
দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে, এমন ‘সন্ত্রাসের সমর্থক, ইহুদিবিদ্বেষী ও চরমপন্থী’ ব্যক্তিরা জার্মানির নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। তবে এমনটা হলে তা অন্যায় হবে বলে মনে করেন সমালোচকেরা।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মানির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে নতুন সরকার এখনো গঠন করা হয়নি। সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া জার্মানির রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের (সিএসইউ) জোটের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতের মিল হচ্ছে না সম্ভাব্য জোটসঙ্গী সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি)।
দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব অভিবাসন ও ইন্টিগ্রেশন নিয়ে। এ বিষয়ে রাজনীতিকেরা কী ভাবছেন, তা রয়েছে সম্ভাব্য জোটসঙ্গীদের চুক্তিপত্রে।
তেমনই একটি নথিতে ‘নাগরিকত্ব আইন’ শিরোনামে বলা হয়, ‘নাগরিকত্ব আইনের সংস্কারের প্রতি আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সাংবিধানিক আইনের আওতায় থেকে আমরা পরীক্ষা করে দেখব যে সেসব সন্ত্রাস-সমর্থক, ইহুদিবিদ্বেষী ও চরমপন্থী ব্যক্তি, যাঁরা মুক্ত ও গণতান্ত্রিক অবস্থার বিনাশ চান ও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে যাঁদের, তাঁদের জার্মান নাগরিকত্ব ফেরত নেওয়া যায় কি না৷’
এসপিডির রাজনীতিক ডার্ক ভিজে বিষয়টিকে তাঁর দলের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, এসপিডিই নিশ্চিত করেছিল যাতে কেউ তার দ্বৈত নাগরিকত্ব বহাল রাখতে পারেন। কারণ, সিডিইউ/সিএসইউ চেয়েছিল তা পুরোপুরি খারিজ করতে।
ডার্ক ভিজে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘পাঁচ বছর বসবাসের পর নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো থাকছে। যদি আপনি এই দেশে আসেন আর খুব শিগগির মাত্র তিন বছরে ভাষা শিখে যান, তাহলেও সেটা সম্ভব।’
কিন্তু ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ জার্মান নাগরিকত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার সিডিইউ/সিএসইউ জোটের প্রস্তাবকে এসপিডি ঠেকানোর চেষ্টা করলেও সফল হয়নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, নাগরিকত্ব কি তবে অস্থায়ী হতে চলেছে? এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার অর্থ কি তবে স্থায়ীভাবে জার্মান হওয়ার পথে বাধা?
ব্রেমেন শহরের মেয়র আন্দ্রেয়াস বোভেনশুলটে বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন। তাঁর মতে, জার্মানির ৫০ লাখ মানুষ যাঁদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে, তাঁদের জন্য এটি ‘সত্যিই বড় সমস্যা’৷ তিনি বলেন, ‘এতে তাঁদের মনে হবে যে তাঁদের নাগরিকত্বের মূল্য কম ও তাঁরা আসলে এই দেশের নন।’
জার্মানির পার্লামেন্ট বুন্দেসটাগে বাম দল ডি লিংকের সংসদ সদস্য ক্লারা ব্যুনগারের মতে, এই প্রস্তাব ‘দুই শ্রেণির নাগরিকত্ব দেওয়া আইন’। তিনি বলেন, ‘কে এই দেশের? আর কে নয়? অভিবাসনবান্ধব সমাজে এই প্রশ্নটাই আমরা চাই না। আমরা চাই স্পষ্ট নিয়ম ও সবার জন্য আইনি নিশ্চয়তা, সঙ্গে জার্মানিতে সবার জন্য সমান আইন।’
জার্মানির বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী, কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া জার্মান নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া যায় না। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি যদি ইসলামিক স্টেটের মতো জার্মান সরকার ঘোষিত কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত কোনো দলের হয়ে লড়েন, তাহলে তাদের জার্মান পাসপোর্ট বাতিল করা যায়। তা–ও শুধু সে ক্ষেত্রেই করা যায় যদি তাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকে।
বর্তমানে আলোচিত এই নথিতে যেভাবে ‘সন্ত্রাসী সমর্থক’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কোথায়? জার্মান আইন অনুযায়ী ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব থাকা কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।
কিন্তু আলোচিত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন হলে শুধু তাঁরাই শাস্তি পাবেন, যাঁদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। যাঁদের একমাত্র নাগরিকত্ব জার্মান ও যাঁরা ইহুদিবিদ্বেষী কথাবার্তা বলেন, তাঁদের জন্য কিছুই বদলাবে না।
লিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইহুদিবিদ্যার অধ্যাপক এলাদ লাপিডো বলেন, ‘এতে কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীই আলাদাভাবে বিবেচিত হবে, যেমন আরব বা মুসলিম দেশের মানুষ।’
লাপিডো অ্যাসোসিয়েশন অব প্যালেস্টিনিয়ান অ্যান্ড জিউয়িশ একাডেমিকস সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা।
বুন্দেসটাগ সম্প্রতি ইহুদিবিদ্বেষ আসলে কী, তা নির্দিষ্ট করতে ইন্টারন্যাশনাল হলোকস্ট রিমেমব্রেন্স অ্যালায়েন্স বা আইএইচআরএর ব্যাখ্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা আলোচনা করছে।
লাপিডো এ বিষয়েও তাঁর শঙ্কা প্রকাশ করেন। কারণ, এই ব্যাখ্যায় যে ১১টি ইহুদিবিদ্বেষী উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ইসরায়েল-সম্পর্কিত। যাঁরা এই ব্যাখ্যার সমালোচনা করেছেন—যেমন লাপিডো, তাদেরও ইহুদিবিদ্বেষী আখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
লাপিডো বলেন, ‘আপনাকে এই সমালোচনার সঙ্গে একমত হতে হবে না। কিন্তু এই সমালোচনা করতে পারাও গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন।’
লাপিডো নিজেও জার্মান ও ইসরায়েল দুটি দেশের নাগরিক। তাঁর পরিবারকে একসময় জার্মান নাগরিকত্ব হারিয়ে হামবুর্গ থেকে ১৯৩৪ সালে যুক্তরাজ্যের নির্মিত ফিলিস্তিনে চলে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘জার্মানি এর আগেও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তৈরি করেছে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল।’
পরে নাৎসি আমলে যাঁরা রাজনৈতিক, ধর্ম ও বর্ণগত কারণে জার্মান নাগরিকত্ব হারান, তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় জার্মান নাগরিকত্ব৷ সেভাবেই লাপিডো ইসরায়েলে বড় হয়েও জার্মান নাগরিকত্ব পান৷
আজকের জার্মানিতে যেভাবে চরম ডানপন্থী চিন্তাধারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা নিয়ে চিন্তিত লাপিডো৷ তিনি বলেন, ‘যে সময়ে আমরা দেখছি যে ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিদের ১৯৩০-এর দশকের চিন্তাধারা ও নীতি নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদিবিদ্বেষকে আরব, ফিলিস্তিনি ও মুসলিমদের সঙ্গে আসা বিশ্বাস হিসেবে তুলে ধরাটা বিদ্বেষপূর্ণ ও খুবই বিরক্তিকর৷’ ইহুদিবিদ্বেষ আসলে কখনোই জার্মান সমাজ থেকে পুরোপুরি মুছে যায়নি বলে জানান তিনি৷
কোনো ব্যক্তি ইহুদিবিদ্বেষী কি না, তা কে ঠিক করবে, সেটি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে৷ জার্মান সরকারের ইহুদিবিদ্বেষ–বিষয়ক কমিশনার ফেলিক্স ক্লাইনের কাছে ডয়চে ভেলে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নথিটি যেহেতু এখনো খসড়া পর্যায়ে আছে, তাই এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করবেন না৷
যে অনুচ্ছেদটি ঘিরে এত আলোচনা, তা জার্মান সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে দেশটির আদালতে৷
এই অনুচ্ছেদটি আইনের পরীক্ষায় পাস করবে না বলে আশা করছে এসপিডি। ডার্ক ভিজের মতে, ‘আমার এ বিষয়ে ব্যক্তিগত আইনি মতামত রয়েছে বলেই ধারণা করতে পারছি কী হবে৷’
তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা মানুষদের একটি বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে এতটা আশাবাদী নন৷
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: