ডলার সঙ্কটের কারণে ছোট ছোট আমদানিকারকেরা তাদের ব্যবসা নিয়ে বিপাকে আছেন৷ কেউবা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ আবার কেউ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাইরে থেকে উচ্চ মূল্যে ডলার কিনছেন আমদানির জন্য এলসি খুলতে৷
ব্যাংকগুলো ছোট আমদানিকারকদের এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না৷ আবার বড় ব্যবসায়ীরাও প্রয়োজনীয় ডলার কিনতে পারছেন না৷ ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না৷
পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন গত সপ্তাহে কলাবাগান এলাকার রাস্তায় ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন৷ তিনি বলেন, ভাই আপনারা কিছু লেখেন, আর তো ব্যবসা ধরে রাখতে পারছি না৷ ছোট খাট আমদানির ব্যবসা করি তা দিয়েই সংসার চলে৷ কিন্তু ব্যাংক থেকে অনেক দিন ধরেই ডলার পাচ্ছি না৷ বাইরে থেকে ডলার কিনেও এলসি খোলা অনেক কষ্টের৷ ব্যবসা করা যায় না৷
তার কথা, বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ম্যানেজ করতে পারেন৷ আমাদের পাত্তা দেয় না৷ কোনো কোনো ব্যাংক রাজি হলেও ডলারের সমপরিমাণ টাকা আবার ব্যাংকে জমা রাখতে বলছে৷ এলসির বিপরীতে ডলার দিচ্ছে না৷
ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখন আর এলসি খুলতে পারছি না৷ মৌলভীবাজারের অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা সরসরি ভোগ্যপণ্য আমদানি করেন৷ কিন্তু তাদের আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে৷ ব্যাংক আমাদের আর ডলার দিচ্ছে না৷ ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসা এখন মনোপলি হয়ে গেছে৷ বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে চলে গেছে আমদানি ব্যবসা৷’
তিনি জানান, ‘তারপরও আমাদের ব্যবসায়ীরা ২৫-৩০ হাজার ডলার ম্যানেজ করে ছোট ছোট চালানে আমদানি করে৷ সবাই মিলে আমরা এখন এইভাবে কম কম আমদানি করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি৷ এক লাখ ডলারের কছাকাছি হলেই আমরা আর আমদানি করতে পারি না৷ গত এক বছরে ব্যাংক থেকে আমি কোনো এলসি খুলতে পারি নাই৷’
এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মো: হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডলার সঙ্কটের কারণে যারা ছোট ছোট আমদানিকারক তাদের অনেকের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে৷ তারা ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন না৷ যারা আমদানি করছেন তারা বাইরে থেকে চড়া দামে ডলার কিনে আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে৷ ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ছে৷ বড় ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকেরা ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছেন৷ কারণ তাদের তো নিজেদেরই ব্যাংক আছে৷ তারা ডলার ম্যানেজ করতে পারছেন৷ তবে তাও যে চাহিদা মতো ডলার তারা পাচ্ছেন তা মনে হয় না৷’
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম কিছুটা কমালেও তার তেমন প্রভাব নেই খোলা বাজারে৷ আর ডলারের দাম কিছুটা কমলেও ব্যবসায়ী বলছেন, ডলার তো পেতে হবে৷ ডলার না পেলে ডলার দাম কমলেই বা কী?
দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২১টি ব্যাংক এখন রীতিমতো ডলার সঙ্কটে ভুগছে৷ কোনো কোনো ব্যাংকে ডলার নেই৷ ডলারের পাশাপাশি টাকার সঙ্কটেও পড়ছে ব্যাংকগুলো ৷ গত বুধবার ব্যাংকগুলোর তারল্য-চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনেই কয়েকটি ব্যাংককে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ধার দেয়৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ১১.২২ শতাংশ ৷ এই চার মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে মোট দুই হাজার ১৮২ কোটি ডলারের৷ যেখানে গত অর্থবছরের একই সময় এলসি খোলা হয়েছিল প্রায় দুই হাজার ৪৬৬ কোটি ডলারের৷ এ সময় ব্যাংকগুলোর এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে ২৪ শতাংশের বেশি৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তি করেছিল দুই হাজার ৮৯৪ কোটি ডলারের৷ সেখান থেকে কমে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তা নেমে এসেছে দুই হাজার ১৯৭ কোটি ডলারে৷
এদিকে ডলারের প্রধান উৎস রফতানি এবং রেমিট্যান্সেও নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে৷ রিজার্ভ অব্যাহতভাবে কমছে৷ গত অক্টোবর মাসে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন৷ আগের বছরের একই মাসে মোট ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল৷
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে৷ তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৬ বিলিয়ন ডলার৷
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: নুরুল আমিন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংককে খাদ্য, সার ও জ্বালানি তেল আনতে একটা ডলার মজুত রাখতে হয়৷ সেটা তারা চেষ্টা করছে৷ এর বাইরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলে পণ্য আমদানি সঙ্কট আছে৷ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার ক্রাইসিস আছে৷ রফতানি এবং রেমিট্যান্স ডলারের মূল উৎস৷ সেখানে উন্নতি হচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে৷ আইএমএফ, এডিবির ঋণ এলে কিছু ডলার আসলেও তাতে সংকট কাটবে না৷’
আর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের যে দায় দেনা আছে সেগুলো রিসিডিউল করা দরকার৷ সেটা করা গেলে ডলারের ওপর চাপ কমতো৷ এখন আমাদের লোনসহ নানা ধরনের দায় দেনার চাপ তো বাড়ছেই৷ ফলে ডলার সংকট কাটানো কঠিন৷ আইএমএফের কিস্তির ঋণ এবং এডিবি ওয়ার্ল্ড ও ব্যাংক থেকে এক-দেড় বিলিয়ন ডলার আসতে পারে৷ এর বাইরে তো বাড়তি ডলার আর কোনো পথ আমি দেখছি না৷ তাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে সরকারকে আলাপ আলোচনা করে দায়-দেনা শোধ কমিয়ে ডলার বাঁচাতে হবে৷’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ‘ডলারের কারণে কেউ এলসি খুলতে পারছেন না এরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই৷ তবে এটা ব্যাংক ও তাদের গ্রাহকের সম্পর্কের বিষয় হতে পারে৷ আমরা তো বলেছি অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে এখন বেশি হোল্ডিং আছে কমিটমেন্টের চেয়ে৷ সুতরাং সে এলসি না খুলে বসে থাকবে কেন? ব্যাংকেরও কাস্টমার রিলেশনশিপের বিষয় আছে৷ পারফরমেন্সের বিষয় আছে৷ এগুলো ব্যাংকই ভালো বলতে পারবে৷’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: