বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আতঙ্ক ছড়ানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অপহরণ, সন্ত্রাসমূলক অপরাধ ও রাজনৈতিক তৎপরতায় এসব অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। এর মধ্যে একাধিক ঘটনায় শিশুসহ সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির তথ্য মতে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় আট হাজার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এতে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে গড়ে প্রায় এক হাজার অস্ত্র বেশি উদ্ধার করা হয়েছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা ধরে শিগগিরই বিশেষ অভিযান শুরু হবে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্যে গত বুধবার সন্ধ্যায় মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের বকুলতলার শোলারচর এলাকায় রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া স্থানীয় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাত মাস বয়সী এক শিশুসহ ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ শিশুর শরীর থেকে এখনো গুলি বের করা যায়নি। একই দিন দুপুরে মাগুরা জেলা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিনিধিসভায় অংশ নিতে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতিপক্ষের সংঘর্ষের সময় এক যুবককে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে তাড়া করতে দেখা যায়।
গত ৩ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুরে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের ছোড়া গুলিতে নারীসহ চারজন আহত হয়। একই দিন বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্রকাশ্যে একজন অস্ত্রধারী গুলি ছুড়লে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা রাকিব হত্যার অন্যতম আসামি এবং হানজালা বাহিনীর প্রধান হানজালা পিস্তলসহ র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর হাতকড়াসহ পালিয়ে যান। এ সময় তাঁর সহযোগীদের হামলায় র্যাবের চার সদস্য আহত হন। র্যাব বলছে, হানজালা এবং তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে অন্তত ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
সর্বশেষ ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার ভোররাতে রাজধানীর ডেমরায় গুলিতে মিনহাজ আবেদীন নামের এক যুবক আহত হন। তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, ডাকাত ধরতে অভিযান চলাকালে এই ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বলছে, সম্প্রতি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে গুলির ঘটনা ১৫০টি ছাড়িয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত আরো শতাধিক গুলির ঘটনা ঘটে। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে সাতজনের বেশি। এর পর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি জেলার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সভায়।
এসব জেলা হচ্ছে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনী, খুলনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মাগুরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, বরগুনা, কুড়িগ্রাম ও পটুয়াখালী। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অভিযানে গত দেড় বছরে প্রায় ১০ হাজার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আগ্নেয়াস্ত্র।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, বছরে এক হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র দেশে ঢুকছে। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কোথায় ব্যবহার করা হয়, জানতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই অবৈধ অস্ত্র মূলত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজরা ব্যবহার করে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও সংঘাতের সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার চলে। যেহেতু সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তাই এখন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়বে বলে ধারণা করছি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে (২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) ডিএমপি ১২৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬৮৮টি গুলি এবং পাঁচ হাজার ৩৭৪ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করেছে। এ সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংক্রান্ত মামলায় ৪৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, দেড় বছরে সারা দেশে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ছয় হাজারের বেশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উদ্ধার করা অস্ত্রের বেশির ভাগ বিদেশি। এসব অস্ত্র যশোরের বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ অন্তত ৩০টি পথে সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকছে। র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, অস্ত্রের বড় চালানগুলো দেশে ঢোকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গোয়েন্দা তথ্য বলছে, দেশের সীমান্তগুলোর অন্তত ৩২টি স্থান দিয়ে দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে সমন্বিত অভিযান চালাতে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে এক হাজার ৪৯৪টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে তারা। এ সময় ৬২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় ৪৫০টি মামলা করা হয়েছে।
নির্বাচনের আগে সমন্বিত অভিযান চলবে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী তালিকাভুক্ত ২০টি জেলাসহ সীমান্তবর্তী ৩২ জেলাসহ আরো অনেক জেলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করেই পেশাদার সন্ত্রাসীরা ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও নাইন এমএম পিস্তল বেশি ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলভার আসছে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে। কুমিল্লা, যশোরের বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত হয়েও এ ধরনের অস্ত্র ঢুকছে দেশে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে জঙ্গিদের কাছ থেকে।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে অবৈধ অস্ত্র আমদানির শতাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের মালিকরা অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছে এক শ্রেণির সন্ত্রাসীর কাছে।
গত ১৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মহানগর ছাত্রদলের ছয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাঁদের কাছ থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল ও ৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গত ২২ আগস্ট ডিবি মতিঝিল বিভাগ একটি অস্ত্র, তিনটি ককটেলসহ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আবুল হাসান চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে।
বিএনপির সহযোগী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের এই সাত কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের সমালোচনা করা হয়। এ বিষয়ে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ বলেন, ‘অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে অভিযান চালানো হচ্ছে। এটা ভুল। কোনো দলের নেতা বা কর্মীকে গ্রেপ্তার করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ছাত্রদলের গ্রেপ্তার নেতারা যে ১১টি অস্ত্র কেনার জন্য অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে অর্ডার করেছে, সেটি প্রমাণিত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক নয়। কে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের সেটি আমাদের মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে, সে অস্ত্র ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, অস্ত্র ভাড়া করে মানুষের জীবনকে শেষ করার কাজ করছে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় আমরা করব।’
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, অপারেশনস) মো. হায়দার আলী খান বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে। এটা পুলিশের রুটিন কাজ। শিগগিরই সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান চালানো হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলেন, দেশে অবৈধ অস্ত্রে খুন, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: