অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, গাজার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসা ইসরায়েল আর আগের মতো নেই। সেখানে ডানপন্থী রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। শুধু ফিলিস্তিনি নয়, ইসরায়েলি সমাজও এর নেতিবাচক প্রভাব অনুভব করছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে অবশেষে নমনীয় হয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজা যুদ্ধের অবসানে রাজি না হওয়ার পর তিনি এখন একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর করতে যাচ্ছেন, মধ্যস্থতাকারীদের মতে যা যুদ্ধ বন্ধ করবে।
নেতানিয়াহুর সরকার শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। এতে জিম্মি ও যুদ্ধবন্দি বিনিময়, গাজা থেকে ধীরে ধীরে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের অবসানের কথা বলা হয়েছে।
রোববার থেকে এ চুক্তি কার্যকর শুরু হবে। কিন্তু এর মাধ্যমে নিজ দলের ভেতরে বাড়তে পারে নেতানিয়াহুর বিরোধিতা। কারণ, তার সরকারের প্রভাবশালী সদস্যরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা শুরু করেছেন। এই বিরোধিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে নেতানিয়াহুর নিজের দীর্ঘদিনের বক্তব্য— হামাস ধ্বংস ছাড়া কোনো যুদ্ধবিরতি নয়।
ইসরায়েলের ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির বিগত এক বছর ধরে যে কোনো বন্দি বিনিময় চুক্তি হতে না দেয়ার জন্য দম্ভের সঙ্গে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। এবার তিনি এই চুক্তিকে ‘ভয়ানক’ বলে ঘোষণা করে হুমকি দিয়েছেন যে, এটি কার্যকর হলে তিনি ও তার দল সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন।
তবে বেন-গাভিরের পদত্যাগও নেতানিয়াহুর সরকার পতনের জন্য যথেষ্ট নয়। বেন-গাভিরের প্রয়োজন তার কট্টর ডানপন্থী সহকর্মী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এবং তার রিলিজিয়াস জায়োনিজম পার্টির সমর্থন। স্মোট্রিচ চুক্তির প্রথম ধাপের ব্যাপারে রাজি হতে পারেন, যা কয়েকজন ইসরায়েলি বন্দির মুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এরপর রিলিজিয়াস জায়োনিজম পার্টি হুমকি দিয়েছে যে, যদি যুদ্ধ চালিয়ে না নেয়া হয় তবে তারা সরকার থেকে পদত্যাগ করবে।
এসব হুমকির পরও নেতানিয়াহু চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মার্কিন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের একদিন আগে কার্যকর হবে যুদ্ধবিরতি।
ইসরায়েলি কট্টর ডানপন্থীরা ট্রাম্পকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেছিল, যিনি গাজার বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পরিকল্পনাকে সমর্থন করবেন। তবে ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, তিনি তার দায়িত্ব নেয়ার আগে যুদ্ধ শেষ করতে চান।
ট্রাম্পের এই অবস্থানকে নেতানিয়াহুর জন্য নেতিবাচক মনে হতে পারে। তবে অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ তার জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরায়েল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইরাভ জন্সজেইন বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত অনেকের ধারণার চেয়েও বেশি লেনদেনমূলক হতে পারে। এখন চুক্তিতে রাজি হয়ে নেতানিয়াহু পশ্চিম তীর এবং গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আরো স্বাধীনতা পেতে পারেন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
নেতানিয়াহু তার সরকারের কট্টর ডানপন্থী সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রয়েছেন। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলার কারণে যখন তার জনপ্রিয়তা কমছিল এবং অনেকেই তাকে ছেড়ে যাচ্ছিলেন, তখনো বেন-গাভির ও স্মোট্রিচদের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। তারা পদত্যাগ করলে নেতানিয়াহুর সরকারের পতন ঘটতে পারে বলেও একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে তার সরকারের অধিকাংশ সদস্যই যুদ্ধবিরতির পক্ষে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আল্ট্রা-অর্থোডক্স রিলিজিয়াস ব্লকও রয়েছে।
নেতানিয়াহু হয়তো জনমতের পরিবর্তন বুঝতে সক্ষম হয়েছেন এবং মনে করছেন, বন্দিদের মুক্তি এবং যুদ্ধের অবসানের পক্ষে জনগণের অবস্থান এখন আরো বেশি কঠোর।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলি জনমনে ক্লান্তি এবং অবসাদ দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেউই উদযাপন করছে না। সবাই জানতো, এ যুদ্ধ শেষ হবেই। ফিলিস্তিনিদের মতো না হলেও, গত ১৫ মাস ইসরায়েলিরাও স্বস্তিতে থাকতে পারেনি।
তিনি আরো বলেন, গত ১৫ মাসে বারবার বলা হয়েছে, আমরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া কিছুই অর্জিত হয়নি। ইসরায়েলিরা এখন ক্লান্ত। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে হয়তো অনেক ইসরায়েলিই ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চাইতো। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তা পায়নি ইসরায়েল।
এ কারণে নেতানিয়াহু জনসাধারণের অনুভূতি কাজে লাগিয়ে নিজেকে যুদ্ধ শেষ করার এবং নতুন কোনো নির্বাচনের আগেই কয়েকটি কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। এসব কৌশল তাকে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার আরেকটি সুযোগ এনে দিতে পারে।
তবে ইসরায়েলি সমাজের জন্য এই যুদ্ধের খেসারত বেশ বড়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই যুদ্ধকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। গাজায় বন্দি ইসরায়েলিদের পাশাপাশি লেবানন ও গাজার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কফিনে ফিরছে সৈন্যরা। সে সঙ্গে বাড়ছে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, গাজার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসা ইসরায়েল আর আগের মতো নেই। সেখানে ডানপন্থী রাজনীতির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। শুধু ফিলিস্তিনি নয়, ইসরায়েলি সমাজও এর নেতিবাচক প্রভাব অনুভব করছে।
যুদ্ধের পুরো সময়ে ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনৈতিক চরমপন্থীরা আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। দেশটির নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ক্ষমতা এমনভাবে বেড়েছে, যা আগে কেউ ভাবতেও পারেনি।
মে মাসে দুইজন বিশিষ্ট ইসরায়েলি গবেষক ইউজিন ক্যান্ডেল এবং রন জুর যৌথভাবে এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন— গাজার যুদ্ধে সৃষ্ট বিভাজনগুলো বিবেচনায় নিলে, আগামী কয়েক দশক পর ইসরায়েল একটি সার্বভৌম ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে না, এমন একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসরায়েলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েলের নির্বাহী পরিচালক ডা. গাই শালেভ বলেন, ইসরায়েলের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের একটি সুস্পষ্ট চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ যুদ্ধের আগে মানবজীবনকে এভাবে অবমূল্যায়িত হতে দেখা যায়নি। এই পর্যায়ের প্রাণহানি এবং ইসরায়েলি বন্দিদের জীবনের প্রতি সরকারের নির্লিপ্ততা ক্ষয় করেছে সকল ইহুদিদের মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ববোধের অনুভূতি। আমি মনে করি, যদি ফিলিস্তিনিদের জীবন গুরুত্বহীন হয়, তবে একসময় সব জীবনই কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়বে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: