এবং জনমুখী করার বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন।
সম্পর্কে এসেছে কালোমেঘ , এটি দূর করতে হবে
বিক্রম মিশ্রির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, সেই মেঘ দূর করতে হবে। বাংলাদেশও বলেছে, এটি দূর করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সাক্ষাতের পর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ কথা জানান। বিক্রম মিশ্রির পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্য এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘অপপ্রচারের জবাব লিখিত ও মৌখিক—বহুভাবেই বলেছি, যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর সুযোগ খুবই কম। সেগুলো কখনো কখনো ব্যক্তিগত, বেশির ভাগই রাজনৈতিক। আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার না এটির অংশ, না এটি কোনোভাবেই বরদাশত করছে। যেখানে যেখানে এ রকম অভিযোগ এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, এই মেঘটি দূর করতে হবে। আমরাও বলেছি, এই মেঘটি দূর করতে হবে।’
এদিকে বাসস জানায়, নয়াদিল্লি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এবং দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক জোরদারে ‘সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা’য় আগ্রহী বলে জানিয়েছেন বিক্রম মিশ্রি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক বৈঠকে এ কথা জানান তিনি।ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সম্পর্ক বাড়ানো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই। আমরা এটাকে উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হিসেবে দেখি।’
প্রায় ৪০ মিনিটের বৈঠকে সংখ্যালঘু ইস্যু, অপতথ্য প্রচার, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে ‘খুবই দৃঢ়’ ও ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: