বাংলাদেশে গত এক দিনে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৬৮৯ জন। গতকাল ৭ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৯৮২ জন ঢাকার, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার এক হাজার ৭৯০ জন।
মৃত ২০ জনের মধ্যে ১১ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের এবং ৯ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মারা গেছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা হলো এক লাখ ২৭ হাজার ৬৯৪; মৃতের সংখ্যা ৬১৮।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আগস্টে ৩১ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয় ৭১ হাজার ৯৭৬ জন। আর চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৯০৩ জন। মৃত্যু হয়েছে ৯৮ জনের।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ আখ্যায়িত করে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। তারা বলেছে, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, পীত রোগ ও জিকা ভাইরাসের মতো মশাবাহিত রোগগুলো দ্রুত এবং দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে, যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। গত বুধবার ডাব্লিউএইচও এই তথ্য জানায়।
সংস্থাটি জানায়, তারা বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ মোতায়েন করেছে, যাঁরা সার্বিক তত্ত্বাবধানে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করছেন। একই সঙ্গে গবেষণাগারের সক্ষমতা ও আক্রান্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে সহায়তা করছেন তাঁরা।
ডাব্লিউএইচওর অ্যালার্ট অ্যান্ড রেসপন্স পরিচালক আবদি মাহামুদ গত বুধবার এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এ ধরনের সংক্রমণের ঘটনা আসন্ন জলবায়ু সংকটের অশনিসংকেত দিচ্ছে। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং চলতি বছরের বাড়তি উষ্ণতা সৃষ্টিকারী এল নিনোর মতো কিছু আবহাওয়াগত নিয়ামক বাংলাদেশ, দক্ষিণ আমেরিকাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে ভয়াবহ পর্যায়ের ডেঙ্গু সংক্রমণ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জলবায়ুর প্রভাবের কারণে এখন সারা বছরই মশা প্রজনন উপযোগী হয়ে উঠেছে। আর মশা বাড়লে মশাবাহিত রোগবালাই সাধারণভাবেই বাড়তে থাকে। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপরে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিজেরা নিষ্ক্রিয় থাকলে হবে না। মানুষকেই এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী সব দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। তাদের একই জলবায়ু, একই তাপমাত্রা। কাজেই আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন যখন হয় তখন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন ঘটে। এতে এডিস মশা, ডেঙ্গু ভাইরাস অথবা অন্য কোনো ভাইরাস বৃদ্ধির জন্য উপযোগী তাপমাত্রা পেয়ে যায়। তখন তাদের প্রজনন বাড়ে, রোগ বৃদ্ধির ক্ষমতা বেড়ে যায়। সেটাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর মতো বাহকবাহিত রোগ আমাদের ব্যাপক আকারে মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে আগামী বছরগুলোতে। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সব জায়গায় প্রস্তুতি দরকার।’
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দুটি পরিবর্তন হয়। একটি হলো জলের পরিবর্তন। যেমন—বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার পরিবর্তন। অন্যটি হলো বায়ুর পরিবর্তন। এতে বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুর আর্দ্রতার পরিবর্তন হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, জীবাণুর বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে কতগুলো অনুকূল তাপমাত্রার দরকার হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে সেই অনুকূল তাপমাত্রা তৈরি হয়েছে। এতে হাজার হাজার নতুন জীবাণুর প্রাদুর্ভাব ঘটছে। একই সঙ্গে পুরনো জীবাণু বংশবিস্তার ও প্রকৃতি পরিবর্তন করছে। এ কারণে ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। একই সঙ্গে অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) রোগ ও সংক্রমণ থেকে সুস্থ হতে স্বাভাবিকের বেশি সময় লাগছে। কারণ জীবাণুগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রাণী থেকে ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার এবং মহামারি সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কভিডের ক্ষেত্রে এই ঘটনা দেখা গেছে। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনেও রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের চারপাশে থাকা জীবাণুগুলোর প্রতিরোধব্যবস্থা মানুষের শরীরে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে জীবাণুগুলো তাদের প্রকৃতি পরিবর্তন করছে। এতে মানুষের শরীরে তৈরি প্রতিরোধব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: